যেখানে সফল ইমরান খান

ইমরান খান - প্রতীকী ছবি
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইমরান খানের ব্যর্থতার পাশাপাশি সফলতার দিকও আছে। সমাজসেবা ব্যবস্থার বেশ চমৎকার কিছু সম্প্রসারণ করেছেন তিনি। দেশের বেশির ভাগ স্থানে স্বাস্থ্যবীমা ব্যবস্থা চালু করেছেন। পিটিআই সরকার দাবি করছে, তাদের শাসনামলে পুরো অঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে সস্তায় পেট্রোল বিক্রি করা হয়েছে; রেকর্ড ট্যাক্স সংগৃহীত হয়েছে। এ সময়ে সবচেয়ে বেশি আমদানি হয়েছে ও রেমিট্যান্স এসেছে। পাকিস্তানের পরিসংখ্যান ব্যুরোর লেবার ফোর্স সার্ভের দাবি, গত তিন বছরে ৫৫ লাখ কর্মসংস্থান হয়েছে অর্থাৎ প্রতি বছর ১৮ লাখ মানুষের খেয়ে পরে বাঁচার সংস্থান হয়েছে। ভারত ও বাংলাদেশে করোনাকালীণ লকডাউনের ফলে রফতানির সাপ্লাই চেইনে বিঘœ ঘটে, তখন বিদেশে থাকা ক্রেতারা পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকে পড়েন। উচ্চ রফতানি আদেশের কারণে ২০০০ সালে পাকিস্তানের টেক্সটাইল রফতানি ৪.৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। এতে দেশের মোট রফতানি বৃদ্ধি পায় এবং অন্যদিকে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়তা করে। করোনা মোকাবেলায় সরকার সফল হয়েছে। সে কারণে পাকিস্তানে মহামারী ইউরোপ বা যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিপজ্জনক হয়নি। ভারতের তুলনায় পাকিস্তানে করোনায় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যাও কম ছিল। পাকিস্তানে যেখানে আক্রান্তের সংখ্যা ১৫ লাখ এবং মৃত্যু ৩০ হাজার, সেখানে ভারতে মোট আক্রান্তের সংখ্যা চার কোটি ছাড়িয়েছে আর মৃত্যু হয়েছে পাঁচ লাখ ২১ হাজার মানুষের। ২০১৬ সালে খাইবার পাখতুনখাওয়াতে স্বাস্থ্যকার্ড চালু করা হয়। আর্থিক পরিস্থিতির কারণে হাসপাতালে যেতে অক্ষম নাগরিকদের জন্য বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসুবিধা দিতে এ কার্ড চালু করা হয়। ইমরান খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর এই প্রকল্প আরো সম্প্রসারিত হয় এবং তিনি আট কোটি নাগরিকের জন্য এই কার্ড দেয়ার ঘোষণা দেন। এই প্রকল্পের মাধ্যমে জনগণ অনেক সুবিধা পাচ্ছেন- ১.কার্ডধারীদের বছরে সাত লাখ ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত চিকিৎসাসুবিধা পাবেন; ২. দেড় কোটি পরিবারকে অর্থাৎ আট কোটি নাগরিককে বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরিষেবা দেয়া হবে ও ৩. অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি, ব্রেন সার্জারি ও ক্যান্সারসহ বিভিন্ন রোগের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসার নিশ্চয়তা দেয়া হয়।
ইমরান খান ক্ষমতায় আসার পর নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসনের ব্যবস্থা করেন। এই প্রকল্পের জন্য একটি পৃথক ‘নিউ পাকিস্তান হাউজিং অথরিটি’ গঠন করা হয় এবং প্রাথমিক পর্যায়ে সাতটি শহরে বাড়ি নির্মাণের কাজ শুরু করা হয়। সরকার ব্যাংকগুলোকে সহজ শর্তে ঋণ দেয়ার জন্য উৎসাহিত করে, যার মধ্যে বিভিন্ন সময়ের জন্য ২০ লাখ থেকে এক কোটি পর্যন্ত ঋণ প্রদান অন্তর্ভুক্ত করা হল। একই সাথে সরকার নির্মাণ খাতের উন্নয়নে এবং দেশে বাড়ি নির্মাণের পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য নির্মাণ খাতের জন্য দু’টি আলাদা স্কিম চালু করে। ২০১৪ সালে খাইবারপাখতুনখাওয়া সরকার ১০০ কোটি গাছের চারা রোপণের প্রকল্প হাতে নেয়। ২০১৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর ইমরান খান প্রকল্পটিকে এক হাজার কোটিতে উন্নীত করেন, যা বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তাও পায়। জাতিসঙ্ঘ এবং ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো পাকিস্তানের এই পরিকল্পনার প্রশংসা করে এবং দক্ষিণ আফ্রিকা, বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের মতো দেশগুলোতে পরবর্তীকালে একই ধরনের কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়। এই প্রকল্পটি দেশীয় ও বৈশ্বিক পর্যায়ে বেশ গুরুত্ব অর্জন করে (বিবিসি, ঢাকা পোস্ট ডটকম, ১০ এপ্রিল, ২০২২)।
নতুন সরকার কিভাবে দেশ চালায় তার জন্য পাকিস্তানের জনগণকে অপেক্ষা করতে হবে। পরস্পর বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে গঠিত সরকার কতদিন টিকে থাকে তা দেখার বিষয়। মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্টের ওপর ভরসা করা কঠিন। তবে নবগঠিত সরকারের প্রতি সেনাবাহিনীর আশীর্বাদ থাকায় দেড় বছর পর অনুষ্ঠেয় নির্বাচন পর্যন্ত সরকার বহাল থাকার সম্ভাবনা আছে। নতুন প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ ঠাণ্ডা মেজাজের মানুষ, ভদ্র ও দূরদর্শী। সামরিক প্রতিষ্ঠানের সাথে অপ্রয়োজনীয় দ্বন্দ্বে তিনি জড়াতে চান না। আল-জাজিরার বিশ্লেষণ মতে, ৭০ বছর বয়সী শাহবাজ শরিফ তার নিজের যোগ্যতা বলে একজন হেভিওয়েট রাজনীতিক। এ ছাড়া তিনি তিনবারের পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী, পরিবারের ক্ষমতার ভিত্তি মজবুত এবং পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। আবেগপ্রবণ ও উচ্ছ্বাসের প্রাবল্যসহ তিনি একজন কঠোর প্রশাসক। তিনি বক্তৃতায় বিপ্লবী কবিতা উদ্ধৃত করতে পছন্দ করেন এবং তাকে একজন কর্মপাগল মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তার বিরুদ্ধে ট্যাবলয়েড পত্রিকার নৈতিক ও আর্থিক নানা অভিযোগ তোলা সত্ত্বেও তিনি জনপ্রিয়। নতুন প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ বলেছেন, ‘পাকিস্তানের বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য বন্ধু হচ্ছে চীন। সবসময়ই চীন আমাদের বন্ধু ছিল, চিরদিন থাকবে। কেউ চীনের সাথে পাকিস্তানের বন্ধুত্বে চিড় ধরাতে পারবে না। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সমতার ভিত্তিতে সম্পর্ক পরিচালিত হবে। ‘বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক অস্থির হয়ে উঠেছে। কিন্তু আমাদের সম্পর্ক নষ্ট করার তো কোনো অর্থ নেই।’
আফগানিস্তানের তালেবানের প্রতি সমর্থন, মার্কিনবিরোধী ভূমিকা, পশ্চিমাদের ইসলামোফোবিয়া, মুসলিম জাতিসত্তার জাগরণ, মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর ঐক্য, জাতিসঙ্ঘে প্রদত্ত ভাষণ, বিদেশী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা তরুণ প্রজন্মের কাছে ইমরান খানের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করেছে। সাংবিধানিক সঙ্কট চলাকালে ইসলামাবাদসহ বড় বড় শহরে তার দলের লাখ লাখ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সমাবেশ তার প্রমাণ। ইমরান খান ও তার সমর্থকরা মার্কিন ও পশ্চিমাবিরোধী মানসিকতা পোষণ করেন। নির্বাচনে এই ইস্যুকে ট্রাম্পকার্ড হিসেবে ব্যবহার করবেন তারা, এমন ধারণা বিশ্লেষকদের। সাম্প্রতিক সময়ে খায়বারপাখতুনখাওয়ার স্থানীয় নির্বাচনে তেহরিক-ই-ইনসাফের বিপুল বিজয় পুরো দেশে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। পাকিস্তানে যখনই কোনো প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্ট মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে চেয়েছেন তারা হয়তো ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন, নইলে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। লিয়াকত আলী খান, জুলফিকার আলী ভুট্টো, জেনারেল জিয়াউল হক, বেনজির ভুট্টোর অস্বাভাবিক মৃত্যু তার দৃষ্টান্ত। ইমরান খানও প্রকাশ্যে বলেছেন, ‘তাকে হত্যা করা হতে পারে’।
এ কথাটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। পাকিস্তানের ইতিহাসে যেসব রাজনীতিক অজ্ঞাত আততায়ীর হাতে শাহাদত বরণ করেন তাদের কোনো ঘাতকের বিচার হয়নি। তদন্ত কমিটির রিপোর্ট কেউ জানতে পারেনি। এটি কেবল রহস্যজনক নয়, রীতিমতো উদ্বেগজনকও বটে। স্টাবলিশমেন্টকে পাশ কাটিয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে পাকিস্তানের ক্ষমতায় ইমরান খান ফিরে আসতে পারবেন কি না সন্দেহ আছে। এরকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে সেনাহস্তক্ষেপ অনিবার্য হয়ে উঠবে। জেনারেল জিয়াউল হক সংবিধানের ধারা সংশোধন করে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের পথ সুগম করেন। দ্য আর্টিক্যাল ৫৮(২)(বি)-তে বলা হয়েছে- ‘জাতীয় সংহতি ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করতে পারবে।’
তবে একটা বিষয় লক্ষণীয় তা হলো- পাকিস্তানে রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, স্টাবলিশমেন্টের হস্তক্ষেপ নানা অভিযোগ সত্ত্বেও সে দেশের মানুষ ভোট দিতে পারে, সুপ্রিম কোর্টের আদেশে পার্লামেন্ট পুনর্বহাল হয়, অনাস্থা ভোটে প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতা হারান, মিডিয়া ক্ষমতাসীন সরকারের সমালোচনা করতে পারে এবং বিরোধী দল রাজপথে সমাবেশ করার অধিকার রাখে। এই রাজনৈতিক সংস্কৃতি, আদালতের স্বাধীনতা ও জনমত প্রকাশের মৌলিক অধিকার দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার অনেক রাষ্ট্রের নেই। এই কথা স্বীকার না করে উপায় নেই।
লেখক : শিক্ষক ও গবেষক
drkhalid09@gmail.com