রোজা যেভাবে হৃদপিণ্ডকে সুস্থ রাখে
রোজা যেভাবে হৃদপিণ্ডকে সুস্থ রাখে - প্রতীকী ছবি
রমজানের রোজার আসল উদ্দেশ্য তাকওয়া অর্জন করা। মহান আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।’ (সূরা আল বাকারা-১৮৩) অর্থাৎ তাকওয়া বা সত্যিকার পরহেজগারি অর্জন হচ্ছে এ মাসের প্রধান লক্ষ্য।
তাকওয়া অর্জন ছাড়াও আমাদের শরীর ও মনের ওপর রমজানের অনেক উপকারিতা রয়েছে। হার্টের বা হৃৎপিণ্ডের রোগীও এর ব্যতিক্রম নয়। হৃৎপিণ্ডের কয়েক ধরনের রোগ আছে। তার মধ্যে হৃৎপিণ্ডের রক্তনালীর রোগ সবচেয়ে গুরুত্বপূণর্; যে কারণে হার্ট অ্যাটাক হয়ে বিভিন্ন দেশে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ মৃত্যুবরণ করে থাকে। রক্তে অতিরিক্ত চর্বি, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ধূমপান ইত্যাদি কারণে প্রধানত হার্ট অ্যাটাক হয়ে থাকে। রমজান মাসে ধূমপানের মাত্রা অনেক কমে যায় এবং কারো কারো পক্ষে পরবর্তী মাসগুলোতে ধূমপান একেবারে ছেড়ে দেয়া সম্ভব হয়। এভাবে কমে যায় হৃদরোগের ঝুঁকি। রোগীদের ওপর পরীক্ষা করে দেখা গেছে, উচ্চ রক্তচাপের মাত্রা রোজার কারণে কমে আসে। রমজান মাসের নির্দিষ্ট সময় ধরে রোজা রাখার কারণে আমাদের শরীরের চর্বি পুড়ানো হয়। কিন্তু এই উপবাস যদি দীর্ঘ সময় ধরে করা হয়, তাহলে শরীরের শর্করা ভেঙে যায় যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। রাসূল সা: আমাদের সাহরি দেরিতে খেতে এবং ইফতার দ্রুত করার জন্য উৎসাহিত করেছেন। এটা যে কত স্বাস্থ্যসম্মত, তা আমরা উপরের আলোচনা থেকে বুঝতে পারলাম।
গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত রোজা রাখলে হৃদরোগের ঝুঁকি ৫৮ শতাংশ কমে যায়। রোজা রাখলে শরীরের ক্ষতিকর এলডিএল বা খারাপ কোলেস্টেরল কমে যায় এবং সুগারের মেটাবলিজম হয়। কমে যায় ডায়াবেটিসের ঝুঁকি। রোজা রাখলে উপকারী বা এইচডিএল কোলেস্টেরল ৩০-৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পায় এবং টিজি কোলেস্টেরল, শরীরের ওজন, বিএমআই কমে যায়। এক কথায়, রোজা হচ্ছে হৃদরোগের ঝুঁকি কমানোর ওষুধবিহীন অন্যতম একটি উপায়। রাসূল সা: বলেছেন, ‘রোজা রাখো ও সুস্থ থাকো’। রাসূল সা: রমজান মাসের বাইরে নিয়মিত রোজা রাখতেন প্রতি সোম, বৃহস্পতি বা মাসে তিন দিন। এ ব্যাপারে বিভিন্ন দেশে গবেষণা হচ্ছে। ওহঃবৎসরঃঃবহঃ ঋধংঃরহম বা মাঝে মাঝে রোজা রাখলে সারা বছর রোজা রাখার সুফল পাওয়া সম্ভব। বর্তমানে ইউরোপ-অ্যামেরিকার অনেক ডাক্তার চিকিৎসার অংশ হিসেবে সপ্তাহে দুই তিন দিন ফাস্টিংয়ের উপদেশ দিচ্ছেন রোগীদের। একটি প্রশ্ন গুরুত্বের দাবি রাখে যে, রমজানে হার্টের রোগী উপকৃত হচ্ছে বটে, কিন্তু বাকি ১১ মাস তাহলে তারা কিভাবে উপকৃত হবে? রোজা সক্রান্ত হাদিসগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, রমজানের বাইরে মাঝে মধ্যে রোজা রাখার ব্যাপারে রাসূল সা: আমাদের উৎসাহিত করেছেন। যেমন- সাওয়ালের রোজা, মহররমের রোজা, আরাফার দিনে রোজা, সপ্তাহে দুই দিন বা আইয়ামে বিজের রোজা, কোনো কোনো অপরাধের কাফফারা হিসেবে রোজা রাখার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ ওহঃবৎসরঃঃবহঃ ঋধংঃরহম বা মাঝে মাঝে উপবাস নিয়ে পাশ্চাত্যে যে আলোড়ন হচ্ছে এ ব্যাপারে অনেক আগেই রাসূল সা: আমাদের উৎসাহিত করেছেন।
খাদ্যাভ্যাসের ব্যাপারে রাসূল সা: বলেছেন, আমাদের পেটের তিন ভাগের এক ভাগ খাবার দিয়ে পূর্ণ করা উচিত। তিনি আরো বলেছেন, ‘আদম সন্তানের জীবন ধারণের জন্য কয়েক লোকমা খাবারই যথেষ্ট।’ আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার দীর্ঘজীবী ডা: মাহাথির মোহাম্মদের উপদেশ হচ্ছে, 'চবড়ঢ়ষব ংযড়ঁষফ বধঃ ঃড় ষরাব ধহফ হড়ঃ ষরাব ঃড় বধঃ'.
অর্থাৎ মানুষের বেঁচে থাকার জন্যই খাওয়া উচিত, খাওয়ার জন্য বেঁচে থাকা নয়। একটি বিখ্যাত গবেষণা আছে ইঁদুরের ওপর। একদল ইঁদুরকে কম খাবার দেয়া হয়েছে কয়েক বছর ধরে, পাশাপাশি আরেকদল ইঁদুরকে স্বাভাবিক খাবার দেয়া হয়েছে। দীর্ঘ পরীক্ষায় দেখা গেছে, অল্প আহারে অভ্যস্ত ইঁদুরদের বেশ কিছু রোগ কম হয়েছে অন্য দলের তুলনায়। আর একটি বড় গবেষণা হয়েছে ইঁদুরের ওপর মাঝে মধ্যে কম খাবার দিয়ে। তাতেও একই রকম সুফল পাওয়া গেছে। যুক্তরাষ্ট্রে ‘মরমন’ খ্রিষ্টান গোষ্ঠী রয়েছে যারা আট বছর বয়স থেকে নিয়মিত ফাস্টিং বা রোজা রেখে থাকে। তাদের ওপর পরীক্ষা করে দেখা গেছে, ওই দেশের সাধারণ জনগোষ্ঠীর তুলনায় তাদের মধ্যে হৃদরোগ কম হয়ে থাকে।
তাকওয়া নিয়ে কিছু কথা। এক মাসের রোজার মাধ্যমে যে মুমিন তাকওয়া অর্জন করবেন, তিনি ধূমপানের মতো বেহুদা কাজ থেকে অবশ্যই বিরত থাকবেন। উচ্চাকাক্সক্ষা, সমাজে আধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টা, প্রতিযোগিতামূলক জীবনপদ্ধতি, অবৈধ পথে আয়-ব্যয়, হিংসা, ঘৃণা, অহঙ্কার ইত্যাদি পরিহার করে সুশৃঙ্খল জীবনযাপন করবেন, উদার ও বিনয়ী হবেন এবং দুঃখে ধৈর্য ধারণ ও সুখে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে সর্বাবস্থায় মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তায়ালার ওপর খুশি থাকবেন। এভাবে সত্যিকার তাকওয়া অর্জনের মাধ্যমে হৃদরোগ অনেকাংশে প্রতিরোধ করা সম্ভব।
লেখক : মেডিসিন ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ