মহাবিপদে শ্রীলঙ্কা, কতটুকু দায়ী চীন!

অন্য এক দিগন্ত | Apr 17, 2022 03:05 pm
মহাবিপদে শ্রীলঙ্কা, কতটুকু দায়ী চীন!

মহাবিপদে শ্রীলঙ্কা, কতটুকু দায়ী চীন! - প্রতীকী ছবি

 

খুবই খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে শ্রীলঙ্কা। বলা হচ্ছে, ১৯৪৮ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে পড়েছে শ্রীলঙ্কা।

৫১০০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণের বোঝায় জর্জরিত ভারতের প্রতিবেশী দেশটি সম্প্রতি নিজেদের ঋণখেলাপি বলে ঘোষণা করেছে।


শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর নন্দলাল ওয়েরাসিংহে কলম্বোতে সাংবাদিকদের বলেন, "আমরা বিদেশি ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছি।"

ঋণ পরিশোধে স্থগিতাদেশ শ্রীলঙ্কার জন্য একটি শেষ অবলম্বন। কারণ ওই অর্থ জ্বালানি, খাদ্য, গ্যাস, ওষুধ এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় পণ্যগুলি সরবরাহের কাজে ব্যবহার করা হবে।

এই বছর শ্রীলঙ্কাকে প্রায় ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে হত। যার মধ্যে রয়েছে ১০০ কোটি ডলারের আন্তর্জাতিক সোভেরেন বন্ড, যার মেয়াদ শেষ হতে চলেছে জুলাই মাসে।

বন্ডহোল্ডার, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য দেশের প্রায় ৭০০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণের অর্থ পরিশোধ করার প্রক্রিয়া স্থগিত করেছে শ্রীলঙ্কার অর্থ মন্ত্রণালয়। দেশটি দীর্ঘ দিন ধরেই বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছে।

শ্রীলঙ্কার মোট ঋণের অর্ধেকের কিছু কম আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বন্ডের মাধ্যমে নেওয়া হয়েছিল। যার মধ্যে ১০০ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের একটি বন্ডের মেয়াদ আগামী ২৫ জুলাই শেষ হবে।

পর্যটন নির্ভর শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছে কোভিড অতিমারির কারণে। যার কারণে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে দেশের ভাণ্ডার।

হিসেব করলে দেখা যাবে যে, এই বছর শ্রীলঙ্কার ঋণের বোঝা মেটাতে ৭০০ কোটি ডলারের প্রয়োজন। অথচ হিসেব অনুযায়ী, মার্চের শেষে দেশটির ভাণ্ডারে রয়েছে মাত্র ১৯০ কোটি ডলার।

কৌশলগত ঋণের ফাঁদ :

চীন হলো শ্রীলঙ্কার বৃহত্তম ঋণদাতা। আর এই দ্বীপ রাষ্ট্রের মোট ঋণের ১০ শতাংশ এসেছে কমিউনিস্ট দেশটির কাছ থেকে। শ্রীলঙ্কাকে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে চিনের পরেই রয়েছে জাপান এবং ভারত। আর এই ঋণে ভারসাম্য না-থাকার কারণেই সঙ্কট মারাত্মক আকার নিয়েছে।

সমস্যা মেটানোর জন্য বিদেশী সাহায্য চাইতে বাধ্য হয়েছে শ্রীলঙ্কা। এর ফলে চিনের উপর দেশটির নির্ভরতা বেড়েছে, যার কারণে ঋণের বোঝাও পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। আর পরিস্থিতিও খারাপ থেকে খারাপতর হয়েছে।

সমুদ্র বন্দর, বিমানবন্দরসহ নানা পরিকাঠামোগত প্রকল্পের জন্য সেই ২০০৫ সাল থেকে বেজিংয়ের সাহায্য নিয়ে আসছে শ্রীলঙ্কা। যদিও এই সব প্রকল্প থেকে কোনও লাভই ঘরে তোলা যায়নি।

২০১৭ সালে একটি চীনা সংস্থাকে কৌশলগত হাম্বানটোটা বন্দরটি ইজারা দিয়েছিল শ্রীলঙ্কা। কারণ এই বন্দর নির্মাণে বেইজিংয়ের থেকে নেয়া ঋণ তারা পরিশোধ করতে পারেনি। এই ভাবেই দ্বীপ রাষ্ট্রটি ধীরে ধীরে ঋণের ফাঁদে জড়াতে শুরু করে, যা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ভারত ও পশ্চিমি দেশগুলো।

চীনের কাছে শ্রীলঙ্কার মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮০০ কোটি ডলার, যা তার মোট বৈদেশিক ঋণ ৪৫০০ কোটি ডলারের প্রায় ৬ ভাগের ১ ভাগ। এই বছরের জন্য শ্রীলঙ্কার থেকে চীনের পাওনা প্রায় ১৫০ কোটি থেকে ২০০ কোটি ডলার।

হংকং পোস্টের সাম্প্রতিক একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুরুতেই অলাভজনক পরিকাঠামো প্রকল্পের জন্য বেপরোয়া ভাবে ধার নেয়া দেশটিকে আজকে এই পরিস্থিতির মুখে দাঁড় করিয়েছে। প্রতিবেদন অনুসারে, ঋণে কিছু ছাড় দেয়ার জন্য শ্রীলঙ্কার আবেদনে সাড়া দিতে অস্বীকার করেছিল বেইজিং।

মঙ্গলবার চীনের বিদেশ মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ান বলেছেন যে শ্রীলঙ্কার বিপর্যস্ত অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যাতে ঘুরে দাঁড়াতে পারে, তার জন্য সহায়তা দিয়ে যাবে বেইজিং।

তিনি বলেন, "চীন সর্বদা শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে সাহায্য করার জন্য সর্বোত্তম চেষ্টা করেছে। আর ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত থাকবে।" তবে, ঋণ পুনর্নির্ধারণ ও ২৫০ কোটি ডলার সহায়তা দেয়ার জন্য শ্রীলঙ্কার অনুরোধের বিষয়ে মুখ খোলেনি চীন।

গত কয়েক বছর ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বারবার অভিযোগ করেছে যে, 'ঋণ কূটনীতি' ব্যবহার করে বিশ্ব জুড়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে তাদের উপর আরো নির্ভরশীল করে তুলছে বেইজিং।

চীন গত এক দশকে বিশ্বের বৃহত্তম ঋণদাতা হয়ে উঠেছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাঙ্কগুলি সাম্প্রতিক কয়েক বছরে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা বিশ্ব ব্যাংকের চেয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলিকে বেশি ঋণ দিয়েছে। সেই ঋণের কয়েকটি শর্তাবলী নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, মহামারি ছাড়াও চীনের ঋণের ফাঁদ দরিদ্র দেশগুলোর সমস্যা আরো বাড়িয়ে তুলেছে।

সাহায্যের হাত বাড়াল ভারত :
সিংহল এবং তামিল নববর্ষের আগে শ্রীলঙ্কার জনগণকে তাদের অন্যতম বড় উৎসব উদযাপন করতে সাহায্য করার জন্য ১১ হাজার মেট্রিক টন চালের চালান পাঠিয়েছে ভারত। এছাড়াও অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবিলায় আর্থিক সহায়তার অংশ হিসাবে শ্রীলঙ্কাকে ১০০ কোটি ডলার ঋণও দিয়েছে ভারত।

এর আগে ফেব্রুয়ারি মাসে জ্বালানি কেনার জন্য দেয়া হয়েছিল ৫০০০০ কোটি ডলার। এর পাশাপাশি, ভারত ইতিমধ্যেই শ্রীলঙ্কায় ২ লক্ষ ৭০ হাজার মেট্রিক টন জ্বালানি সরবরাহ করেছে।২০২১ সালের নভেম্বরে শ্রীলঙ্কাকে ১০০ টন ন্যানো নাইট্রোজেন তরল সারও দিয়েছিল ভারত, কারণ সেই সময় শ্রীলঙ্কা সরকার রাসায়নিক সার আমদানি বন্ধ করে দিয়েছিল

এছাড়াও, ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংক ৪০ কোটি ডলার মুদ্রার অদলবদল বাড়িয়েছে এবং এশিয়ান ক্লিয়ারেন্স ইউনিয়নের অধীনে শ্রীলঙ্কার সেন্ট্রাল ব্যাংকের কয়েক শ' মিলিয়ন ডলার মূল্যের বকেয়া পেমেন্ট স্থগিত করেছে।

এএনআই-এর রিপোর্ট অনুসারে, ভারত সম্প্রতি পেরাদেনিয়া হাসপাতালে ওষুধ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যেখানে ডলার সঙ্কটের কারণে ওষুধের সরবরাহ কম ছিল এবং ওষুধ কেনা অসম্ভব হয়ে পড়েছিল।

ঘাটতি রয়ে গিয়েছে :

শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে, দেশের মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে পারছেন না। দেশে ওষুধসহ বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এছাড়া প্রতিদিনই দীর্ঘ কয়েক ঘণ্টার জন্য বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন থাকছে। ফলে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে।

ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতির কারণে দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামও আকাশ ছুঁয়েছে। এছাড়াও জীবনদায়ী ওষুধের আকালের জেরে হাসপাতালগুলিতেও পরিষেবা দেওয়া যাচ্ছে না ঠিক করে।

বহু মানুষের জরুরি চিকিৎসা ও অস্ত্রোপচার বন্ধ হয়ে গিয়েছে। চিকিৎসকরা সতর্ক করেছেন যে এই রকম চলতে থাকলে মহামারীর চেয়েও বেশি মানুষের অকাল মৃত্যু ঘটবে।

শ্রীলঙ্কা মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন বলেছে যে, দেশের সমস্ত হাসপাতালে আমদানি করা হয় এমন চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ সরবরাহ হচ্ছে না।

বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি জ্বালানি আমদানির ক্ষমতাকেও পঙ্গু করে দিয়েছে, যা জনজীবনকে বিরূপ ভাবে প্রভাবিত করেছে। এমনকি রান্না করার তেল সংগ্রহ করতেও দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে মানুষকে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, ২০ মার্চ থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে প্রায় ৮ জন প্রাণ হারিয়েছেন।

বিক্ষোভ অব্যাহত :

দেশের এই চরম আর্থিক পরিস্থিতিতে প্রবল বিক্ষোভ শুরু হয়েছে সে দেশে। রাস্তায় নেমে সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে মানুষ। প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের পদত্যাগের দাবিতে গত কয়েক দিন ধরেই দেশটির মানুষ লাগাতার প্রতিবাদ করে আসছে।

রাজধানী কলম্বোতে প্রেসিডেন্টের সিফ্রন্ট অফিসের বাইরে হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভে সামিল হচ্ছেন। এদিকে, দেশের ব্যবসায়ী মহলও শনিবার প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের দাবি তুলেছে। রাজাপক্ষে সরকার শ্রীলঙ্কাকে সঙ্কট থেকে বের করে আনতে সাহায্য করার জন্য একটি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সাহায্য চেয়েছে।

নতুন অর্থমন্ত্রী আলি সাবরি শুক্রবার সংসদে বলেছেন যে, আগামী তিন বছর দেশে ভারসাম্য বজায় রাখতে আইএমএফ-র থেকে তারা অতিরিক্ত ৩০০ কোটি ডলার আশা করছেন। কয়েক জন বিশ্লেষক ২০১৯ সালে কর কমানোর সিদ্ধান্ত এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সাথে আলোচনায় দেরি করার জন্য রাজাপক্ষে প্রশাসনের সমালোচনা করেছেন।

কয়েক দশকের মধ্যে দেশের সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবিলায় শ্রীলঙ্কা সরকার এখন আইএমএফ-র কাছে ঋণ পুনর্গঠন কর্মসূচি চেয়েছে।

অর্থ মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, "১৯৪৮ সালে স্বাধীনতার পর থেকেই শ্রীলঙ্কা বিদেশ থেকে ঋণ নেওয়া শুরু করে। তাই এর একটা রেকর্ড রয়েছে। তবে কোভিডের প্রভাব এবং ইউক্রেনে যুদ্ধসহ নানা বিষয় শ্রীলঙ্কার আর্থিক অবস্থানকে এতটাই ক্ষয় করেছে যে, স্বাভাবিক পরিষেবা দেয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।" মন্ত্রণালয় বলেছে যে, আইএমএফ শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি মূল্যায়ন করেছে।

ভারতে তামিল শরণার্থী :

আর্থিক সঙ্কটের মধ্যেই শ্রীলঙ্কা থেকে ভারতে চলে আসছেন অনেকে। রবিবার ১৯ জন শ্রীলঙ্কার শরণার্থী তামিলনাড়ু উপকূলে পৌঁছেছেন। তাদের মধ্যে রয়েছে মহিলা এবং শিশুরাও। জানা গেছে, সবাই শ্রীলঙ্কার উত্তরাঞ্চল থেকে দুটি নৌকায় করে তামিলনাড়ুর রামেশ্বরম উপকূলে পৌঁছেছেন। সর্বশেষ পাওয়া খবর অনুসারে, ২২ মার্চ থেকে মোট ৩৯ জন শ্রীলঙ্কা থেকে তামিলনাডুতে এসে পৌঁছেছেন।

সূত্র : নিউজ ১৮


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us