ইমরানের প্রত্যাবর্তন ২০২৩ সালে!
ইমরান খান - ছবি : সংগ্রহ
জন্মের ৭৫ বছরের মধ্যে পাকিস্তানের বেশির ভাগ সময়ই অবশ্য কেটেছে সামরিক শাসনে। ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের আগে পাকিস্তানে ছিল জেনারেল পারভেজ মোশাররফের সামরিক শাসনামল। ৯ বছর তার শাসনামল। এর আগে মাঝে মধ্যে দেশটি গণতন্ত্রের ছোঁয়া পেলেও সেই গণতন্ত্রের স্বাদ খুব একটা ভোগ করতে পারেনি। ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পাকিস্তানের সরকার, পার্লামেন্ট ও চারটি প্রাদেশিক সভা গঠিত হয়। তখন থেকেই বর্তমান গণতান্ত্রিক শাসনামলের শুরু। গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য হচ্ছে সরকার আসবে সরকার যাবে কিন্তু গণতন্ত্র অটুট থাকবে। সেই হিসেবে পাকিস্তানে বিগত ১৪ বছর ধরে বলা যায় সুন্দরভাবেই গণতন্ত্রের চর্চা চলছে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই সরকার আসছে, যাচ্ছে। সেনাবাহিনীর সমর্থন নিয়ে কে এলো না এলো রাজনৈতিক অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ থাকবেই। পাঁচ বছর পরপর নির্বাচন হচ্ছে, সরকার ও বিরোধী দলের সব রাজনৈতিক দল নির্বাচনের ফল মেনে নিচ্ছে। কেউ সরকারে বসছে, কেউ বিরোধী দলে বসছে। পার্লামেন্ট সচল থাকছে। জাতীয় ইস্যুগুলো পার্লামেন্টে আলোচনা হচ্ছে। এই চর্চাটা তো পাকিস্তানে দেখা যাচ্ছে।
২০১০ সালে এ লেখকের নেতৃত্বে একটি উচ্চ পর্যায়ের সাংবাদিক প্রতিনিধি দল পাকিস্তান সফর করে। প্রতিনিধি দল পাকিস্তানের রাজনীতিক, ‘থিংক ট্যাংক’, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব এবং বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করে। তখনকার সময়টি ছিল খুবই ‘স্পর্শকাতর’ এবং অস্থির। কারণ পাকিস্তানে ওসামা বিন লাদেনকে আমেরিকার বিশেষ কমান্ডো বাহিনী হত্যা করেছে। পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘিত হয়েছে। এ নিয়ে রাজনীতিতে ছিল তোলপাড়। নতুন গণতন্ত্র আসার আড়াই বছর মাত্র পার হয়েছে। অনেকেরই ধারণা ছিল যে, সেনাবাহিনী আবার ক্ষমতা গ্রহণ করবে।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে সেই সঙ্কট পাকিস্তানের রাজনীতিকরা প্রজ্ঞা দিয়েই উত্তরণ ঘটিয়েছেন। পাকিস্তানের রাজরীতিকদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির ভয়াবহ অভিযোগ আছে। পিপলস পার্টির সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারির বিরুদ্ধে তো দুর্নীতির ভয়াবহ অভিযোগ ছিল। তেমনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে তো দুর্নীতির জন্য রাজনীতিতে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। তা সত্ত্বেও রাজনীতি এবং গণতন্ত্র বলা যায় সুন্দরভাগেই এগিয়ে যাচ্ছে।
পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব লেজিসলেটিভ ডিপার্টমেন্ট অ্যান্ড ট্রান্সপারেন্সি (পিলডাট) নামের একটি সংস্থা পাকিস্তানের গণতন্ত্র কতটা কাজ করছে তা নিয়ে মাঝে মধ্যে জরিপ চালায়। তাদের মূল্যায়ন হচ্ছে পাকিস্তানে গণতন্ত্র এখনো পুরোপুরি মজবুত না হলেও গণতান্ত্রিক ইনস্টিটিউশনগুলো শক্তিশালী হচ্ছে। বিচার বিভাগ পাকিস্তানে খুবই শক্তিশালী এবং স্বাধীন। তেমনি গণমাধ্যমও স্বাধীনভাবে কাজ করছে। সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থার হস্তক্ষেপও আগের মতো এতটা দেখা যাচ্ছে না। পিলডাটের এ মূল্যায়ন পাকিস্তানের জন্য আশা জাগানিয়া খবর ।
বিরোধী বেঞ্চে ইমরান খান
ইমরান খান পাকিস্তানের একজন ক্যারিশমেটিক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। সবারই আশা ছিল তিনি হয়তো পুরো মেয়াদই অর্থাৎ পাঁচ বছর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী থাকবেন। কিন্তু মেয়াদ পূর্ণ করতে পারলেন না। এর আগে বেনজির ভুট্টো, নওয়াজ শরিফ, গিলানি কেউই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি।
২০১৮ সালে ইমরান খান যখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন, তখন মনে হয়েছিল সব কিছু তার পক্ষেই কাজ করছে। ক্রিকেটের একজন বিশ্বনন্দিত তারকা হিসেবে রাজনীতিতে আসার পর সবার দৃষ্টিতে এসেছিল। এর আগে বেনজির ভুট্টো ক্যারিশম্যাটিক নেতা হিসেবে বিশ্বের দৃষ্টি কেড়েছিলেন। কিন্তু ভাগ্য ইমরানের প্রতি সুপ্রসন্ন ছিল না। তাই তাকে সাড়ে তিন বছরের মাথায় ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হলো। তার পিটিআই সরকারের পতন হলো। এ পতনের জন্য সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিরোধ বা টানাপড়েনের কথা বলা হলেও আসলে রাজনীতির খেলায় তিনি বড় হোঁচট খেয়েছেন। তার কতগুলো সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। এর মধ্যে পাঞ্জাব প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী উসমান বুজদারের মতো একজন রাজনৈতিক নবিসকে নিয়োগ দেয়া, খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়া, ডলারের বিপরীতে রুপির দাম কমা, কূটনৈতিক ব্যর্থতা বিশেষ করে তার সরকার পতনে ‘আমেরিকার চক্রান্ত’ কথা বারবার বলা ইত্যাদি বিষয়গুলো বিরোধী পক্ষ লুফে নেয়।
সব ঠিক থাকলে আগামী দেড় বছর ইমরান খানকে বিরোধী বেঞ্চেই বসতে হবে। পরবর্তী অক্টোবর ২০২৩ সালের নির্বাচনে নিজের জন্য কতটা সুফল তিনি আনতে পারবেন সেটা সময়ই বলতে পারে। এ জন্য তাকে ধৈর্যশীল হতে হবে এবং রাজনীতিতে পরিপক্বতা দেখাতে হবে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেস ক্লাব।
ই-মেইল : abdal62@gmail.com