সেকালের বিমান ভ্রমণ
সেকালের বিমান ভ্রমণ - প্রতীকী ছবি
মানবজীবন বৃহত্তম ভ্রমণের একটি অংশ। পবিত্র কুরআনুল কারিমের ১২ নং সূরার ১০৯ নং আয়াতে আত্মার একেকটি ধাপ অতিক্রমকে ভ্রমণের সাথে তুলনা করা হয়েছে। ভ্রমণের শুরু আত্মার আদি জগৎ থেকে। দ্বিতীয় ধাপ মানবজীবন। তৃতীয় ধাপ পরকাল- যার বিস্তার কিয়ামত পর্যন্ত। চতুর্থ ধাপ শুরু শেষ বিচার (হাশর) নিষ্পতির পর- ব্যাপ্তি অনন্তকাল। অনন্তকাল আর মানবজীবন সময়ের তুলনা, মরুভূমি আর বালুকণা। এই বালুকণার মতো কম সময়ের মধ্যেই পার হতে হয় ষড়রিপুর মোহময় ভুবন। ভুবনের সঙ্কীর্ণ সময়ে অনেকেই আটকে যায় ষড়রিপুর জালে।
ইসলাম বেশির ভাগ নেশাকে নিরুৎসাহিত করলেও ভ্রমণকে উৎসাহিত করে। এই উৎসাহটা আমার জীবনে কখন বাতিক হয়ে পড়েছিল টের পাইনি। ‘ভ্রমণ’ শব্দটি এখনো আমাকে রোমাঞ্চিত করে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ছোট করে দিচ্ছে বিশ্বকে। দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে বিমানের ধরন চলনও। ১০ এপ্রিল ২০২২ টার্কিশ বিমানযোগে ইস্তাম্বুল হয়ে লন্ডনের হিথ্রো। মনে হলো,
দাদা গেছেন পাঠশালাতে দিদির অগোচরে,
এক পলকে বাইরে এসে এ্যাপোলোতে যাই চড়ে,
প্যারিস থেকে পুতুল কিনে,
এক মিনিটে গেলাম চিনে,
তিন মিনিটে বিশ্ব ঘুরে ফিরে এলাম ঘরে।
কবিগুরু লন্ডন গিয়েছিলেন ১৭ বছর বয়সে। বাষ্পীয় ইঞ্জিনের যুগে। জাহাজে করে। চুলাচাক্কিসহ চাল ডাল সাথে নিয়ে। প্রায় দুই দশক আগে আমার প্রথম লন্ডন যাত্রা। উজবেকিস্তান এয়ারওয়েজে। ১০ এপ্রিল হিথ্রো বন্দরে পা রেখেই মনে পড়ে গেল দুই দশক আগের কথা। লন্ডন থেকে ফেরার পথে পানাহারবিহীন অবস্থায় শীতের দেশ তাসখন্দে স্টিলের চেয়ারে বসে ১৪ ঘণ্টার ট্রানজিট।
৯ ডিসেম্বর ২০০৩ সাল। সকাল ৯টা ২০ মিনিট। উজবেকিস্তান এয়ারওয়েজের বিমান। লন্ডনের উদ্দেশে আমরা ঢাকা জিয়া (বর্তমানে শাহজালাল) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ত্যাগ করি। আমরা মানে, আমি আর সালমা। বিমানটির আকার আয়তন বেশ বড় হলেও যাত্রী ছিল ২০ জন। ইচ্ছেমতো জানালার পাশে বসতে পেরেছি। বিমানটি প্রথমে তাসখন্দ যাবে, সেখান থেকে অন্য একটি বিমানে করে লন্ডন নিয়ে যাবে। বিমান ভূমিত্যাগের আগমুহূর্তে ঘোষিত হলো- ‘সম্মানিত যাত্রীগণ, আমাদের যাত্রা শুভ হোক, অনুগ্রহপূর্বক কোমরে সিটবেল্ট লাগিয়ে নিন। আমরা এখন দিল্লি যাচ্ছি, সময় লাগবে দুই ঘণ্টা ১৫ মিনিট। সেখানে এক ঘণ্টা বিরতির পর তাসখন্দ রওনা হবো।’
স্বাস্থ্যবান, ফর্সা ও দীর্ঘাঙ্গী উজবেক বিমানবালারা ট্রলিতে সাজিয়ে ফলের জুসসহ নানা রকম পানীয় বিতরণ শুরু করেছে। অরেঞ্জ জুস পান করতে করতে ভাবলাম, দিল্লি নামলে মন্দ কী? অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারে নতুন একটা স্থান বাড়বে। এরই মধ্যে এক ঘণ্টা জানালার ফাঁক দিয়ে দিল্লিটাও দেখা হয়ে যাবে। দিল্লিø থেকে শতাধিক যাত্রী বিমানে ওঠে। বেশির ভাগের লম্বা দাড়ি-গোঁফ মাথায় পাগড়ি। হাতের পরিহিত বালা দেখে বুঝতে পারলাম, শিখ সম্প্রদায়ের লোক। ঘণ্টাখানেক পরই তাসখন্দের উদ্দেশে বিমান দিল্লি ত্যাগ করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভারতের সীমানা পেরিয়ে পাকিস্তান। পাকিস্তান পেরিয়ে আফগানিস্তান সীমানায় পৌঁছতে না পৌঁছতেই দেখা যায় পাহাড় আর পাহাড়। পাহাড়ি এলাকায় কুয়াশা নেই। পরিষ্কার আকাশ। বিমানের ডিম্বাকৃতির জানালায় সুস্পষ্টভাবে অসংখ্য পাহাড় দেখতে পাই।
চট্টগ্রাম কিংবা সিলেট এলাকার পাহড়ের মতো এই পাহাড়গুলো মমতাময়ী বৃক্ষ আচ্ছাদিত নয় বরং ধূসর ও তামাটে বর্ণের-রুক্ষ প্রকৃতির। খাঁজকাটা পাহাড়গুলো খুব কাছেই মনে হচ্ছিল। কাবুলের উত্তরদিক দিয়ে উত্তর-পশ্চিমে যতই এগোচ্ছিলাম, পাহাড় ততই বাড়ছিল। মাঝে মাঝে উত্তর-দক্ষিণ লম্বালম্বি ঝরনার ওপর সূর্যালোক প্রতিফলিত হয়ে রূপালী আলোকরশ্মি চিকচিক করছিল। ঝরনার আশপাশে ছড়ানো ছিটানো হালকা ঘন সবুজ রঙ থেকে লোকালয়ের অস্তিত্ব অনুমান করা যায়। আমার মনে হয়, সবুজ রঙ মাখানো এলাকাগুলো ফসলি জমি নয়তো ফলের বাগান। কাবুলের ফলের কথা কে না জানে? রবীন্দ্রনাথের ‘কাবুলিওয়ালা’ তো এদেশেরই লোক ছিলেন। কী যে পালোয়ানি চেহারা কাবুলিওয়ালাদের। একদিকে উগ্র মৌলবাদ অপরদিকে উগ্র আধুনিকতা, এই দুইয়ের যাঁতাকলে কাবুলিওয়ালাদের রস বেরিয়ে একেবারে ছোবড়া হয়ে গেছে।
আমরা কাবুলের উত্তরে দুর্গম ও ভয়ঙ্কর তোড়াবোড়া পাহড়ের উপরে এসে পড়েছি। এ পাহাড়ে কেউ লুকিয়ে থাকলে হাজার বছরেও খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। কাবুলিওয়ালাদের নেতারা কি না এই পাহাড়েই আত্মগোপন করে আছেন। খুঁজে বের করা দুঃসাধ্য বিধায় হাজার পাউন্ড ওজনের শক্তিশালী বোমা ফাটিয়ে ও মাইন বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পাষাণ পাহাড় চূর্ণ-বিচূর্ণ করে চলছে। তোড়াবোড়া হারিয়ে ফেলেছে আদিম স্বভাব।
কোনো কোনো পাহড়ের চূড়া ধবধবে সাদা, মনে হয় বরফ জমে আছে। পাহাড়ের গায়ে খণ্ড খণ্ড জমাট বাঁধা মেঘ, আটকে থাকা কুয়াশা, বরফের টুপি পরা পাহাড়ের চূড়া, অন্ধকার গিরিখাদ, টুকরো টুকরো ফসলের জমি কিংবা ফলের বাগান এসবের বাঁকে বাঁকে আঁকাবাঁকা গিরিপথ, সব মিলিয়ে সৃষ্ট নৈসর্গিক অপরূপ দৃশ্য দেখে শরৎচন্দ্রের ভাষায় বলতে হয়- ‘বিধাতা এ চোখ দুটি যেমন দিয়েছ, আজ তুমিই তা সার্থক করলে।’
পাহাড়ি এলাকা কমতে শুরু করলেই লোকালয় শুরু। বাড়িঘর, নদী, ঝরনা ও রাস্তাঘাট ক্রমেই বাড়ছে। তাসখন্দ ঝরনার দেশ, প্রচুর ঝরনা আছে এ দেশে। লোকালয় বাড়ছে, কুয়াশাও বাড়ছে। আমার ধারণা, পাহাড়ি এলাকা থেকে জনবসতি এলাকায় তুলনামূলকভাবে কুয়াশা বেশি। তাসখন্দ বিমানবন্দরটি ছিল কুয়াশার চাদরে ঢাকা। বিমানের চাকা রানওয়ে স্পর্শ করতেই যাত্রীদের মধ্যে চঞ্চলতা দেখা দেয়। বিমানটি থামতেই যাত্রীরা তাড়াহুড়ো করে নামতে শুরু করে। বিমানের ২০-৩০ গজ দূরে দাঁড়িয়ে একটি বাস। সবাই বাসের দিকে ছুটছে। যাত্রীদের মধ্যে সম্ভবত আমরাই অনভিজ্ঞ। হাতে ভারী ব্যাগ ও বগলে মোটা শীতের কাপড়; তাড়াহুড়ো করে আমাদের পক্ষে নামা সম্ভব ছিল না। ব্যাগ টেনে-হিঁচড়ে যখন বাসে উঠি তখন বসার আসন পূর্ণ হয়ে গেছে। বাম হাতে ব্যাগের রশি আর ডান হাতে বাসের রড চেপে ধরলাম। তাসখন্দ বিমানবন্দরের সামনে এসে বাস থামতেই আবার তাড়াহুড়ো, কার আগে কে নামবে।
বিমান থেকে বের হওয়ার পরপরই বুঝতে পারলাম, আমরা শীতপ্রধান দেশে পৌঁছে গেছি। আমির তৈমুর রোডে একটি প্রাচীন প্রাসাদ ঘষামাজা করে বিমানবন্দর বানানো হয়েছে। এ বাড়ির ভিন্ন ভিন্ন রুমে অস্থায়ী পার্টিশন দিয়ে ইমিগ্রেশন অফিসসহ বসানো হয়েছে স্ক্যানিং মেশিন ইত্যাদি। এখানে ব্রিটিশ ভিসাধারীদের সন্দেহের চোখে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ইমিগ্রেশন পার হওয়ার অনুমতি দেয়।
ঘণ্টা দুয়েক পর পুনরায় বাসে করে লন্ডনগামী যাত্রীদের বিমানে পৌঁছে দেয়া হয়। আমরা যখন লন্ডনের উদ্দশে তাসখন্দ ছাড়ি তখন দিনের আলো নিভু নিভু। বিমানের বাইরে জানালা দিয়ে বৈদ্যুতিক আলোর ঝলকানি ছাড়া তেমন কিছুই চোখে পড়ছিল না। দুপুরের খাবার আগের বিমানে দেয়া হয়েছিল। এবার পাক্কা সোয়া সাত ঘণ্টা বিমানে কাটাতে হবে। বিমানের টিভিতে হিন্দি ছবি শুরু হয়েছে। কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারছিলাম না। মনে আশঙ্কা জাগল, সোয়া সাত ঘণ্টার শুরুতেই এই দশা! সিদ্ধান্তহীনভাবে এক ঘণ্টা পার হয়ে গেল। বামপাশে নাক ডাকার শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখি, সালমা কাত হয়ে ঘুমুচ্ছে। আমি তার মতো একদিকে কাত হয়ে ঘুমানোর ব্যর্থ চেষ্টা করি। উপরের দেরাজ থেকে টেনে ব্যাগ বের করি। বুদ্ধি করে মানবজমিন ঈদ সংখ্যা ব্যাগে নিয়েছিলাম। ১৪টি উপন্যাস রয়েছে ঈদ সংখ্যায়। গল্পের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। তিন রাত পরও শেষ করা যাবে না। উপন্যাস পাঠে মনোযোগ দেয়ার ধৈর্য অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছি। গল্প পড়তে শুরু করি।
এয়ার হোস্টেসরা ট্রলিতে করে রাতের খাবার নিয়ে আসছে। সালমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে বললাম, ‘উঠো, রাতের খাবার খেয়ে নাও’। সিটের হাতলের সাথে বিশেষভাবে সংযুক্ত ‘ডিশ’। খাবার আসতে দেখলেই হাঁটুর উপর ডিশ মেলে ধরি। ডিশের ওপর রাতের খাবার দিয়ে যায়। ছিল একটি রাইসবক্স, জুস ক্যান, ওয়ান টাইম ইউজ পানির গ্লাস, টমেটো সস, সল্ট, সুগার, মরিচের গুঁড়ো, চেনা-অচেনা কয়েক প্রকার ফল, কার্ড প্যাকেট, ব্রেড, চিজ ও বাটার। হঁাঁটুতে রেখে এক বর্গফুট পরিমিত ডিশের ওপর এতগুলো খাদ্যসামগ্রী কোনো রকমে ঠাসাঠাসি করে রেখেছিলাম। বাম হাতে ছুরি চালিয়ে কাটাকুটি করে ডান হাতের কঁাঁটা চামচে গেঁথে গেঁথে খাবারগুলো ঠিকঠাক মতো মুখে ঢুকাতে পারছিলাম না। নিজের খাদ্যসামগ্রী সামাল দিতে দিতে বাম দিকে তাকিয়ে দেখি আমার বুদ্ধিমতী গিন্নি রাইসবক্স আর পানির গ্লাস ছাড়া বাকি সব খাবার হাতব্যাগে চালান করে দিয়ে দক্ষতার সাথে রাইসবক্স খুলে আরামসে ভোজনরত। তা দেখে মনে মনে, সাধে কি লোকে বলে, ‘নারীদের ষোলকলা বুদ্ধি’ আমার দুর্গতি দেখে, বুদ্ধি ব্যবসায়ীদের এই এক সমস্যা, ভালো মক্কেল পেলে নিজের বুদ্ধিও বিক্রি করে ফেলে।
Ñবলতে বলতে আমার ডিশ থেকে শুকনো ও প্যাকেটজাত খাবারগুলো ব্যাগে ঢুকাতে আরম্ভ করে।
Ñআরে, করো কী, করো কী? বিমানবালারা দেখলে কী বলবে?
Ñকী বলবে আবার! আমাদের খাবার আমরা হয়তো তুলে রাখব নয়তো যখন ইচ্ছে তখন খাব, তাতে কার কী?
লক্ষ করলাম, এবারই প্রথম নয়, আগের খাবারের বড় একটি অংশও ব্যাগে ঢুকে আছে। তা দেখে,
Ñতোমার এ নির্বুদ্ধিতার জন্য আমাকে অনেক সমস্যা পোহাতে হয়।
Ñআপনার পরিপক্ব বুদ্ধির জন্য আমাকে কম সমস্যা পোহাতে হয় না। (কঁাঁটা চামচে করে খাবার মুখে তুলতে তুলতে) আমাদের লাগেজ ঠিকমতো ফিরে পাবো তো?
Ñভুল হবে না। লাগেজের গায়ে ফোন নম্বরসহ লন্ডনের বাসার ঠিকানা লেখা আছে। লাগেজ মিস হলে নিজ খরচে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসবে।
Ñযে ভারী লাগেজ, আল্লাহ আল্লাহ করে হিথ্রো বিমানবন্দর পার হতে পারলেই হলো।
কিছুদিন যাবৎ লন্ডন থেকে টেলিফোনে বারবার অতিরিক্ত মালামাল নিতে নিষেধ করা হয়েছিল। হিথ্রো একটি বিশাল বিমানবন্দর, এখানে মিনিটে মিনিটে বিমান ওঠানামা করে, কয়েকটি জেটি ও কয়েক কিলোমিটার লম্বা লবি। মালামাল বেশি হলে বহন করতে সমস্যা হবে। তাছাড়া আমরা মুসলিম দেশের লোক। আমেরিকার টুইন টাওয়ার ধ্বংসের জন্য কিছু উগ্রপন্থী মুসলমানকে দায়ী করে পাশ্চাত্য জগৎ সমগ্র মুসলিম জাহানকে শত্রু মনে করে। পাসপোর্টে নামের আগে বা পরে ‘মোহাম্মদ’ পদবি থাকলে কিংবা টুপি মাথায় দাড়িওয়ালা দেখলে তাদের সন্দেহ বেড়ে যায়। সন্ধিগ্ধ চোখে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করে দেয়। লাগেজ খুলে মালামাল বের করে তল্লøাশি চালায়। আমদানি নিষিদ্ধ কোনো মালামাল পাওয়া গেলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলে দেয়।
আসার আগে জানতে পেরেছি, লন্ডনে প্রতি কেজি শিম ৩০০ টাকা, পটোল ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। জানার পর যাত্রাবাড়ী পাইকারি বাজার থেকে শিম প্রতি পাল্লা (পাঁচ কেজি) ৮০ টাকা, খেজুর গুড় ১২০ টাকা, লেবু প্রতি কুড়ি ৪০ টাকা, আর পটোল এক পাল্লা মাত্র ২৫ টাকা দিয়ে আনলাম। এরপরও ছিল অভয়দাস লেনের বিহারি মলের দোকান থেকে কচি গরুর গোশত, বনফুলের মিষ্টি, রূপায়ণের চানাচুর, সোনামুখী মুগ ডাল, কালিজিরা চাল, মেঘনার গলদা চিংড়ি, পলওয়েলের তৈরী পোশাক, বঙ্গবাজারের শীতবস্ত্র, কর্ণফুলী গার্ডেন সিটির থ্রি পিস ও কক্সবাজারের শুঁটকি; সব মিলিয়ে আমাদের মালামাল দাঁড়িয়েছিল ১০০ কেজির বেশি।
আমরা দু’জন হাতব্যাগসহ ৯০ কেজির বেশি মালামাল নিতে পারব না, টিকিটে উল্লেখ ছিল। ফলে মালামালগুলো একবার লাগেজে ভরি, ধরাধরি করে কাঁটায় তুলি, ওজন করি, আবার নামাই। এভাবে উঠানো নামানো করতে করতে রাত প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত বড় লাগেজে ৪০ কেজি ও হাতব্যাগে ১৫ কেজি করে মাল নিলাম। গায়ে দিতে বঙ্গবাজার থেকে সাত কেজি ওজনের ওভারকোটও নিয়েছিলাম। এরপরও এক কেজি ওজনের ম্যাগাজিন এবং হাতব্যাগসহ ২৫ কেজি আমাকে বহন করতে হবে। যা অননুমোদিত হওয়ায় শুভার্থীরা মাপজোখ করার সময় হাতব্যাগের কিছু ভারী মালামাল ওভারকোটের বিভিন্ন পকেটে রাখতে পরামর্শ দিয়েছিল। গায়ের ব্যবহৃত পরিচ্ছদ ও তদস্থিত মালামাল পরিমাপের আওতামুক্ত। এমতাবস্থায় বিমানে ওঠানামা করা, দৌড়াদৌড়ি করে বাসে সিট পাওয়া, পরীক্ষা-নিরীক্ষায় প্রস্তুত থাকা, কোমরে বাঁধা ব্যাগ থেকে চেইন খুলে টিকিট পাসপোর্ট বের করা- এ জাতীয় প্রাসঙ্গিক কার্যাদি করতে গিয়ে শীতের মধ্যেও মাথা থেকে ঘাম ঝরছিল।
আর মাত্র ৩০ মিনিট। আমরা ইংলিশ চ্যানেল পার হচ্ছি। ঘড়িতে রাত ২টা। শিহরণ লাগছে। আমরা লন্ডনের সীমানায় পৌঁছে গেছি। সালমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলি। আমরা দুজনই জানালায় চোখ রাখতে চাচ্ছি। বিমান থেকে দেখা রাতের লন্ডন। শুধু আলো আর আলো, সারি সারি আলো। লাখ লাখ আলো। আলোর মাচানের উপর দিয়ে আমরা এগোচ্ছি। দূরে বিপরীত দিকে আরেকটি বিমান একইভাবে আলোর মাচানের ওপর দিয়ে যেতে যেতে অদৃশ্য হয়ে গেল। আরো একটির একই অবস্থা হলো। অল্পক্ষণেই কয়েকটি বিমান আমাদের আশপাশ দিয়ে উড়ে যেতে দেখি। বিমান নিচে নামার সময় অন্যরকম ‘ঝিম’ শব্দ হয়। যার ফলে কানের পর্দায় প্রচণ্ড চাপ পড়ে। কানে তালা লেগে যায়। কানের তালালাগা থেকে বুঝতে পারছি, আমরা নিচে নামছি।
বিমানের চাকা রানওয়ে স্পর্শ করতেই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলি। বঙ্গবাজার থেকে আনা ওভারকোট আস্তে আস্তে গায়ে চড়াই। এতক্ষণ যে বস্তুটি (ওভারকোট) এত কষ্ট দিলো, এবার তার ফল পাওয়া শুরু হবে। প্রথমে হাতাকাটা গেঞ্জি, তার ওপর উলের ফুলহাতা গেঞ্জি, শার্ট, শার্টের ওপরে সোয়েটার, কালো কোট, কোটের ওপর ওভার কোট, মাথায় মাঙ্কিক্যাপ, সব মিলিয়ে নিজেকে ভাস্কো-দা-গামার মতো মনে হলো, নিজেকেই নিজে চিনতে পারছিলাম না। অনুরূপ পোশাকে আচ্ছাদিত হয়ে কাঁধে ১৫ কেজি ওজনের কাঁধব্যাগ ঝুলিয়ে আমরা একপা-দু’পা করে বিমান থেকে বের হচ্ছিলাম। এ ধরনের পোশাক গায়ে থাকলে হঁাঁটার স্টাইল কী ধরনের হয়, জানা না থাকায় হঁাঁটা-চলায় বারবার ছন্দপতন ঘটছিল। ইমিগ্রেশনের ভেতরে হঁাঁটা-চলায় ছন্দপতনটাই সন্দেহের কারণ। এসব ভাবতে ভাবতে, চলার স্টাইল ঠিক করতে করতে একেবারে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তার সামনে এসে পড়ি।
lmmi: Do you know English well.
Ans: I know Bengali well.
Immi: No Bengali. You try to answer in English.
Ans: Ok Ok.
Immi: What is the purpose of comming UK?
Ans: I have come to meet my son and to visit this country.
Immi: Ok, how long you stay here?
Ans: Upto December.
Immi: Will your son come to take you?
Ans: Yes, certainly
Immi: Ok Ok
বলেই একটি স্বস্তির হাসি দিয়ে ইশারায় বের হওয়ার পথ দেখিয়ে দেয়। ইমিগ্রেশন পার হয়ে লাগেজ ক্যারিয়ার থেকে লাগেজ সংগ্রহ করে বহির্গমন গেটের কাছে যেতেই হেনা, আসলাম, হাসান, সুজন দৌড়ে এসে আমাদের জড়িয়ে ধরে। কোলে তুলে নিই সাত বছর বয়সী আনিকা ও তিন বছরের অনিককে। আমাদের সামনেই মনির গাড়ির দিকে ইশারা করে গাড়ির দরজা মেলে ধরে।
লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক
E-mail : adv.zainulabedin@gmail.com