পাকিস্তানে তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী যেভাবে নির্বাচিত হন
ইমরান ও শাহবাজ - ছবি : সংগৃহীত
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের পরামর্শে রাষ্ট্রপতি আরিফ আলভি দেশের পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়েছেন। ফলে এখন নতুন নির্বাচন হতে হবে। আবার নতুন নির্বাচন হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে। নতুন তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হওয়ার আগে পর্যন্ত ইমরান খানই প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করবেন।
পাকিস্তানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়োগের নিয়ম
প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেয়ার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির তেমন নেই, বরং প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেতার ঐক্যমতের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন প্রেসিডেন্ট।
অনুচ্ছেদ ২২৪ অনুযায়ী, বাতিল হয়ে যাওয়া সংসদের প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেতার মধ্যে একজনকে নিয়োগের বিষয়ে ঐক্যমত্য হতে হবে।
মন্ত্রিসভা রদ হওয়ার তিন দিনের মধ্যে এই নিয়োগ দিতে হবে।
নতুন নাম নির্ধারিত হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট সেই নাম অনুমোদন করবেন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব নেয়ার আগ পর্যন্ত বর্তমান প্রধানমন্ত্রী দায়িত্বে থাকবেন।
যদি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেতা- বর্তমান প্রেক্ষাপটে ইমরান খান ও শাহবাজ শরিফ - একজন প্রার্থীর নামের বিষয়ে সম্মত হতে না পারেন, তাহলে এই দায়িত্ব একটি কমিটির ওপর বর্তাবে যেখানে ক্ষমতাসীন দলের চারজন ও বিরোধী দলের চারজন সদস্য থাকতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই কমিটি যদি তিন দিনের মধ্যে যেকোনো একজন প্রার্থীর নামের বিষয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে না পারেন, তাহলে নির্বাচন কমিশনের ওপর নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের দায়িত্ব অর্পিত হবে।
এরপর নির্বাচন কমিশনকে দুই দিনের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নতুন প্রধানমন্ত্রীর নাম ঘোষণা করতে হবে।
দেশদ্রোহিতার পাল্টাপাল্টি অভিযোগ
পাকিস্তানের সংসদের বিরোধী দলের নেতা শাহবাজ শরিফ সংসদের স্পিকার কাসিম সুরি ও প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে 'গুরুতর দেশদ্রোহিতা'র অভিযোগ তুলেছেন এবং বলেছেন যে দু'জনকেই পাকিস্তানের সংবিধানের 'অনুচ্ছেদ ৬'-এর অধীনে দেশদ্রোহিতার দায়ে অভিযুক্ত করা উচিত।
অন্যদিকে ইমরান খানের দল পিটিআই-এর নেতারাও দলের বিদ্রোহী সদস্যদের 'বিশ্বাসঘাতক' হিসেবে অভিযোগ করছেন।
পাকিস্তানের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৬ অনুযায়ী : 'যদি কেউ জোর প্রয়োগ করে, কোনো অসাংবিধানিক পন্থা অবলম্বন করে সংবিধানের বিলোপ, বাতিল, স্থগিত বা সাময়িকভাবে স্থগিত করে বা তেমন কিছু করার চেষ্টা করে, তাহলে ওই ব্যক্তি ও তার সহযোগীরা দেশদ্রোহী হিসেবে বিবেচিত হবেন।'
বিচারপদি এস এম জাফরের মতে, 'দেশদ্রোহিতা' শব্দটি পাকিস্তানের সংবিধানে প্রথমবার ব্যবহৃত হয় ১৯৭৩ সালে। তবে এই সংজ্ঞা সংবিধানের অষ্টাদশ সংশোধনীর পর পরিবর্তিত হয়।
ভাগ্য সুপ্রিম কোর্টের হাতে
ইমরান খানের বিরুদ্ধে আনা বিরোধীদের অনাস্থা প্রস্তাবের ওপর ভোট আটকাতে রোববার তার দল পিটিআই পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দেয়, এবং খান আগাম নির্বাচনের ঘোষণা দেন।
ক্ষিপ্ত বিরোধী জোট সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়। এখন জানা যাচ্ছে যে পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দেওয়া বৈধ ছিল কিনা তা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে মঙ্গলবার রায় দিতে পারে।
ইমরান খান অভিযোগ করছেন, তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য এই অনাস্থা ভোট আমেরিকানদের একটি চক্রান্ত, যদিও যুক্তরাষ্ট্র এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
এর আগে রোববার ইমরান খানের বিরুদ্ধে পার্লামেন্টে একটি অনাস্থা প্রস্তাবের ওপর ভোট হওয়ার কথা থাকলেও- যেই ভোটে তিনি শোচনীয়ভাবে পরাজিত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছিল- পার্লামেন্টের স্পিকার কাসিম সুরি বিরোধী দলগুলোর জোটের অনাস্থা ভোট করার দাবি নাকচ করে দেন। পরে প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দেন।
পাকিস্তানের ২২তম প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান দায়িত্ব নেয়ার সাড়ে তিন বছরের মাথায় মন্ত্রিসভা বাতিল করে দিয়েছেন। অনাস্থা ভোট আয়োজনের প্রক্রিয়াকে 'সরকারের বিরুদ্ধে বিদেশী ষড়যন্ত্র' হিসেবে উল্লেখ করেছেন ইমরান খান।
পাকিস্তান রাষ্ট্রের উত্থানের পর থেকে এখন পর্যন্ত দেশটির কোনো প্রধানমন্ত্রী তার মেয়াদের পুরোটা সময় দায়িত্বে থাকতে পারেননি।
অন্যদিকে বিরোধী দলগুলোর জোট স্পিকার ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যক্রমকে অসাংবিধানিক ও অগণতান্ত্রিক হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
বিরোধী দলগুলোর জোট বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের রাস্তা উপায় খুঁজতে যৌথ উদ্যোগ নিয়েছে।
রবিবার মন্ত্রিসভা রদ হওয়ার পর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায় যে ইমরান খান আর প্রধানমন্ত্রী থাকবেন না।
তবে প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি ইঙ্গিত দিয়েছেন যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ পাওয়ার আগ পর্যন্ত ইমরান খানই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী থাকবেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের জন্য বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ও বিরোধী জোটের নেতা শাহবাজ শরিফকে এরই মধ্যে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি।
সোমবার সুপ্রিম কোর্টের বাইরে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার সময় পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী শাহ মেহমুদ কুরেশি জানান যে এই পরিস্থিতিতে জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির বৈঠক ডাকা হতে পারে।
তিনি জানান প্রধান বিচারপতির বিশেষ ক্ষমতা অনুযায়ী তিনি সিদ্ধান্ত নেবেন যে জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির বৈঠক ডাকা হবে কিনা।
পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা কমিটিতে সামরিক বাহিনীর প্রধান এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রধান কর্মকর্তারা রয়েছেন।
রোববার পাকিস্তানের সম্মিলিত সামরিক বাহিনীর মহাপরিচালক জেনারেল বাবর ইফতিখার বলেছেন যে রোববার পাকিস্তানের সংসদে যা ঘটেছে তার সাথে সেনাবাহিনীর কোনো সম্পর্ক নেই।
পাকিস্তানের সংবিধানের ২২৪ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, অনুচ্ছেদ ৫৮ এর অধীনে সংসদ বাতিল হয়ে গেলে দেশের প্রেসিডেন্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেবেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেতার সাথে আলোচনা করে।
কিন্তু বিরোধী দলগুলোর জোট ও পিএমএল-এন নেতা শাহবাজ শরিফ জানিয়েছেন তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের আলোচনায় অংশ নেবেন না।
তিনি বলেছেন 'সংবিধানের লঙ্ঘনকারীদের যতক্ষণ পর্যন্ত শাস্তির আওতায় না আনা হচ্ছে' ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি আলোচনায় বসবেন না। ইসলামাবাদে সাংবাদিকদের সাথে আলোচনার সময় এ মন্তব্য করেন তিনি।
জেইউআই-এফ এর নেতা আসাদ মাহমুদও বলেছেন যে বিরোধী দলগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার মেনে নেবে না।
এরই মধ্যে পাকিস্তানের সাবেক তথ্যমন্ত্রী ফাওয়াদ চৌধুরী জানিয়েছেন যে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হিসেবে দুইজনের নাম পাঠিয়েছেন।
ফাওয়াদ চৌধুরীর মতে, আগামী ৯০ দিনের মধ্যে পাকিস্তানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
সূত্র : বিবিসি