অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া : কতটা ভয়াবহ ঘুমের এই রোগ
অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া : কতটা ভয়াবহ ঘুমের এই রোগ - প্রতীকী ছবি
অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া বা ওএসএ– এই তিনটে শব্দ এখন বেশ পরিচিত। একটি পরিসংখ্যান বলছে, পুরুষদের মধ্যে ২০-৫০ শতাংশ এবং নারীদের মধ্যে ১৪-৩০ শতাংশ নাক ডাকেন। ভারতবর্ষে এই রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে, মূলত ১৮-৬০ বছর বয়স্কদের মধ্যে। এমনকী, বাচ্চারাও এর ব্যতিক্রম নয়। ৫-১০ বছরের বাচ্চাদের মধ্যে পেডিয়াট্রিক স্লিপ অ্যাপনিয়া চিকিৎসকদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠছে। শুধুই কি আমাদের দেশে? গোটা পৃথিবীতে এপিডেমিক বা মহামারীর মতো উঠে আসছে অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া। মানুষ আতঙ্কিত। কিন্তু কী এই রোগ? এই রোগের চিকিৎসাই বা কী?
নামের মধ্যেই লুকিয়ে আছে, স্লিপ বা ঘুমের মধ্যে অবস্ট্রাকশন বা বাধার জন্য অ্যাপনিয়া বা শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়া। ঘুমের মধ্যে নাক ডাকতে ডাকতে একজন মানুষের হঠাৎ করে নাক ডাকার আওয়াজটা বন্ধ হয়ে গিয়ে দম আটকে যায় এই রোগে। রোগী ধড়মড় করে জেগে ওঠেন। গোটা ঘটনাটা বারবার ঘটতে থাকে। ঘুমটা একদম ভালো হয় না। দিনের বেলা ক্লান্ত লাগে, যেখানে সেখানে ঘুম পেয়ে যায়। স্লিপ স্টাডি বা পলিসমনোগ্রাফি করে দেখা যায় ঘুমের মধ্যে শরীরে বিশাল মাপের অক্সিজেন ঘাটতি হচ্ছে। অবস্ট্রাকশন বা বাধার জন্য অগুনতিবার দম আটকে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে।
অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া রোগের চিকিৎসার মূল লক্ষ্যটাই হলো অবস্ট্রাকশন বা বাধাটা অতিক্রম করা। কিন্তু কী ভাবে? দু’ভাবে এটা করা যায়। হয় সার্জারি করে রিয়েল এলিমিনেশন, অথবা সি প্যাপ (সিপিএপি) মেশিন ব্যবহার করে ভার্চুয়াল এলিমিনেশন। লাইফস্টাইল ম্যানেজমেন্ট, ওজন কমানো, ব্যালান্সড ডায়েট বা এক্সারসাইজ যদিও গোড়ার কথা, কিন্তু এটা মাথায় রাখা জরুরি যে রোগা-পাতলা মানুষের মধ্যেও স্লিপ অ্যাপনিয়া ভীষণভাবে বর্তমান, যাকে বলে নন-ওবিস স্লিপ অ্যাপনিয়া। গঠনগত অবস্ট্রাকশন বা বাধাটাই যেখানে মূল কথা।
কাজেই সি প্যাপ না সার্জারি? এটা সত্যি কথা বলতে গেলে কোনো বিতর্ক নয়। একে অন্যের কম্পিটিটর (প্রতিযোগী) নয়। বরং একে অন্যের কমপ্লিমেন্টারি (পরিপূরক)। সুবিধা বা অসুবিধা দুই পদ্ধতিতেই আছে। আমেরিকান অ্যাকাডেমি অফ স্লিপ মেডিসিনের গাইডলাইন অনুযায়ী সি প্যাপ হলো প্রথম অপশন বা গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড ট্রিটমেন্ট। স্লিপ অ্যাপনিয়া চিকিৎসায় সাফল্যের অনুপাতে সি প্যাপ হয়তো সর্বোত্তম। কিন্তু একাধিক পরিসংখ্যান বলছে, অন্তত ৫৪-৬০ শতাংশ মানুষ গোটা পৃথিবীতে সি প্যাপ পড়ে ঘুমাতে পারেন না। হয় তারা সি প্যাপ মাস্ক পছন্দই করেন না, তাই পরতে চান না; অথবা তাদের এমন এক বা একাধিক গঠনগত বাধা আছে নাক বা গলায়, যে সি প্যাপ পড়ার পর তাদের দমবন্ধ (ক্লস্ট্রোফোবিয়া) লাগে, এবং তারা ব্যবহার করেন না। এদের ক্ষেত্রে স্লিপ অ্যাপনিয়া সার্জারির একটা বিশাল ভূমিকা আছে।
এক্ষেত্রে প্রথমেই স্লিপ এন্ডোস্কোপি পরীক্ষার সাহায্যে রোগীকে অপারেশন থিয়েটারের মধ্যে ঘুম পাড়ানো হয়। ঘুমন্ত অবস্থায় যখন তিনি নাক ডাকছেন, তখন দেখে নেওয়া হয় কোথায় কোথায় ব্লক আছে। যে যে গঠনগত সমস্যার জন্য পেশেন্টের নাক ডাকছে, দম আটকাচ্ছে, সেই সেই স্ট্রাকচারগুলোকে পরবর্তী পদক্ষেপে বিভিন্ন ধরনের সার্জারি করে ঠিক করা হয়। অর্থাৎ টার্গেট ওরিয়েন্টেড সার্জারি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই সার্জারিগুলো মিনিমালি ইনভেসিভ রিকনস্ট্রাক্টিভ সার্জারি। যেমন সেপটোপ্লাস্টি-টারবিনোপ্লাস্টি বা নাকের বেঁকা হাড় সোজা করা বা টারবিনেট এবং পলিপকে ছোট করা, নাকের পেছনে অ্যাডিনয়েড গ্ল্যান্ড বা গলায় বিশাল বড়ো টনসিল কোবলেশন পদ্ধতিতে বিনা রক্তপাতে বাদ দেয়া। বার্ব সুতার সাহায্যে প্যালেটোপ্লাস্টি করে কোনো কাটাছেঁড়া না করেই টাকরা তালু আলজিভের বাধা দূর করা। এমনকি, চোয়ালের হাড়ের গঠনগত বাধা থাকলে ম্যাক্সিলোম্যান্ডিবুলার অ্যাডভান্সমেন্ট বা ম্যাক্সিলারি এক্সপ্যানশন সার্জারি করে পার্মানেন্টভাবে অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়ার চিকিৎসা সম্ভব।
কাজেই সি প্যাপ প্রথম পদক্ষেপ হলেও যারা এটাতে অভ্যস্ত হতে পারছেন না বা ভালো রেজাল্ট পাচ্ছেন না, এবং কিছুই চিকিৎসা না করে নিজেকে ভয়ংকর পরিণতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, তাদের জন্য সার্জারি অবশ্যই বিকল্প।
সূত্র : সংবাদ প্রতিদিন