পাকিস্তানের রাজনীতিতে অন্য দেশের প্রভাব
পাকিস্তানের রাজনীতিতে অন্য দেশের প্রভাব - ছবি : সংগ্রহ
নতুন পরিস্থিতি ইসলামাবাদে বিশাল এক অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করেছে। ২২ কোটির বেশি লোকের পারমাণবিক সম্মৃদ্ধ দেশটি পশ্চিমে আফগানিস্তান, উত্তর-পূর্বে চীন এবং পূর্বে পারমাণবিক প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের মধ্যে অবস্থিত, যা এটিকে কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে।
আফগানিস্তান: পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা এবং ইসলামপন্থী তালেবানের মধ্যে সম্পর্ক সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শিথিল হয়েছে। এখন তালেবানরা আবার ক্ষমতায় এসেছে এবং আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতার কারণে অর্থনৈতিক ও মানবিক সঙ্কটের সম্মুখীন। কাতার এখন যুক্তিযুক্তভাবে তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিদেশী অংশীদার।
সেন্টার ফর এ নিউ আমেরিকান সিকিউরিটি থিঙ্কের ইন্দো-প্যাসিফিক সিকিউরিটি প্রোগ্রামের পরিচালক লিসা কার্টিস-ট্যাংক বলেছেন, ‘তালেবানের বাহক হিসেবে আমাদের (যুক্তরাষ্ট্রের) পাকিস্তানের প্রয়োজন নেই। কাতার এখন অবশ্যই সেই ভূমিকা পালন করছে।’
পাকিস্তান চায় তালেবানরা চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলো দমন করার জন্য আরো কিছু করুক এবং তারা এই গোষ্ঠীগুলো পাকিস্তানে সহিংসতা ছড়াবে বলে আশঙ্কা করছে।
চীন: ইমরান খান ধারাবাহিকভাবে পাকিস্তান এবং বিশ্বে চীনের ইতিবাচক ভূমিকার ওপর জোর দিয়েছেন। ৬০ বিলিয়ন ডলারের চায়না-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (সিপিইসি) প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানের দু’টি প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের অধীনে চালু করা হয়েছিল, উভয়ই খানকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে চায়।
বিরোধীদলীয় নেতা শেহবাজ শরীফ পূর্বাঞ্চলীয় পাঞ্জাব প্রদেশের নেতা হিসেবে সরাসরি চীনের সাথে চুক্তি করেন এবং বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্পগুলো নিজ প্রদেশে নেয়ার জন্য তার খ্যাতি রয়েছে। ফলে সরকার পরিবর্তন হলেও বেইজিংয়ের সাথে ইসলামাবাদের সম্পর্কে তার প্রভাব পড়বে বলে মনে হয় না।
ভারত : পাকিস্তান ভারতের সাথে ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর থেকে তিনটি যুদ্ধ করেছে, যার মধ্যে দু’টি কাশ্মিরের বিতর্কিত মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে। আফগানিস্তানের মতোই, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী সংবেদনশীল এই এলাকায় নীতি নিয়ন্ত্রণ করে। ২০২১ সাল থেকে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখার সীমান্তে উত্তেজনা সর্বনি¤œ স্তরে রয়েছে। তবে ভারতে সংখ্যালঘু মুসলমানদের ওপর হামলার জন্য ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির চরম সমালোচনাসহ বিভিন্ন বিষয়ে গভীর অবিশ্বাসের কারণে প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে বছরের পর বছর ধরে কোনো আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক আলোচনা হয়নি।
ভারতীয় রাজনৈতিক ভাষ্যকার করণ থাপা বলেছেন, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী কাশ্মিরে সফল যুদ্ধবিরতি গড়ে তোলার জন্য ইসলামাবাদে একটি নতুন বেসামরিক সরকারের ওপর চাপ দিতে পারে। শনিবার, পাকিস্তানের শক্তিশালী সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া বলেছেন, ভারত রাজি হলে তার দেশ কাশ্মির নিয়ে এগিয়ে যেতে প্রস্তুত।
শরীফ পরিবারের বছরের পর বছর ধরে ভারতের প্রতি বেশ এক ধরনের দ্বৈতবাদী পদক্ষেপ রয়েছে। মোদি ও শরীফকে এর আগে একে অন্যের ব্যক্তিগত অনুষ্ঠানেও যোগ দিতে দেখা গেছে। এটি শরীফ পরিবারের প্রতি ভারতের ব্যাপারে নানা অবিশ্বাস সৃষ্টি করেছে পাকিস্তানে।
যুক্তরাষ্ট্র : এবারের রাজনৈতিক অস্থিরতার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাকে ইমরান খান বেশি দায়ী করেছেন। যদিও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, পাকিস্তানের রাজনৈতিক সঙ্কট প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের অগ্রাধিকার হওয়ার সম্ভাবনা কম, যদি না এটি ভারতের সাথে ব্যাপক অস্থিরতা বা ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার দিকে পরিচালিত করে।
দক্ষিণ এশিয়ার সাবেক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী যিনি সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ থিঙ্ক-ট্যাঙ্কের একজন সিনিয়র সহযোগী, রবিন রাফে বলেন, ‘আমাদের কাছে ভাজার জন্য আরো অনেক মাছ আছে।’
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনে দায়িত্ব পালনকারী জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সিনিয়র পরিচালক ড. কার্টিস বলেছেন, ‘যেহেতু সামরিক বাহিনী সেই নীতিগুলির ওপর দৃষ্টি রাখে যেগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সত্যই চিন্তার কারণ হয়, যেমন আফগানিস্তান, ভারত এবং পারমাণবিক অস্ত্র। ফলে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ঘটনাবলি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অনেকটাই অপ্রাসঙ্গিক।’
তিনি উল্লেখ করেন যে, ‘ইমরান খানের মস্কো সফর মার্কিন সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে একটি ‘বিপর্যয়’ ছিল এবং ইসলামাবাদে একটি নতুন সরকার অন্তত ‘কিছু মাত্রায়’ সম্পর্ক সংশোধন করতে সহায়তা করতে পারে।’
ইমরান খান বলেছেন, সাম্প্রতিক মস্কো সফরের কারণে ওয়াশিংটন তাকে অপসারণ করতে চেয়েছিল। তিনি ‘হুমকির চিঠি’ পাঠানো মার্কিন কর্মকর্তার নামও প্রকাশ করেছেন। তিনি জানান যে, দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী সেক্রেটারি অব স্টেট ডোনাল্ড লু থেকে হুমকিমূলক বার্তা পাওয়া গেছে। বর্তমানে ভারত সফরকারী ডোনাল্ড লু হিন্দুস্তান টাইমসের সাথে একটি সাক্ষাৎকারে, ‘হুমকিপূর্ণ বার্তা’ বিতর্ক সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের অভিযোগের প্রতিক্রিয়া জানাতে অস্বীকার করেছেন।
মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট এবং হোয়াইট হাউজ একসাথে ইমরান খানের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে, হোয়াইট হাউজের কমিউনিকেশন ডিরেক্টর কেট বেডিংফিল্ড ইমরান খানের অভিযোগ স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করেন।
পাকিস্তানে সংসদ ভেঙে দেয়ার বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টের অনুমোদন পেলে সম্ভাব্য নির্বাচনে ইমরান খানের ভালো করার সম্ভাবনা রয়েছে। এক জরিপে বলা হয়েছে, বর্তমানে ৫৪ ভাগ পাকিস্তানি ইমরান খানকে সমর্থন করেন। বিরোধি জোট ক্ষমতায় এসে কিছুদিন পরে এই নির্বাচন আয়োজন করা হলে তখন পরিস্থিতি পরিবর্তিতও হতে পারে। ভারতের রাশিয়ার প্রতি ঝুঁকে পড়ায় পাকিস্তানের গুরুত্ব পশ্চিমা বলয়ে কিছুটা বেড়েছে। সেনাপ্রধানের ইউক্রেন আগ্রাসনের ব্যাপারে স্পষ্ট বক্তব্য সে সম্পর্ক আরো বাড়াতে পারে। তবে দেশটির গভীর ক্ষমতা বলয় ইমরান খানকে আবার ক্ষমতায় ফেরাতে চায় কি না সেটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হবে।
mrkmmb@gmail.com