এক নবীন উকিলের করুণ অভিজ্ঞতা
এক নবীন উকিলের করুণ অভিজ্ঞতা - প্রতীকী ছবি
ঢাকা কোর্টকে ‘বাই বাই’ জানিয়ে এখন থেকে নিজ উপজেলা কুমিল্লার হোমনায়। দু’দিন ঘুরে চেম্বারও নিয়েছি। নিজের চেম্বার। ঢাকা থেকে রামচন্দ্রপুরগামী লঞ্চটি রাত ৪টার দিকে চন্দনপুর পৌঁছে। এই লঞ্চ ছাড়া সকালে হোমনা পৌঁছার আর কোনো সুযোগ ছিল না। বর্ষাকালে পানসিতে দেড় থেকে দুই ঘণ্টার পথ চন্দনপুর। শুষ্ক মওসুমে পাক্কা তিন মাইল পথ হাঁটা ছাড়া বিকল্প কোনো উপায় ছিল না।
সকাল সকাল গোসল সেরে চেম্বার খুলে বসে থাকতাম। মামলা মোকদ্দমা নিয়ে এই বুঝি মক্কেল এলো। হোমনা বাজারের পূর্ব দিকে কোর্ট ভবন, পশ্চিম দিকে ডাকবাংলো। প্রতিবার তিন টাকা করে রিকশা ভাড়া দিয়ে আসা-যাওয়া করতে হয়। বেলা ১১টায় কোর্ট বসত। ১০টা পর্যন্ত চেম্বার খোলা রাখার পর টাই-কোট পরতে শুরু করতাম। চেম্বারের দরজা-জানালা বন্ধ করে রিকশায় চড়ে বসতাম। স্থানীয় আইনজীবীদের অনেক মামলা-মোকদ্দমা ছিল। রিকশা করে আসা-যাওয়ার পথে তাদের চেম্বার লোকজনে ভর্তি দেখতাম। আমার নিজ এলাকার লোকজনও মামলা নিয়ে ওদের কাছে আসত। তা দেখে মনে মনে কষ্ট অনুভব করলেও তাদের সাথে সহাস্যে কথা বলতাম। কুশলাদি বিনিময় করতাম। কথায় কথায় জানিয়ে দিতাম, ‘আমি এখন থেকে এখানেই ওকালতি করব।’ অনেককে চা-সিগারেট আপ্যায়নসহ আমার চেম্বার দেখে যাওয়ার জন্য আহ্বান জানাতাম। চা-সিগারেটে আপ্যায়িত হয়ে তারা বলত- ‘আপনি নিজের মানুষ, আপনি এখানে আছেন, জানলে কী আর আমরা অন্যের কাছে যাই? ভবিষ্যতে প্রয়োজন হলে আপনার কাছেই আসব। বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়-স্বজনদেরও আপনার কাছেই পাঠাব।’ কথাটা ঠিক। আমি যে এখানে আছি অনেকেই জানেন না। অগ্রিম জানান দিতে ফজরের আজানের পরপর লঞ্চঘাট গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। আমাদের এলাকা থেকে ভোর ৫টার দিকে আসে সকালের প্রথম লঞ্চ। পরিচিত কাউকে লঞ্চ থেকে নামতে দেখলেই এগিয়ে যেতাম, কুশল বিনিময় করতাম। কী কারণে উপজেলা সদরে এসেছেন জানতে চাইলে তারা নানা রকমের উত্তর দিতেন। যারা নানা রকম উত্তর দিতেন তাদের অনেকের সাথে দেখা হতো আদালতে। আদালতে মুখোমুখি হতেই হাত কচলাতে কচলাতে বলতেন, ‘আর বলবেন না। আমার বড় ভাই গতকালই অমুককে ওকালতনামা দিয়ে রেখেছিলেন।’
এ রকম উত্তর শুনে কষ্ট পেয়েছি। সুখ ও কষ্ট সম্পূর্ণ অদৃশ্য বস্তু। ‘কথা’ নামের শব্দটিও অপদার্থ বস্তু: যার ওজন নেই, জায়গা দখল করে না, বল প্রয়োগ করলে গতি সঞ্চারও হয় না। তারপরও একটা ‘কথা’ তীরের মতো বিঁধে মন ছেদ করে দেয়। আবার কোনো কোনো ‘কথা’ হৃদয়ে কোমল পরশ বুলিয়ে দেয়। এভাবে নানা রকমের কথা ও টানাপড়েনের মধ্যে তিন মাস পার হয়।
বর্ষার শুরুর দিকের ঘটনা। নৌকা করে এক রাতে তুলাতুলি গ্রামের ১০-১২ জন লোক আমার চেম্বারে এসে উপস্থিত। তাদের সাথে আমার ভাগিনা সোহরাবও ছিল। তারা একটা মামলা করতে চায়। যার বিরুদ্ধে মামলা করতে চায় তার নাম কালাই মিয়া। কালাই মিয়া ও তার পরিবারের লোকজনের নামে একটা ফৌজদারি মামলা করবে। যে পক্ষ মামলা করবে, সে পক্ষ ভাগিনার কাছে জানতে পেরেছে, তার মামা উকিল। তাই ভাগিনাকে সাথে নিয়ে এসেছে, একটু সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার জন্য। ১ নং আসামি কালাই মিয়া আর কেউ নয়, সালমার বড় বোনের আপন বেয়াই। মামলা লিখতে শুরু করে কালাই মিয়া নামটা আসতেই কলম থেমে যায়। কলম থামিয়ে বলি, ‘এ মামলা করা সম্ভব নয়। কালাই মিয়ার নামে আমি মামলা করেছি শুনলেই সালমার বড় বোন (আমার জেঠাইস) মার মার করে ছুটে আসবে সালমার কাছে। বলবে, ‘তোর জামাইয়ের লজ্জা শরম বলতে কিচ্ছু নেই। যে লোক কয়দিন আগে আমাদের বাড়িতে কব্জি ডুবিয়ে খেয়ে গেল, এখনো ঢেঁকুর দিলে মুখ দিয়ে খাবারের গন্ধ বের হবে, সে লোক আমার বেয়াইয়ের নামে কীভাবে কেস করতে পারল? পয়সা কামানোর আর জায়গা পেলো না? ছি ছি ছি! এত নিচে নামতে পারে তোর জামাই? এ মামলার কারণে আমার মেয়ের একটা কিছু হলে, তখন বুঝবি মজাটা।’ (এসব ভেবে ভাগিনাকে বললাম) তোরা অন্য একজন উকিল দিয়ে মামলাটি কর। আমি থাকব বিবাদি পক্ষে। তারপর দু’পক্ষকে একত্রে বসিয়ে ভুল-ত্রুটির অবসান ঘটিয়ে মিটমাট করে দেবো। এ মামলা করতে গেলে পারিবারিক অশান্তি বাড়বে।
আমাকে কিছুতেই রাজি করাতে না পেরে তারা অ্যাডভোকেট আলী আহম্মদকে দিয়ে মামলাটি করায়। মামলায় বিবাদিদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। বাদি পক্ষ টাকা খরচ করে মামলা দায়ের করার দিন রাতেই আসামি ধরিয়ে ফেলবে। এই কোর্টে আসামি পুলিশ কর্তৃক ধৃত হয়ে আসলে প্রথম দিন জামিন পাওয়া যায় না। তা ছাড়া আসামি গ্রেফতার হয়ে গেলে মামলাটিও আমার হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। তাই আসামিদের উদ্দেশে একটি পত্র লিখি। পত্রে বিস্তারিত বিবরণসহ আগামীকাল এসে হাজির হতে বলি।
সমস্যা হলো, এ পত্র পাঠাব কাকে দিয়ে? সোলায়মান মাস্টারের দেখা পাই। একই গাঁয়ে তাদের বাড়ি। মাস্টার সাহেব সম্পর্কে আমার বেয়াই। তিনি বাড়ি যাবেন কি না জানতে চাইলে বলেন, ‘নৌকা পেলে বাড়ি যাব, নয়তো যাব না’। ‘আপনার নৌকা ভাড়ার সাথে আমি ১০ টাকা যোগ করে দিই, তবুও আপনি বাড়ি যান। নয়তো এ লোকগুলো রাতেই গ্রেফতার হয়ে যাবে। বাড়ি পৌঁছে যেভাবে পারেন, রাতে রাতেই পত্রটা তাদের (আসামিদের) বাড়ি পৌঁছাবেন।’
পরদিন প্রত্যুষে লঞ্চঘাটে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। কালাই মিয়া আসেন। সাথে আসেন তাদের এলাকার সাবেক চেয়ারম্যান। চেয়ারম্যান সাহেব আমাকে পাশ কাটিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান মতিন সাহেবের ডাকবাংলোয় ঢুকেন। আমিও হাঁটি তাদের পেছনে পেছনে। আস্তে আস্তে কালাই মিয়াকে জিজ্ঞেস করি, আমার পত্র পেয়েছেন?
‘পত্র পেয়েই তো আইলাম। তবে চেয়ারম্যান সাহেবের কথার বাইরে যাওয়ার সাধ্য আমার নেই।’ উপজেলা চেয়ারম্যান সাহেব তার মনোনীত আইনজীবীকে খবর দিয়ে মামলা বুঝিয়ে দিলেন। আসামিরা চেয়ারম্যান সাহেবের মনোনীত উকিলের হাত ধরে কোর্টে উপস্থিত হয়ে জামিনে মুক্ত হয়ে গেল। আমাকে সাথে রাখারও প্রয়োজনবোধ করলেন না। বাদিপক্ষের মামলাও ছাড়লাম, তৎসঙ্গে পকেট থেকে নগদ বেরিয়ে গেল ১০ টাকা।
এক সকালে শাকুর মেম্বার এসে হাজির। চেম্বারে প্রবেশ করতে করতে, ‘বেয়াই ভেজালে আটকে গেলাম। উকিলের কাছে না এসে পারলাম না।’ ‘উকিল কি কোনো অশুচি প্রাণী? যা ছুঁলে কিংবা কাছে এলে পাপ বা অপবিত্র হওয়ার আশঙ্কা থাকে? মজিব (আমার ক্লার্ক) তিন কাপ চা নিয়ে আয়, সাথে পাঁচটি সিগারেট। তা বেয়াই, চায়ের সাথে টা চলবে কি?’
‘আনলে কী আর ফেরত যাবে?’ শাকুর মেম্বার আমার বড় বোনের বড় বেয়াই। এলাকার নেতা। তাদের সাথে খাতির রাখলে লাভ হবে। ওদের পেছনে ১০ টাকা খরচ করলেও বিফলে যাবে না। এলাকার লোকজন মামলা-মোকদ্দমা করতে চাইলে ওদের কাছেই আগে যায়। বেয়াইর হাতে কাগজপত্র, নিশ্চয়ই মামলা-মোকদ্দমার কাগজ। মামলা-মোকদ্দমা হলে আমাকে ছাড়া অন্য কোথাও যাবে না। চা-টা ওকে না খাওয়ালে খাওয়াব কাকে!
বেয়াই আমার দিকে কাগজপত্র এগিয়ে দিতে দিতে, ‘দেখেন তো বেয়াই, এই আসামির জামিন করা যাবে কি না।’ ধর্ষণ মামলা। অভিযোগপত্র দাখিলের পর আসামির প্রতি হুলিয়া ও ক্রোকি পরোয়ানা জারি হয়েছে। এ অবস্থায় এসব অপরাধের জামিন নিম্ন আদালত থেকে হয় না। তাই বললাম, ‘জামিন হবে না, ম্যাজিস্ট্রেটরা সচরাচর এসব মামলায় জামিন মঞ্জুর করেন না।’
‘বুঝতে পারছি, বেইল করতে পারবেন না। বেইল কাটাইতে তো পারবেন। গত তিন মাস দৌড়াদৌড়ি করে শেষ করেছি। কেউ বেইল করতে স্বীকার করে না। শেষমেশ কুমিল্লা গিয়ে জজ কোর্টের বড় উকিলের সাথে পরামর্শ করে এসেছি। বড় উকিলের পরামর্শ অনুসারে আসামিকে হাজতে ঢুকিয়ে নকল তুলে দেবেন। জজ কোর্ট থেকে জামিন করিয়ে আনব।’
ভেবেছিলাম, এত দিন পর একটা মামলা পাওয়া গেল। শনির দশা কেটে বৃহস্পতি শুরু হলো। ঢাকার বড় কোর্টে এসব মামলার পরামর্শ দিতে গেলেই দু-চার পাঁচশ’ টাকা খরচ হয়ে যায়। এখানে ঢাকার মতো কথা বলতে গেলে কেস ফসকে যাবে। ফসকে গেলে চলবে না। উপজেলার প্রথম কেস। খুব সাবধানে এগোতে হবে। যে করেই হোক, মক্কেলের গাঁট থেকে পয়সা বের করতে হবে। পয়সা বের করার যেসব কৌশল রপ্ত করেছিলাম সেসব কৌশল প্রয়োগের আগে পক্ষকে মনের দিক থেকে ডাউন করতে হবে। লোহার আকার পরিবর্তনের আগে তাপ দিয়ে উত্তপ্ত করে নিতে হয়। উত্তপ্ত লোহায় ঘা মেরে যা ইচ্ছে তা করা যায়। বেয়াইর মনকে উত্তপ্ত করার জন্য আস্তে আস্তে হিট দিতে শুরু করি, মানসিকভাবে দুর্বল করার উদ্দেশে বলি, ‘তা বেয়াই, এসব সেনসেটিভ মামলা। জামিন দিক বা না দিক খরচপত্র ঠিকই লাগে। পেশকার পিয়ন-কোর্ট দারোগা কোনো শালাই ছাড় দেয় না। জামিনের ব্যাপারে যার সামনে যাবেন, সেই টাকা চাইবে। টাকার জন্য সবাই হা করে বসে আছে।
‘সব জানি বেয়াই সব জানি, গত তিন মাসে কোনো লোক চিনতে বাকি নেই। কোনখানে কী লাগবে সব জেনে এসেছি।’ মনে মনে বলি, শেয়ানা পাবলিক, সুবিধা করতে পারছি না। দারোগা পুলিশকে টাকা দেয়ার কথা বললে আজ পর্যন্ত কোনো মক্কেল না বলেনি। মক্কেলের মতে, দারোগা পুলিশকে টাকা দেয়া পুণ্যের কাজ! কম আর বেশি দিতে হবেই। দারোগা পুলিশ, পিয়ন, পেশকার, কাগজ, কোর্ট-ফি, জামিনদার পরীক্ষা ইত্যাদির নামে টাকা চাইলে কেউ বারণ করে না। আউলিয়া দরবেশের মানতি টাকার মতো মন খুলে দিয়ে দেয়। টান পড়ে উকিলের টাকার বেলায়। তাই নিজের কথা না বলে পীর-ফকির ও দরগাহের (দারোগা-পুলিশ-পিয়ন) নাম করেই টাকা আদায় করতে হয়। টাকা আদায়ের প্রথম তীর ব্যর্থ হলে পুনরায় তূণ থেকে দ্বিতীয় তীর বের করে ধনুকে যোজনা করি, ‘দারোগা পুলিশ, পেশকার-পিয়ন ওদের টাকাটা এখন লাগবে। আপনার হাত থেকে নিতে চাইবে না। ওদের রাজি খুশি রেখেই কাজ করতে হবে। ওরা অসন্তুষ্ট হলে আসামির ক্ষতি হতে পারে।
‘ওই চিন্তা আপনার করতে হবে না। ছেলেকে লকাপে ঢুকিয়ে আপনার কাছে এসেছি। তারা আপনার কাছে এক টাকাও চাইবে না। তারাই বলেছে- ‘কম টাকায় করতে চাইলে নতুন উকিলের কাছে যান। হাকিম তো আর জামিন দিচ্ছে না। তাই বেশি পয়সার উকিল নিয়ে লাভ কী?’
তীর এবারো লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো। কোনো অস্ত্র¿ই লক্ষ্যভেদ করতে পারছে না। রাজধানীর বড় কোর্টের সাথে গাঁও গেরামের ছোট কোর্টের আকাশ-পাতাল পার্থক্য। ঠিক যেন বঙ্গোপসাগর আর মেনিখালীর খাল। সমুদ্রের মাছ শিকারের কলাকৌশল নদী খালের মাছ শিকারে প্রয়োগ করে কোনো সুফল পাচ্ছিলাম না। রাজধানী শহরের আদালতে আসা মক্কেলরা পেশকার-পিয়নের খবর পাওয়া তো দূরের কথা, সেরেস্তার প্রবেশদ্বারই চিনত না। আর এখানকার মক্কেলরা মামলার নাড়ি নক্ষত্রের খবর নিয়েই কৌঁসুলির কাছে আসে। শহরের বুদ্ধি গ্রামে খাটানোর চেষ্টা করা, আর কাঁঠাল পাকানোর ফর্মুলায় তরমুজ পাকানোর চেষ্টা করা, এক কথা। টাকা আদায়ের শেষ তীর এখনো তূণে আছে, যা একশ’ ভাগের মধ্যে একশ’ ভাগই সফল হয়। শেষ তীর থেকে বিয়াই কীভাবে রক্ষা পান দেখা যাক- ‘তা বিয়াই, কাগজপত্র, কোর্ট-ফি, ওকালতনামা, দরখাস্ত ইত্যাদির জন্য কিছু টাকা-পয়সা দরকার। এসব বাবদ ওর (মুহুরির) কাছে কিছু টাকা পয়সা দেন। (মজিবুরকে উদ্দেশ করে) যা বেয়াইর কাছ থেকে শ’দুয়েক টাকা নিয়ে যেসব কাগজপত্রের কথা বললাম, সেসব কাগজপত্র নিয়ে আয়। একসাথে দু’টি বেলবন্ডসহ রি-কলও নিয়ে আসবি।
‘লিখিত দরখাস্তসহ পূরণ করা ওকালতনামাও সাথে নিয়ে এসেছি। আপনি শুধু খোঁচা মেরে একটা স্বাক্ষর বসিয়ে দিন। সিল আমি নিজেই লাগিয়ে নেব। ভয় নেই, সিল উল্টা লাগাব না। বহুদিন থেকে মেম্বারগিরি করছি, সিলের উল্টা-ভাও চেনা আছে। আর বেলবন্ডের কথা বলছেন। আগে বেল মঞ্জুর হোক, তারপর বন্ড। মাঘের গান আগে গেয়ে লাভ নেই।
তূণের তীর শেষ। রাজধানীর ধানুকি বানশূন্য ধনুক হাতে কলম তুলে বেয়াইর কথামতো স্বাক্ষর করে দেই। স্বাক্ষর করাকালেই সিলের মাথায় কালি লাগিয়ে রেখেছিল। আমার হাতে কলম থাকতেই দরখাস্তের পাশে ও ওকালতনামার উল্টা পিঠে, ঠাস ঠাস করে দু’টি সিল বসিয়ে দেন। কর্তব্যকাজ সম্পাদনের পর উঠতে উঠতে, ‘তা বেয়াই, আপনি একটু তাড়াতাড়ি করে আসেন। দরখাস্ত আমি দাখিল করে ফেলি।’
বেয়াই চলে যাওয়ার পর আমরা উকিল-মুহুরি দু’জন দু’জনার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। নীরবতা ভেঙে মজিবুর (মুহুরি) বলে, ‘এখন থেকে শক্ত হতে হবে। নরম হলে এ রকমই হবে। টাকা-পয়সা তো দিলই না, পকেট থেকে নামিয়ে গেল ১২ টাকা।’ ‘শক্ত কার সাথে হবো, বুদ্ধি পাচ্ছিলাম না। ওর সাথে চোখ উল্টিয়ে কথা বলতে গেলে নালিশ চলে যাবে বড় বোনের কাছে, বলবে- ‘বেয়াইন, আপনার ভাই উকিল না চামার। চোখে লাজলজ্জা বলে কিচ্ছু নেই। এর চেয়ে চোর-ডাকাত অনেক ভালো। ছি! ছি! ছি! ...। যে পয়সা হাড়ি-চাঁড়ালের ঘরেও আছে সে পয়সার জন্য এত নিচে নামতে হয়!
বড় বোন চলে যাবেন বাবার কাছে। বাবার ওপর বড় বোনের ব্যাপক প্রভাব। এখনো বাবার খরচের ওপরই চলছি। তিনি এখনো চাচ্ছেন। চাপাবাজি ব্যবসা ছেড়ে আমি যেন তার জমাজমি দেখাশোনা করি। প্রয়োজনে কলের লাঙল দিয়ে জমি চাষাবাদসহ হাঁস-মুরগি গরু-বাছুরের খামার করি। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ওকালতিতে এসে নেকনামের পরিবর্তে যদি বদনাম প্রচার হতে শুরু হয়, তবে নির্ঘাত এ পেশা পাল্টাতে হবে। শুধু তাই নয়, আমাকে জোর করে নামিয়ে দেবেন গৃহস্থালির কাজে। সালমাকে অনেক আগেই বাবা এ কাজে নামিয়ে দিয়েছেন।
তাই মন কষাকষিতে না গিয়ে যা পাওয়া যায় তাই ভালো। বড় মামলা, পার্টি এখনো হাতছাড়া হয়ে যায়নি। আমাদের একটা কিছু না করে তারা যাবেই না। সেজেগুজে কোর্টে যাওয়ার পর সবাই বলাবলি করতে শুরু করে, ‘ছোটখাটো মামলা নয়, কোর্টের সেরা মামলা। কথায় বলে, ‘মাছ খাইলে খাও মাগুর, আর নাঙ ধরলে ধরো ঠাকুর’; জয়নাল সাহেবও একেবারে ঠাকুর ধরে ফেলেছেন। তিনি যে মামলা ধরেছেন ছয় মাসের কামাই এক দিনেই করে ছাড়বেন।
শুনানির পর ম্যাজিস্ট্রেট জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করে বিবাদিকে হাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। আসামি আজকে রাত কোর্টহাজতে থাকবে, কাল নিয়ে যাবে কুমিল্লা সেন্ট্রাল জেলে। আসামি যাতে আরাম করে কুমিল্লøা যেতে পারে, সে কারণে খরচপত্র দেয়া হলো। রাতে ভালোভাবে থাকা-খাওয়ার জন্যও খরচ দেয়া হলো। দড়ি কোমরে বাঁধার বদলে হাতে বাঁধা হবে, এ ব্যাপারেও খরচপত্র দেয়া হয়। সব ব্যবস্থা শেষ করে শাকুর মেম্বার আমার কাছে এসে বলে, ‘বিয়াই, আমার পোলা আর আপনার পোলার মধ্যে আমি কোনো পার্থক্য দেখি না। আশা করি, আপনিও পার্থক্য দেখবেন না। রাতে একবার এদিকে এসে পোলাকে (আসামি) বল-ভরসা দিয়ে যাবেন।’
‘আসব আসব, আপনার পোলাকে সাহস দেয়ার জন্যই আসতে হবে। তা বেয়াই আমাদের জন্য কী করে গেলেন? বিশেষ করে আমার মুহুরিটা সারাটা দিন দৌড়াদৌড়ি করেছে, তাকে তো কিছু একটা করে যাওয়া দরকার।’ ‘আর বলবেন না বেয়াই। টাকা-পয়সা যা ছিল দারোগা পুলিশ টানাটানি করে নিয়ে গেছে। মামলাটাই তো আপনার। দুই-চার দিনের মধ্যে কুমিল্লøা থেকে জামিনের অর্ডার নিয়ে যখন ফিরে আসব, তখন আপনাদের খুশি করব। আমরা দু’জন যে কপাল সে মাথা নিয়ে সন্ধ্যার দিকে চেম্বারে ফিরে যাই। দু’দিন পর জামিনের খবর নিতে গিয়ে জানতে পারি আসামির সাথে সাথে মামলার নথিপত্রও বিচারের জন্য কুমিল্লা পাঠিয়ে দিয়েছে। আমার চেম্বারের কাছেই ছিল হোমনা কলেজ। কলেজের বাংলা প্রফেসর মাঝে মাঝে চেম্বারে আসতেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করতেন। দু’জনে দুই পেশার সুবিধা-অসুবিধা ও সুখ-দুঃখের কথা বলতাম।
রবিনহুড হওয়ার বদলে শনির দশায় পতিত হওয়ার কথা শুনে তিনি দুঃখ করতেন। আত্মীয়-স্বজনদের দ্বারা প্রতারিত হওয়ার কথা শুনে হাসতেনও কষ্টের হাসি। সব শুনে তিনি একদিন সুন্দর একটা গল্প বলেন- ‘এক ছিল বন। বনের পাশে ছিল এক গ্রাম। গ্রামের মানুষ শেয়ালের অত্যাচারে হাঁস-মুরগি রাখতে পারত না। শেয়াল প্রতি রাতে দু’-চারটা করে হাঁস-মুরগি নিয়ে যেত। গ্রামের লোকজন শেয়াল ধরার ফাঁদ কিনে আনে। মুরগি চুরি করতে এসে এক রাতে একটা শেয়াল ফাঁদে আটকে যায়। অন্যান্য শেয়াল বনে ফিরে গিয়ে আটকে পড়া শেয়ালের জন্য অনুতাপ করতে থাকে। আটকে পড়া শেয়াল জখমি অবস্থায় প্রাণ নিয়ে বনে ফিরতে পারে। খবর শুনে বনের সব শেয়াল জখমি শেয়ালকে দেখতে আসে। এ রকম দুরবস্থার কারণ জানতে চায়। জখমি শেয়াল কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘আর বলিস না ভাই। ফাঁদে আটকা পড়ার পর গাঁয়ের লোকেরা মারধর শুরু করে, যেমন তেমন মার নয়। লাথির পর লাথি, গুঁতার পর গুঁতা, ঘাইয়ের পর ঘাই, সব মার পড়ে আমার শরীরে। একটা বাঁশের বাড়ি ঠাস করে এসে আমার মাথায় পড়তেই সর্ষেফুল দেখতে শুরু করি। মারা গেছি মনে করে আমাকে ডোবার ধারে ফেলে রাখে। মৃত ভেবে কাক চিল ঠোকরাতে শুরু করে। জ্ঞান ফিরলে প্রাণ নিয়ে মানে মানে বনে ফিরতে পারি।
শিয়ালের দুর্দশার কাহিনী সবাই মন দিয়ে শোনে। এক শেয়াল বলে ‘তোকে এত মাইর মারল, আর তুই শুয়ে শুয়ে সহ্য করলি? তোর পায়ে নখ ছিল, মুখে দাঁত ছিল, পেট ভর্তি ছিল গ্যাস। একজনকে একটা কামড় দিলি না, আঁচড়ও দিলি না, আসার পথে একটু গ্যাসও তো ছেড়ে দিতে পারতি?’
‘পারতাম, সব দিতে পারতাম, কিন্তু দেবো কাকে? যার মুখের দিকে তাকাই তারই দুই একটা মুরগি আমার পেটে আছে, সে লজ্জায় কিছু করতে পারিনি।’ আপনার অবস্থা হয়েছে লজ্জা পাওয়া শিয়ালের মতো। কার ঘরের দানা-পানি আপনার পেটে আছে, তা ভেবে দাঁত বসানো বন্ধ রাখলে ভাত পাবেন না। একজন নতুন উকিলের কাছে প্রথম প্রথম আত্মীয়-স্বজনই আসবে। আপন-পর যেই আসুক, লাজলজ্জা ভুলে মিছরির ছুরি চালিয়ে দেবেন।
লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক
E-mail : adv.zainulabedin@gmail.com