১৯৯১ সালের ২৪ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ইউক্রেনের অভ্যুদয় ঘটে। আয়তনের দিক থেকে ইউক্রেন ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র। ইউক্রেনের আয়তন ক্রিমিয়াসহ ছয় লাখ তিন হাজার ৬২৮ বর্গকিলোমিটার। ক্রিমিয়ার আয়তন ২৭ হাজার বর্গকিলোমিটার। ইউক্রেনের জনসংখ্যা চার কোটি ৩৬ লাখ। জনসংখ্যার দিক হতে ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে এটির অবস্থান অষ্টম। ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ দেশটির উত্তরাংশে অবস্থিত। দেশটি তিন দিক হতে স্থল দ্বারা বেষ্টিত। এর দক্ষিণের পূর্বাংশে অনেকটা আবদ্ধ জলরাশির কৃষ্ণ সাগর ও আজভ সাগর। কৃষ্ণসাগর দুটি প্রণালী বসফরাস ও দার্দানেলেস দ্বারা ভূমধ্যসাগরের সাথে যুক্ত। উভয় প্রণালী তুরস্ক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। দেশটির দক্ষিণের পশ্চিমাংশে বিলুপ্ত ওয়ারশ জোটভুক্ত রোমানিয়া ও সোভিয়েত ইউনিয়ন হতে বিভক্ত মলদোভা, পূর্বে রাশিয়া, উত্তরে রাশিয়া ও সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রাক্তন প্রজাতন্ত্র বেলারুশ এবং পশ্চিমে বিলুপ্ত ওয়ারশ জোটভুক্ত পোল্যান্ড, হাঙ্গেরী ও চেকোস্লোভাকিয়া হতে বিভক্ত স্লোভেনিয়া।

ইউক্রেন প্রাচীনকালে স্কিথিয়ার অংশ ছিল। স্কিথিয়া ইউরোপ ও রাশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল সমন্বয়ে গঠিত। রাশিয়া বর্তমান বিশ্বের সর্ববৃহৎ রাষ্ট্র। ইউরোপ ও এশিয়া উভয় মহাদেশ ব্যাপী বিস্তৃত। ইউক্রেন প্রথম পূর্ব স্লাভিক রাজ্যের কেন্দ্র ছিল। ক্রিয়েভান রাশরা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ইউক্রেনের উত্থান। ক্রিয়েভান রাশরা মধ্য যুগে শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হলেও দ্বাদশ শতাব্দীতে এটি বহুধা বিভক্ত হয়ে যায়। চতুর্দশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে বর্তমান ইউক্রেন তিনটি বহিঃশক্তি গোল্ডেন হোর্ড, লিথুয়ানিয়া এবং পোল্যান্ডের অধীনে ছিল। পঞ্চদশ শতাব্দীতে ইউক্রেন পোল্যান্ড, লিথুয়ানিয়া ও ক্রিমিয়ার অধীনস্থ নয়। পরবর্তীতে ইউক্রেনের ওপর রাশিয়া ও অস্ট্রিয়ার আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। রুশ বিপ্লবের মাধ্যমে রাশিয়ায় জার সাম্রাজ্যের পতন হলে ইউক্রেন ১৯১৭-১৯২০ সাল অবধি সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য স্বাধীন রাষ্ট্রের পরিচিতি পায়। সোভিয়েত ইউক্রেনের মধ্যকার যুদ্ধে বলশেভিক লাল ফোজের নিকট ইউক্রেন পরাভূত হলে ইউক্রেন ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি প্রজাতন্ত্র হিসেবে পরিগণিত হয় এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গন অবধি এটি ইউনিয়নের সদস্য প্রজাতন্ত্র হিসেবে অন্তর্ভুক্ত থাকে।

ক্রিমিয়া রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের নিয়ন্ত্রণাধীন থাকাবস্থায় ১৯৫৪ সালে প্রশাসনিক সুবিধার্থে সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট ক্রুশ্চেভ ক্রিমিয়াকে ইউক্রেনের নিকট হস্তান্তর করেন। ২০ লাখ জনসংখ্যা অধ্যুষিত ক্রিমিয়ার ৫৮ ভাগের অধিক জনগোষ্ঠী রুশ বংশোদ্ভূত, ২৪ ভাগের অধিক ইউক্রেনীয় এবং ১২ ভাগের অধিক তুর্কি বংশোদ্ভূত ইসলাম ধর্মাবলম্বী ক্রিমীয় তাতার। সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্টেলিন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী প্রায় দুই লাখ ক্রিমীয় তাতারকে জামার্নির সহযোগী এ অজুহাতে ক্রিমিয়া হতে বিতাড়িত করেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গনের পর বিতাড়িত ক্রিমীয় তাতারদের একটি বড় অংশ পুনঃক্রিমিয়ায় প্রত্যাবর্তন করে পুনর্বাসিত হন। ক্রিমিয়ার বন্দরনগরী সেভাস্তোপোল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সারাবছর ব্যবহার উপযোগী একমাত্র উষ্ণ সমুদ্রবন্দর। ক্রিমিয়া ২০১৪ সালে রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত হয় এবং সে বছরই অনুষ্ঠিত গণভোটে অন্তর্ভুক্তি অনুমোদিত হয়।

দোনবাস দক্ষিণ-পূর্ব ইউক্রেনের একটি অঞ্চল। রুশ ভাষাভাষী অধ্যুষিত লোহানস্ক ও দোনেৎস্ক দোনবাস অঞ্চলে অবস্থিত। ক্রিমিয়া রাশিয়ার অন্তর্ভুক্তির পর হতেই লোহানস্ক ও দোনেৎস্কে অসন্তোষ দেখা দেয় এবং উভয়ের অধিবাসীদের মধ্যে ইউক্রেনের শাসন হতে বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। লোহানস্ক ও দোনেৎস্কের জাতিগত অসন্তোষ নিরসনে ইউক্রেন, রাশিয়া ও ওএসসিই (অর্গানাইনেশন ফর সিকিউরিটি এন্ড কোঅপারেশন ইন ইউরোপ) এর মধ্যে বেলারুশের রাজধানী মিন্সকে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পরবর্তীতে দেখা যায় চুক্তির শর্তসমূহ হতে ইউক্রেন সরে দাঁড়ায়। লোহানস্ক ও দোনেৎস্ক-এর আয়তন যথাক্রমে আট হাজার ৩৭৭ কিলোমিটার ও আট হাজার ৯০২ কিলোমিটার। লোহানস্কের জনসংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ অপর দিকে দোনেৎস্কের জনসংখ্যা ২৩ লাখের কিছু বেশি। ২০১৪ সাল পরবর্তী লোহানস্ক ও দোনেৎস্ক স্বঘোষিত স্বাধীন রাষ্ট্র। সাম্প্রতিক ইউক্রেনে রুশ আক্রমণের অব্যবহিত পর রাশিয়া লোহানস্ক ও দোনেৎস্ককে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। বর্তমানে লোহানস্ক ও দোনেৎস্কে রাশিয়ার সেনাবাহিনী অবস্থান গ্রহণ করেছে এবং তথায় রুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

ইউক্রেন দীর্ঘদিন যাবৎ ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্তির জন্য জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়া ইউক্রেনের ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্তির ঘোর বিরোধী। রাশিয়া মনে করে ইউক্রেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত হলে দেশটি তার সীমানা সংলগ্ন হওয়ার কারণে তার নিরাপত্তা মারাত্মকভাবে বিঘিœত হবে। রাশিয়ার দাবি ইউক্রেনের জনগোষ্ঠীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ জাতি ও সংস্কৃতিগতভাবে রুশ বংশোদ্ভূত ও ভাষাভাষী হওয়ায় তারা ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদীদের নিপীড়নের শিকার। এরা স্বাধীন সত্তা নিয়ে বাঁচতে চায় অথবা রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত হতে যায়।

ইউক্রেনের চতুর্থ প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচকে রুশপন্থী হিসেবে অভিহিত করা হয়। তিনি ২০১০ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হন। তিনি প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন ইউরোপীয় অ্যাসোসিয়েশন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হওয়া বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করায় জনমত তার বিপক্ষে চলে যায়। এ বিষয়টি নিয়ে দেশটিতে ব্যাপক গণঅসন্তোষ দেখা দেয় যা গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়। গণঅসন্তোষের এক পর্যায়ে ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ দেশ ত্যাগ করে রাশিয়ায় আশ্রয় গ্রহণ করেন।

ইউক্রেনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি বিপুল জনসমর্থন নিয়ে দেশটির প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হন। নির্বাচিত হওয়া পরবর্তী তিনি ইউক্রেনের ন্যাটোভুক্তি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্তি বিষয়ে স্পষ্ট অবস্থান গ্রহণ করলে পার্শ্ববর্তী রাশিয়া বিষয়টিকে তাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি বিবেচনায় তাকে তার অবস্থান হতে সরে আসার আহবান জানায়। ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত রাষ্ট্রসমূহের মদদে বলীয়ান জেলেনস্কি রাশিয়ার আহবানে কর্ণপাত না করে বিষয়টিকে অবজ্ঞা ও উপেক্ষার চোখে দেখতে থাকেন। ন্যাটোর ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর প্রধানদের নিকট হতে জেলেনস্কি আশ্বস্ত হয়েছিলেন যে, রাশিয়ার যেকোনো আগ্রাসন তিনি ও তার দেশ ন্যাটোর সরাসরি হস্তক্ষেপে রুখে দিতে পারবে।

রাশিয়া জল ও স্থল তিনদিক থেকে সৈন্য সমাবেশের মাধ্যমে ইউক্রেনকে প্রথমত অবরুদ্ধ এবং পরবর্তীতে দেশটিতে সরাসরি সশস্ত্র অভিযান পরিচালনা করলে প্রবল পরাক্রমশালী রাশিয়ার শক্তিমত্তার কাছে ইউক্রেনের অসহায়ত্ব প্রকাশ পায়। ন্যাটোভুক্ত রাষ্ট্রসমূহ রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে সরাসরি সম্পৃক্ত হলে তা পারমাণবিক যুদ্ধে বিজড়িত হওয়ার ক্ষেত্র সৃষ্টি করবে এমন আশঙ্কায় ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির শত অনুনয়-বিনয় সত্ত্বেও ন্যাটোভুক্ত রাষ্ট্রসমূহ সরাসরি হস্তক্ষেপের পথে অগ্রসর হয়নি। ইউক্রেন রাশিয়ার অভিযানের পূর্ব হতেই ন্যাটোভুক্ত রাষ্ট্রসমূহ হতে আধুনিক সামরিক সরঞ্জামাদি প্রাপ্ত হয় এবং দীর্ঘদিনযাবৎ ন্যাটোর সামরিক প্রশিক্ষকরা ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের এসব আধুনিক সামরিক সরঞ্জামাদি পরিচালনার প্রশিক্ষণ প্রদান করে।

সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙনের অন্যতমদের একজন সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র ইউক্রেনের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ও পরবর্তীতে স্বাধীন ইউক্রেন রাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট লিওনেদ ক্রাভচুক শুরু থেকেই ইউক্রেনে বসবাসরত রুশ বংশোদ্ভূত ও ভাষাভাষীদের স্বার্থের পরিপন্থী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ইউক্রেনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি তার পদাঙ্ক অনুসরণপূর্বক রাশিয়ার রাজনৈতিক স্বার্থের পরিপন্থী কঠোর নীতি গ্রহণ করে ন্যাটো জোট ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্প্রসারণে উদ্যোগী হন।

স্নায়ুযুদ্ধকালীন ন্যাটোর পাল্টা জোট হিসেবে ওয়ারশ জোট আত্মপ্রকাশ করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর ওয়ারশ জোট অবলুপ্ত হয়। ওয়ারশ জোট অবলুপ্ত হওয়ার পর বিশ্বের সচেতন ও সাধারণ জনমানুষের প্রত্যাশা ছিল ওয়ারশ জোটের ন্যায় ন্যাটো জোটও অবলুপ্ত হবে। কিন্তু নির্মম বাস্তবতা বিশ্ববাসী এর উল্টোটি প্রত্যক্ষ করলো। ন্যাটো জোট অবলুপ্ত না হয়ে ১২ সদস্যবিশিষ্ট ন্যাটো আজ ৩০ সদস্যবিশিষ্ট ন্যাটোতে সম্প্রসারিত হলো। এ সম্প্রসারণ প্রক্রিয়ার অংশ হতেই রাশিয়া কর্তৃক ইউক্রেন আক্রমণের উদ্ভব। ইউক্রেন ন্যাটোভুক্ত হলে রাশিয়া যে দৃষ্টিকোণ হতে তার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন মার্কিন সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্সও একই মনোভাব পোষন করে। তার অভিমত হল যুক্তরাষ্ট্রের সীমানা সংলগ্ন মেক্সিকোতে রাশিয়া পারমানবিক মারণাস্ত্র মোতায়েন করলে যুক্তরাষ্ট্র কি তা মেনে নিবে!
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙন পরবর্তী যে অখণ্ড ইউক্রেন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে এটি কখনো বর্তমান বিশাল ভৌগোলিক আয়তন নিয়ে অখণ্ড রাষ্ট্র ছিল না। ইউক্রেনের সোভিয়েত ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্তি এটিকে দীর্ঘকাল মাঝপথে ক্রিমিয়ার অন্তর্ভুক্তিসহ নিজ স্বাতন্ত্র ও স্বকীয়তা বজায় রেখে ইউনিয়নের আত্মমর্যাদাশীল প্রজাতন্ত্রে সমাসীন করে।

ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ সুদূর অতীত হতে ঐতিহাসিকভাবে সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত দিক হতে রাশিয়ার সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত ছিল। দেশটিতে বর্তমানে রুশ ভাষাভাষী ও ইউক্রেনীয় ভাষাভাষীদের মধ্যে যে বিরোধ তার মূলে রয়েছে দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার দ্বন্দ্ব। যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের উচ্চাভিলাষী প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে মাঠে নামিয়ে যে মরীচিকার পিছনে ধাবমান করেছে। তা রাশিয়ার আগ্রাসনের পথ করে দিয়েছে। ফলে দেশটি অখন্ড থাকবে কি না তা নিয়ে সংকট সৃষ্ট হয়েছে। শেষ পর্যন্ত সেটা কতদূর গড়ায় আমরা জানি না।

লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক

E-mail: iktederahmed@yahoo.com