নেহরু ও কাশ্মিরে অশান্তি

গৌতম দাস | Apr 02, 2022 06:03 pm
নেহরু

নেহরু - ছবি : সংগ্রহ

 

কাশ্মিরের সব অশান্তির শুরু ১৯৪৭ সাল থেকেই। কাশ্মিরের প্রাক্তন রাজা হরি সিং ভারতে অন্তর্ভুক্ত ও বিলীন হয়ে যাওয়ার কাগজে সই করার উপযুক্ত অথরিটি বলে মনে করেন ভারতের প্রায় সব রাজনীতিবিদ। আর রাজনীতিবিদদের এমন মনে করার বাইরে বিশ্ববিদ্যালয় বা একাডেমিকেরা ভিন্ন আর কিছু জানেন কিনা তাও জানা যায় না। বরং সারা ভারত এক মিথ্যা জাতিবাদী জোশে ভুগতে দেখা যায় যে, ব্রিটিশ কলোনি দখলদারেরা নাকি স্বদেশী আন্দোলনের নামে জমিদার হিন্দুর সন্ত্রাসবাদ বা কংগ্রেসের আন্দোলনে মুখে টিকতে না পেরেই ভারত ত্যাগ করেছিল। অথচ এ কথা শতভাগ মিথ্যা। ফ্যাক্টস হলো, কেবল ব্রিটিশরা নয়, সারা দুনিয়া থেকে সব কলোনি শাসকই ১৯৪৫ সালে বিশ্বযুদ্ধ থামার পরে স্ব স্ব কলোনি ছেড়ে স্বেচ্ছায় নিজ নিজ দেশে চলে গিয়েছিল। আর তারা ত্যাগ করে চলে গিয়েছিল যে কারণে ঠিক সেই একই কারণে, রাজা হরি সিংসহ তার মতো কোনো রাজারই ভারতে অন্তর্ভুক্ত ও বিলীন হবার কোনো কাগজ-দলিলে স্বাক্ষর করার অথরিটিই ছিল না। আর এসব কিছুর পেছনে মূল কারণ হলো ‘আটলান্টিক চার্টার’ চুক্তি। এটাকে বলা যায়, আমেরিকার সাথে কলোনি দখলদার ইউরোপের চুক্তি। এই চুক্তিতে বিশ্বযুদ্ধ শেষে ইউরোপের কলোনি দখলদারেরা বিনা শর্তে দখলদারি ছেড়ে চলে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। আর এই শর্তেই আমেরিকা হিটলারের বদলে ব্রিটিশ-ফরাসি ইত্যাদি মিত্রশক্তির পক্ষ নিয়ে বিশ্বযুদ্ধে প্রথম যোগ দিতে সম্মত হয়েছিল। এতে ফেলে যাওয়া কলোনির কোনো রাজার আর কোনো অথরিটিই নেই, থাকবে না যে, সে ওই দেশকে নিয়ে নিজ খেয়ালে অন্য কোনো দেশের ভিতর যোগ দেয়। ওই দেশ কার দ্বারা শাসিত হবে, এর একমাত্র নির্ধারক হবে ওই ভূখণ্ডের জনগণ বা পাবলিক। ফলে তা নিজ পাবলিক ভোটের সম্মতিতে এক স্বাধীন রিপাবলিক রাষ্ট্র হতে পারে। ব্রিটিশরা চলে গেলে কাশ্মিরেরও এমন হবার কথা।

কিন্তু নেহরু কখনো এমন আটলান্টিক চার্টার চুক্তির কথা জানতেন, এর চিহ্ন-প্রমাণ পাওয়া যায় না। এমনকি এই চুক্তি-ই যে, জাতিসঙ্ঘের জন্ম ঘোষণার ভিত্তি- দলিল সেটাও নেহরু জানতেন এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না। বরং উলটা প্রমাণ আছে। এসবেরই ফলাফলে নেহরু কাশ্মিরকে জবরদস্তিতে ভারতের অংশ করে রাখার পক্ষে জোড়াতালি কিছু কাজ করে যান। কাশ্মিরের সব সমস্যার শুরু এখান থেকে।

দ্বিতীয় বড় ফ্যাক্টস হলো, জম্মু-কাশ্মির মিলে ২০১১ সালের হিসাবে মোট জনসংখ্যা প্রায় ১.৩ কোটি যার ৬৮.৩% হলো মুসলমান আর হিন্দুরা ২৮.৪; বাকিটা অন্যান্য। আর ভারত রাষ্ট্রের জন্ম থেকেই হিন্দু-মুসলমান সমস্যা যেটা সেটাই কাশ্মিরের উপরেও ভর করেছিল যদিও তা অনেক পরে ১৯৮৭ সালের আগে-পরে।

অর্থাৎ ভারতের ‘আদি পাপ’ হলো, সব নাগরিকদের সমান অধিকারের রাষ্ট্র হবে, সে হবে না। মানে অধিকারভিত্তিক নাগরিক রাষ্ট্র তা হবে না। বরং ধর্মভিত্তিক জাতি-রাষ্ট্র হতে হবে। আর যে ধর্মের লোক সংখ্যায় বেশি মানে হিন্দুরা এরাষ্ট্রে আধিপত্য নেবে।

যেমন সাম্প্রদায়িক শব্দটাকে ভাঙেন, যে শব্দটা দুনিয়ার আর কোনো রাষ্ট্রে নেই। আর এ শব্দের আসল অর্থ হলো, হিন্দু আধিপত্যের স্বার্থে ডিফাইন করা সীমার মধ্যে মুসলমানদের বসবাস, জীবনযাপন করতে হবে। মুসলমানেরা ধর্মীয় চিহ্ন প্রদর্শন করে চলতে পারবে না। যদি তা না অনুসরণ করে তবে ওসব মুসলমানকে ‘সাম্প্রদায়িক’ বলে নিন্দা করা হবে। বিপরীতে যেসব মুসলমান তা মানবে, মানে হিন্দু আধিপত্য কর্তৃত্ব মেনে নেবে তাদের মানার শর্তেই তারা হিন্দুদের পাশে সমাজে মানে যেমন স্কুলে অফিসে পাশে বসতে দেয়া হবে। আর তাতে এসব মুসলমানরা ‘অসাম্প্রদায়িক’ বলে গণ্য হবে।

যেমন মোগল আমলে সাম্প্রদায়িক শব্দটা নেই। তখন হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার কথাও জানা যায় না। কিন্তু ব্রিটিশ আমলে বেশির ভাগ জমিদারি হিন্দুরা নেওয়াতে (যে জমিদারি মানে, ব্রিটিশ শাসকের নিচে ওই সমাজের নিয়ামক শক্তি ) এবার তারা তাদের আধিপত্য (ধর্মীয় পরিচয়ে আধিপত্য) চালু করেছিল। আসলে হিন্দু জাতিবাদের ভিত্তিতে হবু ভারত গড়তে হবে-কংগ্রেসের এই নীতির ভিত্তিতে জন্ম- এটাই ক্রমশ ওই জমিদার-হিন্দু আধিপত্যের পক্ষে সাফাই হিসাবে হাজির হয়েছিল।

এখন কাশ্মিরকে ভারতের অঙ্গীভূত করার পরেও নেহরু শান্তিতে থাকতে পারেননি। সারা ভারতে মোট মুসলমান মাত্র প্রায় ১৫% তবে কোথাও কোথাও মানে, রাজ্যে বা শহরে তা বড়জোর ২৫-৩০ %। ফলে সহজেই হিন্দু আধিপত্য মানে হিন্দু সামাজিক-রাজনৈতিক আধিপত্য কায়েম রাখা সহজ ছিল যদিও তা সমাজে সব ধরনের নাগরিক অসাম্যের প্রধান উৎস।

কিন্তু ভারতের এই হিন্দু শাসকেরাই তাদেরই আধিপত্যের তত্ত্ব মুসলমানরা কেমন অনুভব করে তা কাশ্মিরে টের পেয়েছিলেন, ওই একই তত্ত্ব কাশ্মিরে তাদের বিপক্ষে। কারণ কাশ্মিরে মুসলমানেরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। এরই প্রধান প্রকাশ ঘটেছিল ১৯৮৭ সালের (প্রাদেশিক বা অ্যাসেম্বলি) নির্বাচনে। কারণ তত দিনে কাশ্মিরের অতিষ্ঠ মুসলমানরা, তাদের ব্যক্তি বা সামাজিক-রাজনৈতিক দল বা গ্রুপগুলো একজোট হয়ে মুসলিম ইউনাইটেড ফ্রন্ট (এমইউএফ) গড়ে ওই নির্বাচনে লড়ে ক্ষমতা নিতে তৈরি হয়েছিল। এই এমইউএফ ছিল ১৯৮৪ সালে গড়ে তোলা প্রথম ভ্রুণ এক ছাত্র সংগঠন যার নাম ছিল ইসলামী স্টুডেন্ট লীগ। আসলে ভারতের আধিপত্য তত্ত্ব অনুসারে, কাশ্মিরে হবু মুসলমান আধিপত্য দেখে তারা প্রমাদ গুণে বিপদ বুঝতে পারে আর এটা তারা মেনে নিতে পারেনি।
মূল কারণ নাগরিক অধিকারভিত্তিক রাষ্ট্র হলে সেখানে ধর্মীয় বা সব ধরনের পরিচয় নির্বিশেষে সবাই সমান নাগরিক হয়ে থাকতে পারে আর নাগরিকের যদি সবাই সম-অধিকারের নাগরিক হয়, কারো কারো আধিপত্যের আলাপ সেখানে থাকে না। কিন্তু বাস্তবের ভারত ছিল এর বিপরীত। হিন্দু-জাতিবাদী কংগ্রেসের হাতে পড়ে সেটা হিন্দু আধিপত্যের ভারত হয়ে উঠেছিল। আর তা একইভাবে কাশ্মিরের মুসলমানরা অনুসরণ করতে গেলে হিন্দুদের জন্য সব বিপদ ঘনিয়ে ওঠে।

এই বার্তাটা কাশ্মির জাতীয় কংগ্রেসের নেতা ফারুক আবদুল্লাহ নজর করেন। কারণ তিনি এমইউএফ-এর ভিতরের নেতা ও দল নন। তিনি ততকালের বিষয়টাকে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর কানে তোলেন; সাথে আলাপ করেন এই এমইউএফ-এর উত্থান ঠেকাতে। তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ব্যাপক হলেও সরাসরি নির্বাচনী কারচুপি করেই তারা এই উত্থান ঠেকাবেন। ওই নির্বাচনের ভোটদানের পরেই এমইউএফের প্রায় সব নেতাকর্মীকে তারা গ্রেফতার করেন আর পরে প্রতিটা কেন্দ্রের ফলাফল ওই দিন দূরে থাক সপ্তাহ-দশদিন পরে ইচ্ছামতো ঘোষণা করেছিলেন। আর এখান থেকে কাশ্মিরের রাজনীতি আর প্রকাশ্য রাজনীতি ও নির্বাচনে সীমাবদ্ধ থাকেনি। পরের বছর ১৯৮৮ সাথে সারা কাশ্মির সশস্ত্র রাজনীতিতে চলে যায়। তার পর থেকে কাশ্মিরে নির্বাচনের আর কোনো গুরুত্ব থাকেনি। কংগ্রেস-বিজেপির ভাষায় যা ‘জঙ্গিবাদ’ হয়ে যায়। আর বিজেপির বাজপেয়ি নতুন বয়ানে হাজির হলেন। তিনি কংগ্রেসের হাতে নির্বাচনী কারচুপি করে রাজনীতিকে সশস্ত্রতার দিকে ঠেলে দেয়া ভুলে গেলেন, অস্বীকার করলেন। আর এক নয়া বয়ান হাজির করলেন যে, কাশ্মিরের সব সমস্যার উৎস ‘সীমা পার কী আতঙ্কবাদ’- মানে কাশ্মিরের সব সমস্যার উৎস নাকি পাকিস্তান থেকে আসা টেরোরিজম!


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us