বাইডেন কেন ইউরোপে হারলেন?
জো বাইডেন - প্রতীকী ছবি
কেন এমন হলো, বাইডেন ইউরোপে কেন হারলেন? এর সোজা জবাব হলো, বাইডেন তার চাপ দেওয়ার ক্ষমতা বাড়াবাড়িভাবে ব্যবহার করেছেন। কী সেটা? বাইডেন-ই এই ইউক্রেনের যুদ্ধকে অবরোধ আর মানবাধিকার এ দুই অস্ত্র দিয়ে লড়বার একক পরিকল্পক। তিনি নিজে রাশিয়ার ওপর এক গাদা সিরিজ অবরোধ আরোপ তো করেছেনই। সাথে ইউরোপকেও চাপ দিয়ে বাধ্য করেছেন একইভাবে অবরোধ দিতে। তাতে এবারই প্রথম ইউরোপ কোনো দেশের ওপর এমন বেপরোয়া হয়ে রেকর্ড পরিমাণ অগুণতি অবরোধ আরোপ করেছে। এ ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে অবিবেচক ও আত্মঘাতী কাজটাও তারা করে ফেলেছে, জাস্ট বাইডেনকে খুশি করতে হবে এই বিবেচনায়। যেন না জানি, তাদের দ্বিধাদ্বন্দ্ব দেখে না আবার বাইডেন মহাশয় ইউরোপের ওপর অসন্তুষ্ট ও ‘সংহতিতে’ নেই মনে করেন কিনা- যেন এই ছিল ইউরোপের ভয়। কিন্তু ইউরোপেরও কপাল খারাপ, যেখানে বাঘের ভয় ঠিক সেখানেই যেন গাড়ি খারাপ হওয়ার দশা!
বাইডেনের চাপে তারা খেয়ালই করেননি যে, রাশিয়ার ওপর দিয়ে তাদের ইউরো মুদ্রার অবরোধের অর্থ আসলে কার্যত ইউরোপের নিজের ওপরই অবরোধ দেয়া হয়েছে। কেন?
এটা শুনতে অনেকের মজা লাগতে পারে যে, ইউরো মুদ্রা এখন মহাক্ষমতা ধর হয়ে গেছে যে, সে রাশিয়ার উপর অবরোধ আরোপ করে তাকে কুপোকাত করে দিতে পারে। তাহলে নিশ্চয় ইউরোপের অর্থনীতি অনেক ক্ষমতাবান হয়ে উঠেছে! তাই কি? একটু দাঁড়ান, ধীরে চলেন প্লিজ! কেন?
ইউরো অবরোধের সোজা মানে হলো, আপনি রাশিয়া এখন থেকে আর আমার ইউরো মুদ্রায় কোনো পণ্য আর বেচা এবং কেনা কোনোটাই করতে পারবেন না। অর্থাৎ ইউরো যাদের মুদ্রা এই ইউরো জোনের বাইরের রাশিয়াসহ সব দেশ তো বটেই এমনকি জোনের ভিতরের সদস্য যেমন জার্মানি সেও রাশিয়ার কাছ থেকে ইউরোতে গ্যাস কিনতে পারবে না। যেখানে জার্মান অর্থনীতি (চাহিদা ওঠানামা আছে বলে), ৪০-৫৫% রাশিয়ান গ্যাসের ওপর জার্মানি নির্ভরশীল। অর্থাৎ জার্মানিও রাশিয়ান গ্যাস আমদানি করতে পারবে না। কেন?
অবরোধের শুরুতে একটা ফাঁকি দিয়েছিল জার্মানির মতো ইউরোপ। তারা কার্যত রাশিয়ান গ্যাস কেনার ওপর অবরোধ অকার্যকর করে রেখেছিল। ভেবেছিল, এভাবে রাশিয়ার ওপর ইউরো অবরোধ দিয়েও এভাবে রাশিয়ান গ্যাস তারা কিনে-চলতে পারবে। কিন্তু না!
খোদ পুতিন এতে পানি ঢেলে দিয়েছেন। পুতিন ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, যারা আর বন্ধুসুলভ দেশ নয় (মানে যারা রাশিয়ার ওপর অবরোধ দিয়েছে) তারা এখন থেকে রাশিয়ান কোনো কিছু কিনতে চাইলে রাশিয়ার নিজের মুদ্রা রুবলে এর মুল্য পরিশোধ করবে। আর এতেই মহাবিপদে পড়ে গেছে ইউরোপ; বিশেষত যারা রাশিয়ান গ্যাসের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। তাৎক্ষণিক জ্বালানি রেশনিং শুরু করতে হয়েছে তাদের। কারণ, ইউরোপে বসবাসে নিজ বাস করার ঘর গরম রাখার কোনো ব্যবস্থা না থাকলে সেই ইউরোপ বসবাসের অযোগ্য হয়ে যায়। আপনি গরিব-বড়লোক যাই হন। আর এই সমস্যা মোকাবেলার সবচেয়ে প্রচলিত উপায় হলো, বিপুল জ্বালানি ব্যবহার করে মিউনিসিপাটির গরম পানির প্রবাহ। প্রত্যেকটা বাসার প্রত্যেক বসবাসের রুমের ভিতরের দেয়াল বেষ্টন করে থাকে এই গরম পানির লাইন। আর তাতেই রুম বসবাসযোগ্য থাকে। তাই গ্যাস ইউরোপের জীবনযাপনে খুবই এসেনশিয়াল। তাহলে, এর মানে দাঁড়িয়েছে যারা রাশিয়ার ওপর অবরোধ আরোপ করে নিজেরা পরাশক্তির ভান ও সুখবোধ করছিল আজ সেই ইউরোপ নিজেরাই নিজেদের অস্ত্রের মুখে কাঁপছে- নাকি হয়তো ঠাণ্ডায় কাঁপছে, সব একই কথা হয়ে গেছে! মানে নিজ অবরোধ নিজেরই বিরুদ্ধে চলে গেছে।
অনেকের মনে হতে পারে, রুবলে মূল্য পরিশোধের কথা বলা পুতিনের প্রতিহিংসা। আমেরিকা ইউরোপে প্রপাগান্ডায় পুতিনের যে ছবি এঁকে দিয়েছেন তাতে বেশির ভাগ মানুষ এটাই বিশ্বাস করবে হয়তো। কিন্তু না এটা ফ্যাক্ট নয়। কেন?
ইউরোপ ভাবতে পারে যে, রাশিয়ান গ্যাস কেনাবেচার ওপর তাদের অবরোধ প্রযোজ্য নয়, এই বিশেষ ছাড় দিয়ে তারা তো পুতিনকেই ফেবার করছিল। এই অনুমানটা ভুল। কারণ, রাশিয়ান গ্যাসের বিনিময়ে ইউরোপ পুতিনের হাতে ইউরো ধরিয়ে দিচ্ছিল বটে কিন্তু এসব ইউরো অচল। না, এটা অচল পয়সা বা ফেক নোট গছিয়ে দেয়া নয়। আসল ইউরো তারা দিলেও তা রাশিয়ার কাছে অচল নোটের মতোনই ঠেকেছিল। কেন? কারণ, রাশিয়া ওই ইউরোতে নিজের কোনো কিছু কেনার বেলায় দাম পরিশোধের মুদ্রা হিসাবে তা ব্যবহার করতে পারে না। মূলত ইউরোপ তো রাশিয়ার ওপর ইউরো ব্যবহার করে কিছু কেনার ক্ষেত্রেও অবরোধ দিয়ে রেখেছে। অর্থাৎ যেন হাতে একশ টাকার নোট আছে ঠিকই কিন্তু দোকানদার ওই নোট নিতে চাচ্ছে না। সোজা কথায়, রাশিয়ার হাতে পড়লেই ইউরো অচল নোট হয়ে যাবে। তাই ইউরো নিয়ে রাশিয়ার কাউকে গ্যাস বিক্রি করার মানে হলো তাকে মাগনা গ্যাস দেয়া হয়েছে। কারণ রাশিয়ার হাতে থাকা ইউরো বাজারে কেউ নেবে না। এ কারণেই ইউরোপসহ সবাইকে রুবলে দাম শোধ করে পণ্য কিনতে বলা- আর এটা পুতিনের কোনো প্রতিহিংসা নয়। এটা আসলে ইউরোপের ইউরো অবরোধের-ই স্ববিরোধিতা। তারা খেয়ালই করেনি যে, রাশিয়ান গ্যাস বিক্রির ওপর অবরোধ আরোপে ছাড় থাকলেও তাতে রাশিয়ার কোনো লাভই নেই; কারণ তা রাশিয়ার যেকোনো কেনাবেচার উপরেও কোনো ছাড় বলে বিবেচিত হবে না। হওয়ার সুযোগই নেই।