পাকিস্তানের গণতন্ত্র
ইমরান বাজওয়া ও শাহবাজ - প্রতীকী ছবি
পাকিস্তানের পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটে হেরে প্রধানমন্ত্রীর পদ হারিয়েছেন ইমরান খান। শনিবার সারা দিন বহু নাটকীয়তার পর পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ জাতীয় পরিষদে রাত ২টার দিকে অনাস্থা ভোট অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দফায় দফায় মুলতবি হয়। ভোটাভুটিতে জাতীয় পরিষদের ৩৪২ সদস্যের মধ্যে ১৭৪ জন সদস্য ইমরানের নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করে ভোট দেন। ১৭২টি ভোট হলেই অনাস্থা প্রস্তাব পাস হওয়ার কথা। সেখানে আরো দুটি ভোট বেশি পড়েছে। অর্থাৎ ইমরান খানের সরকার তিনটি ভোটে হেরে যান। এর মাধ্যমে নন্দিত ক্রিকেটার ইমরান খানের তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) পার্টির শাসনামল আপাতত শেষ হলো।
বিরোধী জোট আগেই শাহবাজ শরিফকে সর্বসম্মতভাবে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করে। শাহবাজ পাকিস্তান মুসলিম লীগ (নওয়াজ) নেতা এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের ভাই। পাকিস্তানের রাজনীতিতে তাকে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসাবে মনে করা হয়। ইতোপূর্বে তিনি তিন তিনবার পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। একজন মার্জিত, দূরদর্শী এবং বিনয়ী রাজনীতিক হিসেবে তার সুনাম রয়েছে। তার ভাই নওয়াজ শরিফ গরম মেজাজী হলেও তিনি ভাইয়ের চেয়ে ঠাণ্ডা মেজাজী হিসেবে পরিচিত। তাছাড়া পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথেও তার রয়েছে সুসম্পর্ক। অনাস্থা প্রস্তাবের ওপর ভোটাভুটির পর জাতীয় পরিষদে দেয়া বক্তব্যে শাহবাজ শরিফ বলেন, ‘নতুন সরকার প্রতিহিংসাপ্রবণ হবে না। আমি অতীতের তিক্ততায় ফিরে যেতে চাই না। আমরা অতীত ভুলে যেতে চাই এবং সামনে এগিয়ে যেতে চাই। প্রতিশোধ নেব না, অবিচার করব না।’ এর পরই তিনি একটি টুইট করেন। টুইটে শাহবাজ শরিফ লিখেন, ‘পাকিস্তান এবং পাকিস্তানের পার্লামেন্ট অবশেষে গভীর সঙ্কট থেকে মুক্তি পেল। পাকিস্তানে নতুন প্রভাতের লগ্নকে অভিনন্দন।’
শাহবাজ শরিফের নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোটের নতুন সরকার দেড় বছর ক্ষমতায় থাকবেন। বর্তমান সংসদের মেয়াদ আছে আরো দেড় বছর। সব ঠিক থাকলে অক্টোবর ২০২৩-এ পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন হওয়ার কথা।
পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটের আগে ইমরান খান বলেন, তিনি বিরোধী জোটের সরকারকে স্বীকৃতি দেবেন না। তার অভিযোগ আমেরিকার নেতৃত্বে ষড়যন্ত্র করে তাকে ক্ষমতা থেকে সরানো হয়েছে। এর আগে জাতির উদ্দেশে একাধিক ভাষণেও তিনি একই অভিযোগ করেন। যদিও এর পক্ষে কোনো তথ্য-প্রমাণ তিনি দিতে পারেননি। শনিবার দিবাগত রাত ২টায় পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোট শুরুর কয়েক মিনিট আগে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পিকার, ইমরান খানের ঘনিষ্ঠ, আসাদ কায়সার পদত্যাগ করেন। পিটিআই সদস্যরা সংসদ ভবন ত্যাগ করে চলে যান এবং জোর দিয়ে বলতে থাকেন যে, ইমরান খান আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন। স্পিকারের পদত্যাগের পরিপ্রেক্ষিতে মুসলিম লীগ পিএমএলএন-এর আইয়ায় সাদিক ভোটাভুটি পরিচালনা করেন পার্লামেন্টের অধিবেশনের সভাপতি হিসেবে।
গণতন্ত্রের অনুপম চর্চা
পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলো কিংবা সরকারের মধ্যে কোনো সঙ্কট দেখা দিলেই ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমে প্রচার হতে দেখা যায়, পাকিস্তান সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করতে যাচ্ছে। এবারও পাকিস্তানের রাজনৈতিক সঙ্কট শুরু হওয়ার পর থেকেই আমরা লক্ষ্য করেছি ভারতীয় মিডিয়ার ইঙ্গিত বা আঙুল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দিকে। কিন্তু গত কয়েক দিন পাকিস্তানের ঘটনাবলীর দিকে নজর রাখলে কিংবা ঘটনা বিশ্লেষণ করে আমরা দেখতে পাই সেখানে গণতন্ত্রের এক অনুপম চর্চা হয়েছে। সংসদের কিংবা সংসদীয় রেওয়াজগুলো পালিত হয়েছে। সংসদীয় পদ্ধতিতে সরকার কিংবা বিরোধী দল যা করার তাই করেছে। আবার আইনের দৃষ্টিতে তৎপরতাগুলো খতিয়ে দেখা হয়েছে এবং প্রয়োজনীয় সংশোধন হয়েছে।
পাকিস্তানের ২২তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইমরান খান ক্ষমতায় এসেছিলেন ২০১৮ সালের জুলাইয়ে নির্বাচনের মাধ্যমে। তখন ভারতীয় মিডিয়ায় খবর প্রচারিত হয় যে, ইমরান খানের বিজয়ের পথ তৈরি করে দেয় দেশটির সেনাবাহিনী। এবার যখন তার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব উঠল তখনও তাদের প্রচার সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিরোধে ইমরানের কপাল পুড়তে যাচ্ছে। সেনাবাহিনী ক্ষমতায় আসছে। আমরা দেখলাম অর্থনৈতিক সঙ্কট এবং কূটনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যর্থতার কারণে বিরোধী দলগুলো ইমরান খানের বিরুদ্ধে পার্লামেন্টে অনাস্থা প্রস্তাব আনে। ক্ষমতাসীন জোটের বড় অংশ এমকিউএম ইমরান খানের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাখ্যান করে কিংবা তাকে ছেড়ে বিরোধী জোটে যোগ দেয়। ফলে ইমরানের সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন হারায়। এ পরিস্থিতিতে অনাস্থা প্রস্তাবের ওপর আলোচনা শেষে ভোটাভুটি হওয়ার কথা। কিন্তু ভোটাভুটির আগেই ডেপুটি স্পিকার কাসেম সুরি অনাস্থা প্রস্তাবটি খারিজ করে দেন। তিনি রুল জারি করেন যে, এই অনাস্থা প্রস্তাব পাকিস্তানের সংবিধানের পঞ্চম অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করেছে। এই অনুচ্ছেদে রাষ্ট্র এবং সংবিধানের প্রতি আনুগত্যের কথা আছে।
এর পরই ইমরান খান পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়ার কথা ঘোষণা করেন এবং প্রেসিডেন্টকে পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়ার পরামর্শ দেন। সে মোতাবেক প্রেসিডেন্ট পার্লামেন্ট ভেঙে দেন এবং পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলেন। কিন্তু বিরোধীরা ডেপুটি স্পিকারের রুলিংকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টের শরণাপন্ন হয়। সুপ্রিম কোর্টও সুয়োমোটো রুল জারি করে ডেপুটি স্পিকারের সিদ্ধান্তটি সঠিক না ভুল হয়েছে তা খতিয়ে দেখতে শুনানির আয়োজন করে। এটা সুপ্রিম কোর্টের এখতিয়ারের মধ্যেই পড়ে।
এখানে ইমরান খান এক ধরনের রাজনীতি করতে চেয়েছেন, আবার বিরোধী দলগুলো পাল্টা রাজনীতি করেছেন। একজন ক্রিকেটার হিসেবে ইমরান খান শেষ ছক্কাটা মারতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেটি ছক্কা না হয়ে তিনি নিজেই ‘বোল্ড আউট’ হয়ে গেছেন এই যা। ইমরান খান নিজেও বুঝে যান যে, তিনি আর ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না। তাই তিনি পার্লামেন্ট বাতিল করে জনগণের সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে নির্বাচনে চলে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিরোধী দলগুলো ডেপুটি স্পিকারের রুলিং চ্যালেঞ্জ করে ফেলায় শেষ পর্যন্ত সেটা আর হয়নি। সুপ্রিম কোর্ট শুনানি করে রায় দেন যে, ডেপুটি স্পিকার কাসেম সুরির দেয়া রুলিং বিধিসম্মত হয়নি বা সংবিধানসম্মত হয়নি। অর্থাৎ অনাস্থা প্রস্তাব খারিজের বিষয়টি অবৈধ ঘোষণা করে সুপ্রিম কোর্ট। এর প্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট কর্তৃক বিলুপ্ত পার্লামেন্ট পুনর্বহাল হয়। সুপ্রিম কোর্ট শনিবার পার্লামেন্ট ডেকে অনাস্থা প্রস্তাবের ওপর ভোটাভুটি অনুষ্ঠানেরও আদেশ দেন। অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে পার্লামেন্টের অধিবেশন আবার শুরু হয়। সেখানে ইমরান খানের দল একটি শেষ চেষ্টা চালায়। তারা সময়ক্ষেপণের জন্য মন্ত্রীদের বক্তৃতা দীর্ঘ করতে থাকে। হয়তো তাদের মধ্যে এ চিন্তা ছিল যে, শেষ পর্যন্ত বিরোধী ২-৩ জন সদস্যকে টলানো বা ভাসানো যায় কিনা। সে চেষ্টাটাই ব্যর্থ হয়েছে। অর্থাৎ রাজনীতির খেলায় হেরে যান ইমরান খান।
এই যে এত তৎপরতা হলো আমরা কিন্তু পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে কোথাও দেখিনি। সেনাবাহিনীর কোনো কর্মকর্তাকে এ বিষয়ে টুঁ শব্দ করতেও দেখা যায়নি। বরং তাদের যে কাজ সেটা করতেই দেখা গেছে। এ সময়ে সেনাবাহিনীকে মিসাইল পরীক্ষা করতে দেখা গেছে। বৃহস্পতিবার আরব সাগরে সফলভাবে নিজস্ব ক্রুজ মিসাইলের পরীক্ষা সম্পন্ন করে পাকিস্তান। ‘বাবর-১’ নামের এই মিসাইল ৪৫০ কিলোমিটার কিংবা ২৮০ মাইল দূরে স্থলভাগ বা সাগরের যেকোনো লক্ষ্যবস্তুতে নিখুঁত নিশানায় আঘাত হানতে পারবে। মাল্টিটিউব মিসাইল নিক্ষেপকারী যান থেকে মিসাইলটি নিক্ষেপ করা হয়। মিসাইল পরীক্ষার এই অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনী প্রধানের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকেও অনুষ্ঠানে দেখা গেছে এবং ইমরান এ মিসাইল পরীক্ষায় সেনাবাহিনীর প্রশংসাও করেন।
তবে এটা ঠিক পাঞ্জাবে সুশাসন নিশ্চিত করতে ইমরান খানের ব্যর্থতায় সেনাবাহিনীর ক্ষোভ ছিল। সেনাপ্রধান জেনারেল কামার বাজওয়া ও গোয়েন্দা প্রধান (আইএসআই) লে. জেনারেল ফয়েজ হামিদের বিরোধের মধ্যে পড়ে যান ইমরান খান। জেনারেল ফয়েজ হামিদকে পছন্দ করতেন ইমরান। গোয়েন্দা প্রধান হিসেবে তাকে রেখে দেয়ার ইচ্ছা তার ছিল। কিন্তু সেনাপ্রধান বাজওয়া তা চাননি। শেষ পর্যন্ত বাজওয়ার সিদ্ধান্তকেই মানতে হয় প্রধানমন্ত্রী ইমরানকে। এ ধরনের পছন্দ অপছন্দ সরকারে থাকেই। এ জন্য সেনাবাহিনী সরকার ফেলে দিয়ে অন্য সরকার ক্ষমতাসীন করবে তা কতটা সঠিক, যুক্তিতে আসে না।
রোববার বিবিসি ও ইকোনমিক টাইমসের এক খবরে বলা হয়, শনিবার সন্ধ্যায় পাকিস্তান পার্লামেন্ট যখন ইফতারের বিরতিতে যায়, তখন প্রধানমন্ত্রী ভবনে হেলিকপ্টারে দু’জন অনাহূত ব্যক্তি আসেন। ধারণা করা হয় এদের একজন সেনাপ্রধান জেনারেল বাজওয়া। তাদের সঙ্গে ইমরানের খানের এক ঘণ্টা বৈঠক হয়। ইমরান খান সেনাপ্রধান বাজওয়াকে অপসারণ করতে চেয়েছিলেন বলে খবরে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি করেনি। তবে সেনাবাহিনীর মুখপাত্র এ ধরনের খবরকে ডাহা মিথ্যা উল্লেখ করে বলেছে, এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি।
নেপথ্যে কত কিছুই তো হয়। তবে এবার আমরা লক্ষ্য করেছি পাকিস্তান সেনাবাহিনী কিছুতে নাগ গলায়নি। যা করার রাজনীতিকরাই করেছেন। সুপ্রিম কোর্ট তার এখতিয়ার অনুযায়ী একটি সিদ্ধান্ত আইনসম্মতভাবে হয়েছে কিনা শুনানি করে রায় দিয়েছেন। এই রায় ইমরান খানের বিরুদ্ধে গেলেও তিনি তা মেনে নিয়েছেন এবং রায়ের প্রতি সম্মান দেখিয়েছেন।
পার্লামেন্টে অনাস্থা প্রস্তাব আনা একটি সংসদীয় রীতি। অনাস্থা প্রস্তাব মোকাবেলা করাও সংসদীয় রীতি। এই প্র্যাকটিসটাই সুন্দরভাবে হয়েছে পাকিস্তান পার্লামেন্টে। তেমনি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে প্রেসিডেন্ট পার্লামেন্ট বাতিল করার রীতিও সংবিধানসম্মত। এসব রীতি পালন করতে গিয়ে আইনের ব্যত্যয় হয়ে থাকলে সর্বোচ্চ আদালত হস্তক্ষেপ করে সেটাও আইনের শাসনকেই প্রতিফলিত করে। এ ক্ষেত্রে পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টকে আমরা দেখেছি তারা শুধু ডেপুটি স্পিকারের রুলিংটি সঠিক হয়েছে কিনা তাই খতিয়ে দেখেছেন। প্রধান বিচারপতি আগেই বলে দেন যে, রাষ্ট্রীয় নীতি কিংবা পররাষ্ট্র বিষয় নিয়ে তারা কিছু যাচাই করবেন না। গণতন্ত্রের জন্য এ ধরনের চর্চা সত্যিই সুন্দর। এমনই হওয়া উচিত।
পাকিস্তানের রাষ্ট্রব্যবস্থা গণতন্ত্র ও রাজনীতি কোনো পথে?
জন্মের ৭৫ বছরের মধ্যে পাকিস্তানের বেশির ভাগ সময়ই অবশ্য কেটেছে সামরিক শাসনে। ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের আগে পাকিস্তানে ছিল জেনারেল পারভেজ মোশাররফের সামরিক শাসনামল। ৯ বছর তার শাসনামল। এর আগে মাঝে মধ্যে দেশটি গণতন্ত্রের ছোঁয়া পেলেও সেই গণতন্ত্রের স্বাদ খুব একটা ভোগ করতে পারেনি। ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পাকিস্তানের সরকার, পার্লামেন্ট ও চারটি প্রাদেশিক সভা গঠিত হয়। তখন থেকেই বর্তমান গণতান্ত্রিক শাসনামলের শুরু। গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য হচ্ছে সরকার আসবে সরকার যাবে কিন্তু গণতন্ত্র অটুট থাকবে। সেই হিসেবে পাকিস্তানে বিগত ১৪ বছর ধরে বলা যায় সুন্দরভাবেই গণতন্ত্রের চর্চা চলছে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই সরকার আসছে, যাচ্ছে। সেনাবাহিনীর সমর্থন নিয়ে কে এলো না এলো রাজনৈতিক অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ থাকবেই। পাঁচ বছর পরপর নির্বাচন হচ্ছে, সরকার ও বিরোধী দলের সব রাজনৈতিক দল নির্বাচনের ফল মেনে নিচ্ছে। কেউ সরকারে বসছে, কেউ বিরোধী দলে বসছে। পার্লামেন্ট সচল থাকছে। জাতীয় ইস্যুগুলো পার্লামেন্টে আলোচনা হচ্ছে। এই চর্চাটা তো পাকিস্তানে দেখা যাচ্ছে।
২০১০ সালে এ লেখকের নেতৃত্বে একটি উচ্চ পর্যায়ের সাংবাদিক প্রতিনিধি দল পাকিস্তান সফর করে। প্রতিনিধি দল পাকিস্তানের রাজনীতিক, ‘থিংক ট্যাংক’, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব এবং বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করে। তখনকার সময়টি ছিল খুবই ‘স্পর্শকাতর’ এবং অস্থির। কারণ পাকিস্তানে ওসামা বিন লাদেনকে আমেরিকার বিশেষ কমান্ডো বাহিনী হত্যা করেছে। পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘিত হয়েছে। এ নিয়ে রাজনীতিতে ছিল তোলপাড়। নতুন গণতন্ত্র আসার আড়াই বছর মাত্র পার হয়েছে। অনেকেরই ধারণা ছিল যে, সেনাবাহিনী আবার ক্ষমতা গ্রহণ করবে।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে সেই সঙ্কট পাকিস্তানের রাজনীতিকরা প্রজ্ঞা দিয়েই উত্তরণ ঘটিয়েছেন। পাকিস্তানের রাজরীতিকদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির ভয়াবহ অভিযোগ আছে। পিপলস পার্টির সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারির বিরুদ্ধে তো দুর্নীতির ভয়াবহ অভিযোগ ছিল। তেমনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে তো দুর্নীতির জন্য রাজনীতিতে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। তা সত্ত্বেও রাজনীতি এবং গণতন্ত্র বলা যায় সুন্দরভাগেই এগিয়ে যাচ্ছে।
পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব লেজিসলেটিভ ডিপার্টমেন্ট অ্যান্ড ট্রান্সপারেন্সি (পিলডাট) নামের একটি সংস্থা পাকিস্তানের গণতন্ত্র কতটা কাজ করছে তা নিয়ে মাঝে মধ্যে জরিপ চালায়। তাদের মূল্যায়ন হচ্ছে পাকিস্তানে গণতন্ত্র এখনো পুরোপুরি মজবুত না হলেও গণতান্ত্রিক ইনস্টিটিউশনগুলো শক্তিশালী হচ্ছে। বিচার বিভাগ পাকিস্তানে খুবই শক্তিশালী এবং স্বাধীন। তেমনি গণমাধ্যমও স্বাধীনভাবে কাজ করছে। সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থার হস্তক্ষেপও আগের মতো এতটা দেখা যাচ্ছে না। পিলডাটের এ মূল্যায়ন পাকিস্তানের জন্য আশা জাগানিয়া খবর ।
বিরোধী বেঞ্চে ইমরান খান
ইমরান খান পাকিস্তানের একজন ক্যারিশমেটিক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। সবারই আশা ছিল তিনি হয়তো পুরো মেয়াদই অর্থাৎ পাঁচ বছর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী থাকবেন। কিন্তু মেয়াদ পূর্ণ করতে পারলেন না। এর আগে বেনজির ভুট্টো, নওয়াজ শরিফ, গিলানি কেউই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি।
২০১৮ সালে ইমরান খান যখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন, তখন মনে হয়েছিল সব কিছু তার পক্ষেই কাজ করছে। ক্রিকেটের একজন বিশ্বনন্দিত তারকা হিসেবে রাজনীতিতে আসার পর সবার দৃষ্টিতে এসেছিল। এর আগে বেনজির ভুট্টো ক্যারিশম্যাটিক নেতা হিসেবে বিশ্বের দৃষ্টি কেড়েছিলেন। কিন্তু ভাগ্য ইমরানের প্রতি সুপ্রসন্ন ছিল না। তাই তাকে সাড়ে তিন বছরের মাথায় ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হলো। তার পিটিআই সরকারের পতন হলো। এ পতনের জন্য সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিরোধ বা টানাপড়েনের কথা বলা হলেও আসলে রাজনীতির খেলায় তিনি বড় হোঁচট খেয়েছেন। তার কতগুলো সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। এর মধ্যে পাঞ্জাব প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী উসমান বুজদারের মতো একজন রাজনৈতিক নবিসকে নিয়োগ দেয়া, খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়া, ডলারের বিপরীতে রুপির দাম কমা, কূটনৈতিক ব্যর্থতা বিশেষ করে তার সরকার পতনে ‘আমেরিকার চক্রান্ত’ কথা বারবার বলা ইত্যাদি বিষয়গুলো বিরোধী পক্ষ লুফে নেয়।
সব ঠিক থাকলে আগামী দেড় বছর ইমরান খানকে বিরোধী বেঞ্চেই বসতে হবে। পরবর্তী অক্টোবর ২০২৩ সালের নির্বাচনে নিজের জন্য কতটা সুফল তিনি আনতে পারবেন সেটা সময়ই বলতে পারে। এ জন্য তাকে ধৈর্যশীল হতে হবে এবং রাজনীতিতে পরিপক্বতা দেখাতে হবে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেস ক্লাব।
ই-মেইল : abdal62@gmail.com