ভারত কি অস্থির হয়ে পড়েছে?
মোদি - প্রতীকী ছবি
রাশিয়ার উপরে ভারতের সমরাস্ত্রে নির্ভরশীলতা, সেটা কমপক্ষে ৭০ শতাংশ। সম্প্রতি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকার এক রিপোর্ট এটাকে ৮৫ ভাগ বলেছে। তাই আমেরিকার রাশিয়ান অবরোধ আরোপের পরে সবচেয়ে বড় বিপদ গুনেছে ভারত। প্রধান কারণ, সত্যিই ভারতের সাথে কোথাও সাতদিন যুদ্ধ চললে এরপর ভারত রাশিয়ান সাপ্লাই বিশেষত ছোট-বড় অস্ত্র, গোলাবারুদ ও স্পেয়ার্স পাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে যাবে, এজন্য। এমন অবস্থার পিছনের কারণ দুটা। এক. রাশিয়ান অস্ত্র তুলনায় আমেরিকান যেকোনো অস্ত্রের চেয়ে সত্যিই দশগুণ সস্তা। একটা হেলিকপ্টার, এমন ন্যুনতম ভারি অস্ত্রের বেলাতেই এটা সত্য। দুই. রাশিয়া আসলে ভারতের কোল্ডওয়ার কালের মিত্র। ফলে রাশিয়ান অস্ত্র নির্ভর হয়েই সেকালে ভারত নিজের প্রতিরক্ষা সাজিয়েছিল। সুবিধা ছিল প্রধান শত্রু পাকিস্তান যেমন আমেরিকার সাথে গাঁটছাড়া বাঁধা। ফলে ভারতেরও রাশিয়ার সাথে বাধা পড়লে এটা দীর্ঘদিন একই সাপ্লায়ার হয়ে টিকে থাকার বা কাজ করার সম্ভাবনা। তাই এই নির্ভরশীলতার সম্পর্ক জেনেশুনেই তৈরি করা হয়েছিল। তবে এটাতে নড়াচড়া পড়েছিল ২০০১ সালে বুশের আমলে ওয়ার অন টেরর ইস্যুতে ভারত মিত্র হবার পর থেকে। অর্থাৎ কোল্ডওয়ার- উত্তরকালে সেই প্রথম বুশ ভারতকে নিষিদ্ধ পারমাণবিক কাঁচামাল ও টেক সরবরাহের লোভ দেখানোতে। সেখান থেকেই ক্রমশ এটা ২০০৬ সালে বুশের ভারত সফর হয়ে পরে চীন ঠেকানোর নাম করে ভারত-আমেরিকা সখ্যের গভীরতা শুরু। আর এতেই ভারতের এখন সবচেয়ে করুণ দশায়। বলা হচ্ছে বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্কর সবচেয়ে চিকন এক দড়ির ওপর দিয়ে হাঁটছেন।’ কেন এমন মনে করা?
একেবারে প্রধান শঙ্কা হলো, রাশিয়ান অস্ত্রের সাপ্লাই; কারণ রাশিয়ার ওপর বলতে গেলে আমেরিকার সব বন্ধু অবরোধ আরোপ করেছে। তাহলে ভারত রাশিয়ান স্পেয়ার্সের সাপ্লাই পাবে কী করে? অর্থ পরিশোধ করবে কী উপায়ে? আর এখান থেকেই আমেরিকান অবরোধ বাইপাস করে রুবলে রাশিয়ার সাথে পণ্য লেনদেনের ব্যবস্থা প্রথম চালু করে ভারত। স্বভাবতই এটাই বাইডেনের সবচেয়ে বড় না পছন্দ। এসব নিয়েই রিপোর্টে ভারতের মিডিয়া তোলপাড়। যদিও ইউক্রেন ইস্যু হাজির হবার আগে থেকেই ভারত বাইডেনের বিকল্প বা বাইডেনের ওপর পালটা চাপ তৈরির চেষ্টা করে আসছিল যাতে মুসলমান দলনের কারণে মোদির ওপর আমেরিকান মানবাধিকার চাপ ভারত এড়াতে পারে। কিন্তু রাশিয়ার ‘কোলে চলে যাবা’র তখন যে ভানটা ভারত তৈরি করেছিল সেটাই এখন একেবারেই সিরিয়াস হয়ে গেছে।
অবস্থা দেখে মনে হয় ভারতের মনের গহিনের অনুভব সম্ভবত এটাই যে, ভারত আমেরিকার সাথে সখ্য চাইলেও শেষে ভারত তা রক্ষা করতে পারবে না। রশিয়ার কাছে যেতেই হবে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে চীনের সাথে সম্পর্কটা কেমন হবে- এই হলো ভারতের দ্বিধা অস্পষ্টতার জায়গা। ফলে আমেরিকা চাপ দিলেই ভারত দিশেহারা বোধ করে। আর নিজ বিপুল জনসংখ্যার বাজারের লোভ দেখিয়ে সব ঠাণ্ডা করার চেষ্টা করে থাকে। কিন্তু এবার স্টেক সম্ভবত অনেক উঁচু! তাই কী হবে এই আশঙ্কা জয়শঙ্করেরও!
এসবের মধ্যেই ব্যাপক কূটনৈতিক দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়েছে। ভারতের এই রুবলে দেনদেন চালুর ব্যাপারে এর বিরুদ্ধে সবচেয়ে কঠোর হতে চান বাইডেন। সর্বশেষ এটা নিয়েই মূলত ওয়াশিংটনে দুদিন পরে ভারত-আমেরিকান বৈঠক, যার গালভরা নাম ‘২+২’। আর এখানেই রাশিয়ান এস-৪০০ কেনার শাস্তি হিসাবেও এক অবরোধ আরোপ পেন্ডিং পড়ে আছে। আর এখানে ২+২ এর মানে হলো, দুদেশেরই দুই পররাষ্ট্র ও দুই প্রতিরক্ষামন্ত্রীর একসাথে চারজনের বৈঠক। এর আগে চীনকে দেখাতে যে, ভারত যেন পরাশক্তি হয়ে গেছে- তা ভেবে এমন ২+২ বৈঠক নিয়ে মিডিয়ায় গর্ব ভরে উপচে উঠত আমরা দেখেছি। কিন্তু আর আজ সেসব ম্লান, সবাই রিয়েল প্রবলেমের সামনে পড়েছে। তাই যেন ভ্যানিটি উপাদানগুলো অনাদরে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
তবে এটাও ভুলে যাওয়া ভুল হবে যে, জয়শঙ্করের ‘খুব চিন্তায় আছি’ টাইপের ইমেজটা তৈরি করেছেন এর আরেক অর্থ ও উদ্দেশ্য আছে। তা হলো, ভারতের কেনাকাটার ওপর এসব আমেরিকান অবরোধে যেন সে ছাড় পায় সেজন্য আমেরিকার সামনে এক করুণ ইমেজ তৈরি করা। যদিও ভারত জানে, বাইডেনের এখানে ছাড় দিবার সুযোগ বা ইচ্ছা নেই। তবে জয়শঙ্করের আসল উদ্দেশ্য হলো ভারতে মোদির মুসলমান কোপানোতে এর ওপর কোনো মানবাধিকারের অবরোধ যেন আরোপিত না হয়।
তবে ভারতের দিক থেকে আরেক রিয়েল থ্রেটও আছে যেটা ভারতের ভাষায় চীনের সাথে তার সীমান্তবিরোধ। যেটা আর কিছুই না, কলোনি আমল থেকেই অচিহ্নিত হয়ে থাকা সীমানা। যদিও এ কথা মনে করার কারণ আছে, এটা মূলত উগ্র হিন্দুত্ব এমন জাতিবাদী কল্পনার শাসক মোদি হওয়ার কারণে। যে কারণে এই যে দেখার বা উপস্থাপনের চেষ্টা যে, মোদির হিন্দুত্ব জাতিবাদ সীমান্ত রক্ষায় সবচেয়ে দেশপ্রেমিক! কিন্তু আসলেই কি এই প্রদর্শন খুবই মূল্যবান? সীমান্ত দু-ইঞ্চি জায়গা ছাড় বা দখল পাওয়াটাকে হিন্দুত্বের জাতিবাদের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ হিসাবে তুলে ধরে ভোটের বাক্সে এর ফল ক্যাশ করার চেষ্টা- এই ফালতু জাতিবাদের আছে।
বরং ভারতের লম্বা ও দীর্ঘস্থায়ী অর্থনৈতিক স্বার্থের দিয়ে চেয়ে কথা বললে এই কথিত সীমান্তবিরোধ হত তুলনায় তুচ্ছ। আর আমেরিকা যদি ক্রমশ হেরে যাওয়া গ্লোবাল নেতা হয়ে থাকে আর চীন যদি সে জায়গা নিতে ক্রমশ উত্থিত নেতা হতে থাকে তাহলে বুড়া সিংহ আমেরিকার যে ন্যাচারালি মরণ হবে। কারণ এর আর ভারতকে ন্যুনতম বিনিয়োগ বা ঋণ দিবার মুরোদও নেই। তাই প্রতীকী অর্থে কদিন পরে মরবে- এর সাথে ভারতের গাঁটছড়া বাঁধার অর্থ কী? ভারতের বন্ধু তো হবার কথা ভারতের আগামীরা, তার অতীত নয়। এটা মানতে না পারার ক্ষেত্রে প্রধান বাধা আসলে মোদির উগ্র হিন্দুত্ব, এই চোখ দিয়ে দেখার সমস্যা।