খুব ঝুঁকি নিয়ে ফেলছেন ইমরান খান
ইমরান খান - ছবি : সংগ্রহ
প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে যেতে বাধ্য হওয়ার পর ইমরান খান এখন যে পথ বেছে নিয়েছেন এটি তার জন্য অনেক ঝুঁকিপূর্ণ একটি রাস্তা। তিনি করাচির মহাসমাবেশে সেটি উল্লেখও করেছেন। কিন্তু এর বিকল্প পথ হলো শরীফ-জারদারির সংসদীয় অভ্যুত্থানোত্তর সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপের কাছে আত্মসমর্পণ করা। এই পথ হতো ইমরান খানকে জেলে নেয়া, মামলার পর মামলা দিয়ে তার দলকে প্রান্তিক অবস্থায় ঠেলে দেয়াকে মেনে নেয়া। এ ধরনের কথা ক্ষমতা গ্রহণের আগে বিলওয়াল ভুট্টো জারদারি ও মরিয়ম নওয়াজ একাধিকবার বলেছেন। সঙ্গত কারণে ইমরানের মতো একজন লড়াকু ব্যক্তি শেষ বল পর্যন্ত খেলার সিদ্ধান্ত নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ রাস্তায় নেমেছেন।
এখন ইমরানের পক্ষে যে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে, সেটিকে প্রশাসনিক ক্ষমতা দিয়ে থামিয়ে দেবার পরিণতি হতে পারে গৃহযুদ্ধের দিকে দেশটিকে ঠেলে দেয়া। ৮০ লক্ষাধিক পাকিস্তানি টুইট করে ইমরানের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। কড়া জাতীয়তাবাদ ও এক ধরনের আদর্শবাদে উদ্বুদ্ধ এই বিপুল তারুণ্যকে দমিয়ে দিতে চাইলে তা সশস্ত্র রূপ নেবার আশঙ্কাও থেকে যায়। এমনিতেই পাকিস্তানের খাবার পাখতুনখোয়ায় তেহরিকে তালেবান ও বেলুচিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপের সশস্ত্র তৎপরতা রয়েছে। এই অবস্থায় শাহবাজ সরকার অথবা গভীর ক্ষমতা বলয় জবরদস্তি কিছু করতে গেলে বড় রকমের বিপত্তি ঘটতে পারে। আর এ নিয়ে সামরিক প্রতিষ্ঠান যে চাপের মুখে রয়েছে তা দুটি ঘটনায় স্পষ্ট হয়।
প্রথমত, হঠাৎ করেই আফগানিস্তানের দুটি প্রদেশে উগ্রবাদী দমনের নামে পাকিস্তানের বিমান হামলার জের ধরে আফগানিস্তানের সাথে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। একই সাথে চাঙ্গা হতে শুরু করেছে পাকিস্তানে তেহরিকে তালেবান গোষ্ঠী। নতুন সরকার আমেরিকাকে সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের অনুমতি দিতে পারে বলে জল্পনা ছড়িয়ে পড়েছে। সেটি বাস্তবে ঘটলে আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের সাথে দূরত্ব তৈরি হবে। পাকিস্তানের সমাজ ও রাজনীতিতে তালেবানবিরোধী হিসাবে পরিচিতরা এখন সরকারের মুখ্য ভূমিকায় রয়েছে। মওলানা ফজলুর রহমানকে এর কিছুটা ব্যক্তিক্রম বলা যায়। নাজিম শেঠি, হামিদ মীরসহ তালেবান বিরোধী লেখক বুদ্ধিজীবীরা কাবুুলের সাথে ইসলামাবাদের দূরত্ব তৈরি হবার মতো নানা লেখা লিখছেন।
যেকোনো কারণে আফগানিস্তানের তালেবান কর্তৃপক্ষের সাথে ইসলামাবাদের সংঘাত তৈরি হলে তা এই অঞ্চলে অনেক বড় অস্থিরতার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। রাষ্ট্র হিসাবে পাকিস্তানের অস্তিত্বের শেকড়কে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে এটি। আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, ইমরান খান অত্যন্ত সচেতনভাবে সামরিক প্রতিষ্ঠান ও বিচার বিভাগের প্রতি উত্তেজনাকরভাবে অভিযোগের আঙুল তোলা থেকে বিরত রয়েছেন। কিন্তু দেশের ভেতরে বাইরে বিভিন্ন স্থান থেকে সামাজিক গণমাধ্যমে সামরিক প্রতিষ্ঠানকে বিতর্কিত করার জন্য লেখালেখি লক্ষ করা যাচ্ছে। আইএসপিআর থেকে এ ব্যাপারে সতর্কবাণীও উচ্চারণ করা হয়েছে। কিন্তু অনেক পর্যবেক্ষকের ধারণা, রাজনৈতিকভাবে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের শত্রুরা সামরিক প্রতিষ্ঠানকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করছে। তারা জানে, পাকিস্তানে পরমাণু অস্ত্র ও নিরাপত্তার সর্বশেষ রক্ষক হলো সেনা প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানটির ভূমিকার ওপর বর্তমান সঙ্কটকাল অতিক্রম করার ক্ষেত্রে অনেক কিছু নির্ভর করবে।
করাচিসহ সাম্প্রতিক জনসভাগুলোতে অনেককে ‘নো বাজওয়া’ প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করতে দেখা গেছে। জনগণের মধ্যে তার প্রতি নেতিবাচক মনোভাবের কারণে বাজওয়া আগামী নভেম্বরে মেয়াদ পূরণ হবার পর আর সেনাপ্রধানের দায়িত্বে না থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। কোনো ব্যক্তির ভূমিকার জন্য সেনা প্রতিষ্ঠানের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব তৈরির বিষয়টি অনুচিত বলেই মনে করা হচ্ছে।
নতুন নির্বাচনের সম্ভাবনা
পাকিস্তানের জনমত দেখে গভীর ক্ষমতা বলয় স্বল্পতম সময়ে একটি নতুন নির্বাচনের দিকে যাবে বলে মনে হচ্ছে। বিরোধী যে জোট ইমরান সরকারের পতনে নেতৃত্ব দিয়েছে সেই জোটের প্রধান মওলানা ফজলুর রহমান দ্রুত নতুন নির্বাচন দাবি করে বলেছেন, তার দল শাহবাজ সরকারের মন্ত্রিত্ব নেবে না। সার্বিক পরিস্থিতিতে পিপিপি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও এমকিউএম এর সহযোগিতা ছাড়া শাহবাজের পক্ষে দুই মাস সরকার চালানো কঠিন হতে পারে। ‘গভীর ক্ষমতা বলয়’ বিষয়টি উপলব্ধি করে পাকিস্তানের বৃহত্তর স্বার্থে ২০২২ সালের মধ্যে নতুন এক নির্বাচন ডাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর মধ্যে সেনা প্রতিষ্ঠানে নতুন নেতৃত্বও আসতে পারে। নির্বাচনের বাইরে কোনো কিছুর চিন্তা করা হলে সেটি পাকিস্তান রাষ্ট্রের সামনে চরম কোনো অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করতে পারে, যা দেশে বিদেশে কারো কাম্য হবার কথা নয় কোনোভাবেই।
শরিফের জোট সরকার এর মধ্যে একাধিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। এর মধ্যে প্রথমটি হলো, বিরোধীদের সাথে কাজ করার প্রস্তাব দিয়ে রাজনৈতিক উত্তেজনা প্রশমিত করা যেমনটি প্রধানমন্ত্রী শরিফ ইতোমধ্যেই করেছেন, কিন্তু এতে সাফল্য আসেনি। সরকারকে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে সহায়তা প্রাপ্তিসহ অবনতিশীল অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে হবে। সরকারে স্থিতি না এলে সেটি কঠিন হতে পারে। পাকিস্তানি তালেবান, যারা আফগান সীমান্তের উপজাতীয় অঞ্চলে ফিরে আসছে, তারা আবারও একটি ক্রমবর্ধমান হুমকি হতে পারে। নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসবে, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা যেন সহিংসতায় রূপান্তরিত না হয় তা নিশ্চিত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। প্রধানমন্ত্রী শরিফ এবং তার জোটের অংশীদাররা নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সংস্কারকে প্রধান অগ্রাধিকার হিসেবে চিহ্নিত করেছেন; এগুলো ভোটকে আরো স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য করে মারাত্মক অস্থিরতার ঝুঁকি কমাতে পারে।
ইমরান খান নতুন সরকারের সাথে তার লড়াইকে রাস্তায় নিয়ে যেতে চান। তবে রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান, নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ এবং আইনসভাকে একই সাথে গ্রহণ করার ক্ষমতা তার সমর্থকদের থাকার ওপর তাদের সাফল্য নির্ভর করবে। শরিফের মতো ব্যাপকভাবে ভিন্ন মতাদর্শের দলগুলোর সমন্বয়ে গঠিত একটি জোট সরকারের মূল রাজনৈতিক ইস্যুতে ঐকমত্যে পৌঁছানো কঠিন হতে পারে। এই মতানৈক্য নির্বাচনকে করে তুলতে পারে অনিবার্য, যার আলামত এখনই দেখা দিতে শুরু করেছে। এছাড়াও শরীফের নতুন সরকার মুদ্রাস্ফীতির হারকে মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হলে ভোটারদের কাছ থেকে ইমরান খানের মতো একই চাপের মুখোমুখি হতে পারে। এখন ইউক্রেন যুদ্ধ এবং রাশিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞার কারণে বিশেষ করে জ্বালানি ও খাদ্যের দাম বৃদ্ধিতে মূল্যস্ফীতি আরো বেড়েছে। রাজনৈতিক সংঘাত আরো সহিংস হয়ে উঠলে এবং নিরাপত্তা পরিবেশের আরো অবনতি হলে, সামরিক বাহিনীর প্রতি আবারও রাজনৈতিক ময়দানে সক্রিয় হবার চাপ দেওয়া হতে পারে। নতুন সরকার কীভাবে এই মাইনফিল্ডগুলোতে নেভিগেট করবে তা নির্ধারণ করবে পাকিস্তান এই রাজনৈতিক সঙ্কটের চলমান পৃষ্ঠা উল্টে পরবর্তী নির্বাচনে শান্তিপূর্ণভাবে যেতে পারবে কিনা।
mrkmmb@gmail.com