ট্রাম্প-ইমরান নেপথ্য কথা
ট্রাম্প ও ইমরান - প্রতীকী ছবি
কম করে হলেও গত ৪০ বছরে পাকিস্তানের রাজনীতিবিদরা যা প্রধানত নওয়াজের মুসলিম লিগ আর ভুট্টোর বংশধরদের দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি- এ দুই পার্টি ও তাদের সহযোগী ক্ষমতার উচ্ছিষ্টভোগী আরো কিছু ছোট দল- এরাই পাকিস্তানকে বিদেশী বিশেষত আমেরিকার খেয়াল ও ইচ্ছার লীলাভূমি করে রেখেছে। এর সাথে যোগ দিয়েছে সেনাবাহিনী। আর এদের প্রত্যেকের বক্তব্য হচ্ছে, আমরা তো ভিক্ষুক! আমরা গরিব। তাই আমেরিকা আমাদের তো এমন করবেই! আমাদের কিছু বলার, কিছু বাছ-বিচারের ক্ষমতা নেই। কাজেই ক্ষমতাধর আমেরিকা পাকিস্তানকে যেভাবে রাখছে, যা দিচ্ছে, আমাদের সাথে যা করছে এটা মেনে নাও! এতদিন ধরে এমন কথাগুলোই উচ্চারিত হয়ে আসছিল; তবে এদের সবার মনে মনে। আর এখন, আরেক ক্রাইসিসে পড়ে মনের কথাটাই প্রকাশ্যে উচ্চারণে নিয়ে এসেছে শাহবাজ শরিফ, যিনি মাত্র দু’দিন হলো প্রধানমন্ত্রীর শপথ নিয়েছেন। শাহবাজ শরিফের নিজ বড় ভাই নওয়াজ শরিফ দুর্নীতির দায়ে ও বিচারে জেল-জরিমানায় ডুবে আছেন; সাথে রাজনীতিতে নিষিদ্ধ হয়ে গেছেন। তাই ছোট ভাই শাহবাজ এখন দল পিএমএল-এনের প্রধান নেতা। শাহবাজ নিজেও বর্তমানেই দুর্নীতি মামলার আসামি; তার মামলার চার্জ গঠনের শুনানি চলছে!
বিপরীতে, পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (ইনসাফের জন্য আন্দোলন) বা সংক্ষেপে পিটিআই দলের নেতা ইমরান খান। তার রাজনৈতিক জীবন ও দলের শুরু থেকেই- পাকিস্তান ভিক্ষুক ফলে আমেরিকান খেয়াল-অত্যাচার মেনে নাও- এই বয়ান ইমরান মানতে অস্বীকার করেন। বিশেষ করে ২০১৩ সালের নির্বাচনের আগে যে দলীয় মেনিফেস্টো প্রকাশ করেন তাতে সরাসরি আমেরিকান ‘ওয়ার অন টেরর’ পলিসিকে তিনি চ্যালেঞ্জ করেন এবং আমেরিকার এই নীতিতে পাকিস্তানের কত মানুষ বলি হয়ে গেছে আর কত কোটি টাকা অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে এ নিয়ে কিছু পরিসংখ্যান প্রচার করা শুরু করেছিলেন। গত ২০১৩ সালের পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে ইমরানের দল এই ‘নয়া বয়ানের’ ওপর দাঁড়িয়ে অংশ নিয়েছিল।
এভাবে একসময় ২০১৮ সালের নির্বাচন এসে যায়। ততদিনে ট্রাম্প আমলে আগের প্রতিশ্রুতি দেয়া আমেরিকান অর্থ সাহায্য পাকিস্তান সামরিক বাহিনীকে না দেয়া আর ট্রাম্প উল্টা ভারতের প্ররোচনায় টেররিজমের জন্য পাকিস্তান ও সেনাবাহিনীকে দায়ী করাতে এবার প্রথম ট্রাম্প প্রশাসনের সাথে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর দূরত্ব এক উল্লেখযোগ্য বিভেদ হিসেবে হাজির হয়েছিল। আর এ থেকে, এতদিনের পুরানা দুই রাজনৈতিক দলের কোনো একটা আর সাথে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও আমেরিকা- এই ত্রিপক্ষীয় যে শক্তি পাকিস্তানকে এতদিন ছিঁড়ে খেয়ে আসছিল, ‘ভিক্ষুক তত্ত্ব’ জারি রেখে আসছিল আর এই সুযোগে দুর্নীতিতে বান ডেকে এনেছিল- এই গোষ্ঠীতন্ত্রে এক ব্যাপক ভাঙন তৈরি হয়; অসংগঠিত হয়ে পড়ে তারা। এই ভাঙনকে কাজে লাগিয়ে, শক্তি-ভারসাম্যের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়েই ২০১৮ সালের নির্বাচনে ইমরান নিজ দলকে ক্ষমতাসীন করতে সমর্থ হন। ফলে কার্যত এই প্রথম ইমরান ‘ভিক্ষুক তত্ত্বকে’ চ্যালেঞ্জ করতে শুরু করেন। মানে, আমেরিকা ভিক্ষা-দাতা (পাকিস্তানে যা খুশি করার ভিক্ষাদাতা) আর পাকিস্তান গ্রহীতা-ভিক্ষুক; ফলে সব মেনে নেবে- এই সম্পর্ক মানতে অস্বীকার করে চলতে থাকেন।
অবশ্য কিছু দিনের মধ্যেই ট্রাম্প বুঝে যান যে, ইমরানের পাকিস্তানকে আমেরিকা নিজের স্বার্থেই দরকার। কারণ আফগানিস্তানে আমেরিকার তখন প্রতিদিন ৩০০ মিলিয়ন ডলার খরচ; এভাবে সম্পদ ড্রেনে ফেলা চলছিল যা বন্ধ ও ছাঁটাই করতে ট্রাম্প মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। তাই আবার তিনি ট্রাম্পের সাথে কাজের সম্পর্ক মানে আফগানিস্তান থেকে আমেরিকার সেনা প্রত্যাহারে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন।
অবশ্য কিছুদিনের মধ্যেই ট্রাম্প বুঝে যান, আফগানিস্তানে হস্তক্ষেপ ছেড়ে উঠে আসতে গেলে নিজ স্বার্থেই ওই ইমরানের পাকিস্তানকে আমেরিকা নিজেরই দরকার। কারণ আফগানিস্তানে তখন আমেরিকান প্রতিদিন ৩০০ মিলিয়ন ডলার খরচ হয়ে যাচ্ছে, এভাবে আমেরিকার সম্পদ ড্রেনে ফেলা তাকে বন্ধ করতে হবে। ফলে এই ড্রেনেজ বন্ধ করতে ট্রাম্প মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। তাই আবার ট্রাম্প পাকিস্তানের সাথে এক কাজের সম্পর্ক মানে আফগানিস্তান থেকে আমেরিকার সেনা প্রত্যাহারে পাকিস্তানের সাহায্য চাইতে এগিয়ে আসেন।
কিন্তু পুরান খাসলত অনুসারে ট্রাম্প ধরে নেন তারা ইমরানের পাকিস্তানকেও আগের মতো যেভাবে খুশি ব্যবহার করতে পারবেন। তাই তারা ইমরান সরকারকে প্রস্তাব দেন, ‘আফগানিস্তানে যে প্রাতিষ্ঠানিকতার ওপর ভর করে তারা আফগানিস্তানকে পরিচালনা করতেন এখন সেটার আদলে তেমন একটা সামরিক-বেজ তারা পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠা করতে চান। এই আবেদনে পাকিস্তান কোনো কিছু না দিলেও যেন আফগানিস্তানে ড্রোন হামলা করার একটা বেজ স্টেশন আমেরিকাকে করতে দেয়।’ কিন্তু ইমরান সব প্রস্তাবই নাকচ করে দেন।
এ নিয়ে এখন এক প্রেস ব্রিফিংয়ে পাকিস্তান সেনা-আইএসপিআরের ডিজি মেজর জেনারেল বাবর খামোখা অস্বীকার করতে চাইছেন যেটাকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ছেলেমানুষি ছাড়া আর কীই-বা বলা যায়! তারা ধরে নিয়েছে যে, লুকাতে চাইলেই তারা একালে ইন্টারনেটের যুগে সবকিছু লুকাতে পারবে। অথচ ২০২১ সালের মে মাসের শেষ সপ্তাহ আর পরে জুনের প্রথম সপ্তাহে- এই দুই সপ্তাহজুড়ে অনলাইন নিউজ খুললেই, এখনই সব বেরিয়ে পড়বে, কিছুই লুকানো যাবে না। এমনকি এ নিয়ে সিআইএ চিফের এক সিনেট শুনানিতে পাকিস্তানে তার গোপন ভিজিট ও আমেরিকা ড্রোনের জন্য পাকিস্তানে বেইজ স্টেশন পাচ্ছে না; এ নিয়ে দেয়া বক্তব্যও পাওয়া যাবে। অথচ ওই আইএসপিআরের ডিজি জেনারেল বাবর কী লুকাতে চাইলেন? তিনি দাবি করেছেন, আমেরিকা ঘাঁটি বানানোর প্রস্তাব নিয়ে আসেইনি।