পাকিস্তানে বাঁক বদল
শাহবাজ শরিফ ও ইমরান খান - ছবি : সংগ্রহ
পাকিস্তানের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি দেশটির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে। দেশটিকে ইমরান সরকারের সময় গ্রে তালিকায় রাখা হয়। এর পাশাপাশি কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার কারণে আর আইএমএফ সহযোগিতা না করায় জটিল অর্থনৈতিক অবস্থা পার করেছে ইসলামাবাদ। শাহবাজ শরীফ নির্বাচিত হবার প্রথম দিনই সরকারি কর্মচারীদের বেতন ২৫ শতাংশ বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন। এই সরকারের সুরক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্র প্রভাবিত প্রতিষ্ঠান বিশ্বব্যাংক আইএমএফ আবার সহযোগিতার দ্বার খুলে দিতে পারে। কিন্তু নতুন সরকারে এমন সব রাজনীতিবিদ গুরুত্বপূর্ণ পদে বসছেন যাদের বিরুদ্ধে অতীতে সরকারি সম্পদ চুরি ও আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে।
কৌশলগত ডকট্রিন বিবেচনায় ক্ষমতার পরিবর্তনকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক বদল হিসাবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। যার ইঙ্গিত বাজওয়া ছাড়াও শাহবাজ শরীফ নিজেও দিয়েছেন। ইমরান খান বলেছেন, তিনি একটি মুসলিম ব্লক ও কৌশলগত স্বাধীনতার নীতি অনুসরণ করায় যুক্তরাষ্ট্রের ষড়যন্ত্রে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ইমরানকে ক্ষমতা থেকে বিদায় করার জন্য চিঠি দিয়েছে বলে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন তিনি। সঙ্গত কারণেই আশা করা যায় শাহবাজের পাঁচ মিশালী সরকার কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন অনুসরণ আর শক্তিধর মুসলিম দেশগুলো নিয়ে একটি স্বতন্ত্র বলয় তৈরির প্রচেষ্টা থেকে সরে আসতে পারে।
ইমরান খানের পতনের পর রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এ ঘটনার পেছনে অনেক কারণ খুঁজে পাবেন। বলা হতে পারে, ইমরান ক্ষমতায় আসার সময় নয়া পাকিস্তানের যে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন তা পূরণ করতে পারেননি। ইউক্রেনে হামলার দিন পুতিনের সাথে তিনি বৈঠকে মিলিত হয়ে ভুল করেছেন। তার বিরুদ্ধে সর্বদলীয় জোটের মেরুকরণ চলাকালে তিনি কিছুই করতে পারেননি। গভীর ক্ষমতা বলয়ের সাথে তার দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল। এমন আরো নানা কিছু। ইমরান খানের নিজের বক্তব্য হলো, আমেরিকান পৃষ্ঠপোষকতায় ঘটা উদ্যোগে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন। তার অপরাধ ছিল দু’টি- এক. তিনি বৈশ্বিকভাবে একটি ‘মুসলিম ব্লক’ তৈরি করতে চেয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত. তিনি পাকিস্তানের জন্য একটি স্বতন্ত্র বা স্বাধীন পররাষ্ট্র কৌশল অনুসরণ করতে চেয়েছিলেন। ইমরান খানের বক্তব্য অত্যন্ত গভীরভাবে তাৎপর্যমণ্ডিত।
সাধারণভাবে মনে করা হয় পাকিস্তানের গভীর ক্ষমতা বলয়ের মূল ভিত্তি হলো সামরিক প্রতিষ্ঠান। যতদূর জানা যায়, বর্তমান পরিবর্তন ঘটানোর সাথে সামরিক প্রতিষ্ঠান প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। তবে এ ব্যাপারে সেনাবাহিনীতে এক ধরনের দ্বিধাবিভক্তি ছিল। গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ব্যক্তিদের ইচ্ছানুযায়ী এ পরিবর্তন ঘটে। রাজনৈতিক হানাহানির পরিস্থিতিতে গভীর ক্ষমতা বলয়ে যে কোন বিভাজন অনেক সময় বিপদের কারণ ঘটাতে পারে। স্নায়ুযুদ্ধের সময় আমেরিকান বলয়ে থাকার কারণে পাকিস্তানের সেনা বাহিনী মার্কিন অস্ত্র ও প্রশিক্ষণের উপর নির্ভরশীল ছিল। ইমরান খান কৌশলগত স্বাধীনতার অংশ হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দূরত্ব তৈরি করতে চাইলে সামরিক স্বার্থের সাথে সরকারের টানাপড়েন তৈরি হয়। এর প্রভাব পড়ে ইমরানের ক্ষমতার মূল ভিত্তির উপর। এ ছাড়া তিনি সামরিক বাহিনীর শীর্ষ ব্যক্তিদের সাথে নিয়োগ পদোন্নতি ও অন্য কিছু নীতিগত বিষয়ে বিবাদে জড়িয়ে পড়েছিলেন বলেও ধারণা করা হয়। সব মিলিয়ে ইমরানের রাজনৈতিক সততা আর হেলথ কার্ড, গরীবের জন্য আবাসন, বিলিয়ন গাছে সবুজ পাকিস্তান প্রকল্প জনসমর্থনের ভিত্তি বাড়ালেও গভীর ক্ষমতা বলয়ে তার সমর্থনের শেকড় কেটে যেতে থাকে। এর সাথে ইউক্রেন যুদ্ধের পর আমেরিকার সর্বব্যাপী পদক্ষেপ ক্ষমতা থেকে ইমরানকে ছিটকে দিয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
বলা হচ্ছে, ইমরান খানের পদক্ষেপগুলো অতিবেশি চীন-রাশিয়ামুখি এবং ওয়াশিংটনের সাথে দূরত্ব সৃষ্টিকারী হওয়ায় তার বিরুদ্ধে সংসদীয় অভ্যুত্থানের ঘুটি সাজানো হয়েছে। কিন্তু চীন ইমরান খানের সরকারকে রক্ষার জন্য কোন দৃশ্যমান ভূমিকা রেখেছে এমনটি চোখে পড়েনি। পড়ে যাওয়া শক্তির সাথে চীন যে থাকে না সেটি সব সময় দেখা যায়। পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও সেটিই হয়েছে বলে মনে হয়। বেইজিংয়ের কর্তারা মনে করেছেন রাজনৈতিক শক্তি আসবে আর যাবে কিন্তু পাকিস্তানে স্থায়ী হলো সামরিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রক প্রভাব। তাদের সাথে বোঝাপড়া করে চীন সম্ভবত তার স্বার্থ নিশ্চিত করতে চাইছে।
তবে বেইজিংয়ের একই কৌশলে কাঠমুন্ডুর উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে। শ্রীলঙ্কার উপর প্রভাব হারানো কেবলই সময়ের ব্যাপার, মালদ্বীপের উপর চীনা প্রভাবও এখন আর নেই। বাংলাদেশও চীনা প্রভাব থেকে বিদায় নেবার প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে বলে মনে করা হয়। এখন সর্ব আবহাওয়ার বন্ধু দেশ পাকিস্তানের সাথে চীনের সম্পর্কের অবস্থা কি দাঁড়ায় সেটি দেখার বিষয়। তবে আমেরিকার সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধির অনিবার্য পরিণতি হবে চীনের সাথে বন্ধুত্বে কিছুটা হলেও ভাটা পড়া।
পাকিস্তানের জন্য এই পরিস্থিতি স্নায়ুযুদ্ধের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার সাথে তুলনীয় হতে পারে। এই পরিস্থিতিতে চীনের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে আমেরিকান বলয়ে যাবে পাকিস্তান। পাকিস্তানের সামরিক প্রতিষ্ঠান হয়তোবা উপলব্ধি করতে পেরেছে ইমরান খানের সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় কৌশলগত এই পরিবর্তন সম্ভব হবে না। এর ফলে সংসদীয় অভ্যুত্থান প্রচেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্রে কলকাঠি নাড়ার এই প্রক্রিয়ায় সামরিক প্রতিষ্ঠানের সক্রিয় নিষ্ক্রিয় সমর্থন ছিল বলে ধারণা করা হয়। আর এই কারণে ইমরান খান সংসদ ভেঙে দেয়া, জরুরি অবস্থা জারির চিন্তা বাস্তবায়িত করতে পারেননি শেষ পর্যন্ত। ইমরানের চূড়ান্ত বিদায়ের আগে একাধিকবার সামরিক এস্টাবলিশমেন্টের সাথে তার বৈঠকের কথা জানা যায়। এই ধরনের সঙ্কট সময়ে ইমরান খান জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন ইসলামী দলের সহায়তা পেতে পারতেন। কিন্তু এসব দলকে সংসদের যথাসম্ভব বাইরে রাখতে বিগত নির্বাচনে গভীর ক্ষমতা বলয়ের প্রভাবশালীদের সাথে তিনি একসাথে কাজ করেন। এর ফলে জামায়াতে ইসলামীর আমির মওলানা সিরাজুল হকসহ বিভিন্ন ইসলামী দলের শীর্ষ নেতারা সংসদ থেকে ছিটকে পড়েন। আর মওলানা ফজলুর রহমান ইমরানের পতন ঘটানোর জন্য শুরু থেকে অন্য বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে এক মঞ্চে আনতে ভূমিকা রেখেছেন। জামায়াত সর্বশেষ রাজনৈতিক সঙ্কটে কোনো পক্ষে না গিয়ে নীরব ভূমিকা রেখেছে। অথচ জামায়াতের সাথে কোয়ালিশন করে খায়বার পাখতুন খোয়ায় সফল সরকার পরিচালনার ওপর ভিত্তি করে ইমরান খান পরেরবার ব্যাপক বিজয় অর্জন করতে সক্ষম হন। এসব কারণে শেষ দিকে ইমরান খান রাজনৈতিকভাবে অনেকটা একা হয়ে পড়েন।