গোয়াদর বন্দর নিয়ে জটিলতা
গোয়াদর বন্দর নিয়ে জটিলতা - ছবি : সংগ্রহ
গোয়াদর শহরের মাস্টারপ্ল্যান এমন করে সাজানো হয়েছে যেন সারা বিশ্বের বিনিয়োগকারীদের কাছে বন্দর ও শহরটি খুব আকর্ষণীয় স্থান হয়। তখন সংশ্লিষ্ট মহল বলতে শুরু করে অদূর ভবিষ্যতে গোয়াদর দুবাইকেও ছাড়িয়ে যাবে!
চায়না পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর বা সিপিইসির পাকিস্তান প্রধানমন্ত্রীর নিয়োজিত বিশেষ সহকারী খালিদ মনসুর সম্প্রতি প্রেস ব্রিফিংয়ে এই তথ্য জানান। যদিও কাজ এখনো অনেক বাকি। গোয়াদরে পানি সরবরাহ ও বিদ্যুতের সমস্যা রয়েছে, দ্রুতগতিতে সেগুলো সমাধানের কাজ চলছে। আগামী বছরে এখানে দু’টি পৃথক ট্রান্সমিশন লাইন থেকে প্রায় ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে; একই সাথে চীনের সহায়তায়, স্থানীয়দের জন্য সামাজিক উন্নয়ন তহবিলের অধীনে গোয়াদরের আশেপাশের তিন সহস্রাধিক বাড়িতে সৌর প্যানেলের মাধ্যমে বিদ্যুতায়ন করার কাজ সম্পন্ন হবে। গোয়াদরের কাজগুলো মনে হয় যেন কোথাও কোথাও থমকে দাঁড়ায়। রাজনৈতিক, আঞ্চলিক বিরোধ এবং সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর আক্রমণ, বিদেশী গুপ্তচরদের সহায়তা সব মিলে গোয়াদর বন্দরের সার্বিক কাজে সঙ্কট দেখা দিচ্ছে বারবার।
সিপিইসি, পাবলিক সেক্টর ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম এবং পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের আওতায় অনেকগুলো প্রকল্প এগিয়ে চলছে। উল্লেখ্য, থর কয়লা প্রকল্পেও স্থানীয়দের উন্নত জীবনের জন্য অনেক কিছু করা হয়েছে এবং থর কয়লাখনি ও থর বিদ্যুৎ প্রকল্পের আশেপাশের অঞ্চলে এখন বড় পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। এসব কাজে নিজেদের প্রযুক্ত শ্রম ছিল; তারই আলোকে আরো আপগ্রেডেড ভার্সন গোয়াদরে প্রয়োগ করা হয়েছে। গোয়াদরকে মিরানি বাঁধের সাথে সংযুক্ত করার জন্য পানি সরবরাহ ব্যবস্থা তৈরি করা হচ্ছিল। গোয়াদরের স্থানীয়দের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ছিল সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার।
২০১৫ সালে সিপিইসির ফেজ-১ শুরু হয়েছিল এবং নির্ধারিত সময়ে শেষও হয়েছিল। প্রাথমিকভাবে এটি পাকিস্তানে বিদ্যুতের ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে এবং অবকাঠামো উন্নত করার উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল। এখন পর্যন্ত, থর কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও নবায়নযোগ্য শক্তির অন্যান্য উৎস থেকে জাতীয় পুলে পাঁচ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যুক্ত করা হয়েছে। এখন কর্র্তৃপক্ষ বিদ্যুৎ সহজলভ্যকরণ ও বেসরকারি খাতকে শিল্পায়নের দিকে নিবিষ্ট করতে মনোনিবেশ করতে সচেষ্ট হচ্ছে।
২০১৩ সালে, কোনো দেশ বা প্রতিষ্ঠান থর কয়লা প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য এগিয়ে আসেনি এবং সিপিইসির মাধ্যমে পাকিস্তান চীনকে এই মেগা প্রকল্পে অর্থায়ন ও অংশীদার হতে রাজি করিয়েছিল। এ ছাড়াও, থর কয়লা ও গোয়াদর উন্নয়ন প্রকল্প, বন্দরসহ, সিপিইসির অধীনে আরো দু’টি মেগা প্রকল্প ইসলামাবাদ থেকে অপটিক ফাইবার কেবল এবং পেশোয়ার থেকে করাচি পর্যন্ত এমএল-১ রেলপথ স্থাপন করেছিল। সিপিইসি কর্মসূচির চারটি অংশ ছিলÑ ২০১৫ সালকে শক্তি ও অবকাঠামো উন্নয়নের সময়; ২০২০ সালকে বাজার চাষের সময়; ২০২৫ সালকে সম্প্রসারণ ও উন্নয়নের সময় হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছিল, যেখানে ২০৩০ সাল ছিল প্রকল্প পূর্ণ বাস্তবায়ন সময়কাল এবং টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সেই প্রক্রিয়াটি এখন বিকশিত হওয়ার অপেক্ষায় থাকলেও দুরাশার কালো মেঘও দেখা যাচ্ছে।
সিপিইসির অধীনে দেশের ৯টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে দ্রুত উন্নয়ন করার কথা। চীনা বিনিয়োগ ও প্রযুক্তি হস্তান্তরের মাধ্যমে শিল্প, প্রযুক্তিগত ও কৃষিবিপ্লব আনয়নের মাধ্যমে সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে সিপিইসির দ্বিতীয় পর্যায় চালু করা হয়েছে। সিপিইসি ধারণাকে বাস্তবে রূপান্তরিত করার জন্য বিভিন্ন খাতের জন্য ১০টি যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ তৈরি করা হয়েছে। চীন পাকিস্তানকে একটি আন্তর্জাতিক উৎপাদনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে চায়। আর চীনের বেল্ট-রোড উদ্যোগটি বিশ্বের ৬২ শতাংশ জনসংখ্যার তিনটি মহাদেশের ৬৮টি দেশকে অন্তর্ভুক্ত করেছে।
গেল বছরের শেষের দিকে, গত ডিসেম্বরে গোয়াদরের স্থানীয়রা আওয়াজ তোলে ‘গোয়াদরের হক দাও’। ‘গোয়াদরের অধিকার দাও’। এসব দাবির মধ্যে ছিল- স্থানীয় জেলেদের জীবন-জীবিকাকে ধ্বংস করে দেয়া অবৈধ ট্রাভেলিংয়ের অবসান, নিকটবর্তী ইরানের সাথে বাণিজ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা শিথিল এবং শহরের নিরাপত্তা চেক পয়েন্টগুলোর কাজ আরো সহজতর করা।
বিক্ষোভটি ধর্মনিরপেক্ষ জাতিগত জাতীয়তাবাদীদের দ্বারা প্রভাবিত একটি এলাকায় একজন মধ্যপন্থী ইসলামী রাজনীতিবিদের নেতৃত্বে পরিচালিত হয় এবং বিপুল সংখ্যক নারী ও শিশু এতে জোগদান করে যা ছিল অচিন্তনীয়।
আরব সাগর বরাবর পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশে অবস্থিত- হরমুজ প্রণালীর বাইরে এবং ইরান থেকে কয়েক ডজন মাইল দূরে, গোয়াদরকে বেল্ট অ্যান্ড রোড-সংযুক্ত চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর, সিপিইসির একটি মূল কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ধরা হয়েছে। কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, গোয়াদর ও সিপিইসি চীনের স্থলবেষ্টিত জিনজিয়াং অঞ্চলকে ভারত মহাসাগরে একটি আউটলেট সরবরাহ করে এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক ভূকৌশলে রূপান্তরিত করবে। কিন্তু গোয়াদরের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনায়, শহরের আদিবাসী জাতিগত বালোচ জনগোষ্ঠী সবসময় সুযোগের মূল ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে।
শরিক দল জামুরিওয়াতান পার্টির নেতা শাহজান বুগতির যাকে বিশেষ সহকারীর পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল তিনি ইমরানের বেলুচিস্তান পুনরেত্রীকরণ বিষয়ক বিশেষ সহকারীর দায়িত্ব পালন করছিলেন। সরে দাঁড়ানোর কারণ হিসেবে নিজের প্রদেশে উন্নয়নে ঘাটতির কথা বলেন। প্রশ্ন হলো- তাকেই তো উন্নয়নের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল, তিনি কি কি কাজ করেছেন?
ইমরান খান এক বার্তায় বলেছেন, গোয়াদরের কঠোর পরিশ্রমী জেলেদের ন্যায্য দাবির বিষয়টি তিনি লক্ষ করেছেন। ট্রলারে অবৈধ মাছ ধরার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার অঙ্গীকারও তিনি করেছেন।
স্থানীয় মৎস্যজীবীদের পাকিস্তানি ও চীনা উভয় অর্থনৈতিক শক্তির কাছে অস্তিত্বের হুমকি বলে সুবিধাভোগী নেতারা প্রচার করছেন। তারা আরো বলেন, চীন জাদুকরীভাবে এই ছোট, ‘ব্যাকওয়াটার’ মাছ ধরার শহরটিকে আঞ্চলিক সংযোগের একটি অপরিহার্য কেন্দ্রে রূপান্তরিত করে ফেলেছে।
১৯৫৮ সালে ওমানের কাছ থেকে গোয়াদর কেনার পর কয়েক দশক ধরে, পাকিস্তান তার জনসংখ্যা-কেন্দ্র থেকে অনেক দূরে এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে, একটি বাণিজ্যিক বন্দর বা নৌঘাঁটি বিকাশের জন্য বিদেশী অংশীদার চেয়েছে। প্রথমে মস্কো এবং পরে ওয়াশিংটনের সাথে যোগাযোগ করে ইসলামাবাদ! তারা রাজি হয়নি। ২০০১ সালে বেইজিং বন্দরের প্রাথমিক উন্নয়নকে অর্থায়ন করতে সম্মত হয়েছিল।
সে সময় পাকিস্তানি কর্মকর্তারা গর্ব করে বলতেন, গোয়াদর এই অঞ্চলে পরবর্তী দুবাই বা সিঙ্গাপুর হয়ে উঠবে। ২০১৩ সালে, একটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চীনা কোম্পানি এই দায়িত্ব গ্রহণ করে। তখন পাকিস্তানি কর্মকর্তারা চীনা শহর শেনঝেনের পোর্ট-পার্ক-সিটি মডেলের একটি প্রতিলিপি করার কথা বলতে শুরু করেন।
আট বছর পর, গোয়াদর তার কথিত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের কাছাকাছি কোথাও নেই। অথচ এই সময়ের মধ্যে, চীনা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংস্থাগুলো গ্রিসের পিরিয়াস ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের খলিফার মতো বন্দরগুলোকে রূপান্তরিত করতে সহায়তা করেছে। এর বিপরীতে, গোয়াদরে উল্লেøখযোগ্য কিছু হয়নি। বন্দরটিকে সরাসরি জাতীয় মহাসড়ক নেটওয়ার্কের সাথে সংযুক্ত করার জন্য একটি বাইপাস এ বছর কোনো এক সময় শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
গোয়াদরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সূচকগুলো দুর্বল। বন্দরে শিপিং ও শিল্প কার্যক্রম নগণ্য এবং গোয়াদরের বেশির ভাগ অধিবাসীর জন্য, পরিস্থিতি অপরিবর্তিত। পানীয় জলের অভাব রয়েছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ- ইরান থেকে আমদানি করা, অপর্যাপ্ত এবং গ্রীষ্মে ভঙ্গুর। এখানে অর্থনীতির মূল ভিত্তিগুলো একই রয়ে গেছে- মাছ ধরা, ইরান থেকে ডিজেল জ্বালানির চোরাচালান ও মাদক পাচার!
পাকিস্তানের এই বিচ্ছিন্ন শহরটিকে রূপান্তরিত করার পরিবর্তে, চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ কেবল বড় প্রত্যাশা ও আরো হতাশা সৃষ্টি করেছে। পরিশেষে, এই ব্যর্থতার দায় পাকিস্তান রাষ্ট্রের ওপর ফেলেছে; এই জন্য যে, মৌলিক ত্রুটিযুক্ত কৌশল সরকার গ্রহণ করেছিল, যেখানে অনেক কিছু অনুমানের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত হয়েছিল যা পরবর্তীতে ভুল প্রমাণিত হয়েছে।
পাকিস্তান ধরে নিয়েছিল যে, গোয়াদর চীনা স্বার্থের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে মালাক্কা প্রণালীর মাধ্যমে আমদানি করা শক্তির ওপর নির্ভরতা কাটিয়ে উঠতে বেইজিংকে সহায়তা করা। কিন্তু ২০২০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেভাল ওয়্যার কলেজের একটি গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, এমনটা সঠিন নয়। জিবুতি, কেনিয়া এবং শ্রীলঙ্কার মতো পাকিস্তান ধরে নিয়েছিল যে, চীনের শেনঝেন বা শেকো মডেলটির মতো এটি কাজ করবে। মূলত, চীন একটি কর্তৃত্ববাদী, শ্রেণিবদ্ধ, উন্নয়নমূলক রাষ্ট্র। পাকিস্তান একটি আধা-গণতান্ত্রিক, বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্র যা উপর থেকে নিচে অপরাধ ও অযোগ্যতার কারণে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, গোয়াদরের জন্য পাকিস্তানের কৌশল বেলুচিস্তানের জন্য অনুপযুক্ত। গোয়াদরে খুব কম অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে যা আসলে স্থানীয়দের কাছে চলে গেছে। এটি পাকিস্তানের দরিদ্রতম অথচ বৃহত্তম প্রাকৃতিক গ্যাসক্ষেত্রের আবাসস্থল। এলাকাটি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে একাধিক বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহ প্রভাবিত করেছে। বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলো অন্যান্য প্রদেশেও নাগরিকদের লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে, সে প্রক্রিয়া চলমান।
গোয়দরে ২০১৭ সালে একটি বিলাসবহুল রিয়েল এস্টেট ডেভেলপারসহ চীনা নাগরিকদের প্রবাহ বালুচদের ভয়কে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। চীনারা নিজেদের নিরাপত্তা নিজেদের হাতে রাখতে চায়। পার্শ্ববর্তী সিন্ধু প্রদেশ এবং চীন থেকে মাছ ধরার ট্রলারের সংখ্যা বৃদ্ধি স্থানীয় আয়কে অনেকটা ধ্বংস করে দিচ্ছে। সিপিইসির অধীনে গোয়াদরের মূল পরিকল্পনায় কিছু প্রশংসনীয় সামাজিক খাতের প্রকল্প ছিল। চিকিৎসাকেন্দ্র, মাধ্যমিক বিদ্যালয় সম্প্রসারণ, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, মেডিক্যাল হাসপাতাল এগুলো আরো দরকার।
ইসলামাবাদ শহরের প্রাকৃতিক সুবিধার ভুল মূল্যায়নের ওপর ভিত্তি করে গোয়াদরের জন্য তার পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছিল। এটি গোয়াদরকে একটি ‘গেটওয়ে পোর্ট’ হিসেবে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, মধ্য এশিয়ার অন্যান্য দেশ ও জিনজিয়াংকে সংযুক্ত করবে। সমালোচকরা বলছেন, পাকিস্তানের নিজস্ব করাচি ও কাসিম বন্দর অনেক কম খরচে উন্নয়ন এবং উপযোগী করা যেত।
তবে, বিজ্ঞানীরা বলছেন, গোয়াদর বন্দরকে ২০ মিটার গভীরতায় ড্রেজ করলে, ট্রান্সশিপমেন্টের জন্য সম্ভাব্য কার্যকর অবস্থান তৈরি হবে- খুব বড়, সাশ্রয়ী মূল্যের জাহাজগুলোকে অগভীর আঞ্চলিক বন্দরগুলোতে পরিষেবা প্রদানকারী ছোট জাহাজগুলোতে লোড করার জন্য কার্গো অফলোড করার সুবিধা দেবে। প্রকৃতপক্ষে, যে পরামর্শক সংস্থা বন্দরের জন্য মূল মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করেছিল, তারা মূল্যায়ন করেছিল যে, গোয়াদরের মাধ্যমে মধ্য এশীয় প্রজাতন্ত্রগুলোর সাথে ট্রানজিট বাণিজ্যের সম্ভাবনা আছে তবে ট্রান্সশিপমেন্টের জন্য দীর্ঘমেয়াদে কার্যক্রম দরকার।
২০১৮ সালে একটি এক্সপ্রেসওয়ের বিরুদ্ধে জেলেরা বিক্ষোভ করে। কারণ, এটি সমুদ্রে জেলেদের প্রবেশ বন্ধ করে দেয়। তারা সরকারের প্রতিশ্রুতি বিশ্বাস করে না। স্পষ্টত রাজনৈতিক নেতারা পেছনে জেলে সংগঠনদের ব্যবহার করছেন।
বেলুচিস্তানে নিরাপত্তা বাহিনীর জোর তৎপরতা বিদ্যমান। বড় আকারের বিক্ষোভ এবং অস্থিরতার কারণে সেনাসদস্যরা সক্রিয়। বালুচ বিদ্রোহে নয়াদিল্লির হাত রয়েছে বলে আইএসআই এক প্রকার নিশ্চিত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গোয়াদরে বড় বড় হামলা চালানো হয়েছে। বিদেশী কমান্ডো ছাড়া স্থানীয়রা এরকম হামলা করতে পারে না। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার সুযোগপ্রাপ্ত কিছু ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের ভারী কভারেজও পাকিস্তানি নিরাপত্তা পরিষেবাগুলোর উদ্বেগকে উসকে দিয়েছে।
গোয়াদরের বিক্ষোভকারীদের আর্তনাদ ইসলামাবাদের জন্য একটি জাগরণের আহ্বান হিসেবে কাজ করা উচিত। যদিও ২০১৯ সালে গোয়াদরের প্রধান হোটেলে হামলাসহ সন্ত্রাসী হামলাগুলো বিদেশী বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করছে। বালুচিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য নতুন কৌশল তৈরি করে ইসলামাবাদকে সহিংসতার চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সিপিইসির দক্ষিণ বেলুচিস্তানের জন্য একটি শক্তিশালী পুনর্বণ্টন নীতি প্রয়োজন। ইসলামাবাদ ও কোয়েটা শহরের প্রাদেশিক বেলুচিস্তান সরকারের উচিত গোয়াদর এবং মাকরান উপকূলীয় অঞ্চলের অধিবাসীদের জন্য একটি সম্পদ তহবিল তৈরি করা, যা তাদের শক্তি ও খনি শিল্পের রয়্যালটি থেকে প্রাপ্ত বার্ষিক মৌলিক আয় এবং বিলাসবহুল রিয়েল এস্টেট ও পর্যটনের ওপর করের ব্যবস্থা করবে।
আন্দোলনকারী নেতারা বলছেন ‘বসতি স্থাপনকারীরা’ দিন দিন সংখ্যায় বাড়ছে এবং স্থানীয়রা সংখ্যালঘু হয়ে যাচ্ছে। গোয়াদরের আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে তাদের নিজ নিজ স্থানে উপসাগরীয় আরবদের অনুরূপ একটি বিশেষ মর্যাদা দেয়া উচিত। বালুচ সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য এবং একটি কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী কর্মসূচি বিকাশের কথা বিবেচনা করা উচিত। তাহলে এসব সৃষ্টির সমন্বয় বৃহত্তর সিল্ক রোড এবং ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের বিকাশকে আরো সমৃদ্ধ করবে।
গোয়াদরের জন্য অর্থনৈতিক পরিকল্পনাটি শহরের প্রকৃত প্রাকৃতিক সুবিধা এবং উদীয়মান সুযোগগুলোর আলোকে পুনর্বিবেচনা করা যায়। গোয়াদরের উপকূলরেখা রয়েছে যেখানে প্রাকৃতিক সৈকত, গভীর বন্দর, সস্তা জমি, যথেষ্ট সৌর বিকিরণ ও বায়ুশক্তির সম্ভাবনা রয়েছে। টেকসই উন্নয়ন, এটিকে গেটওয়ে বন্দরের পরিবর্তে একটি ট্রান্সশিপমেন্ট হাব হিসেবে প্রতিস্থাপন করবে, একটি অভ্যন্তরীণ পর্যটন গন্তব্য হিসেবে এবং সবুজ হাইড্রোজেনের উৎপাদক হিসেবে এটিকে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে, ফলে এখান থেকে রেলপথকে জ্বালানি দিতে পারবে এবং আমদানিকৃত শক্তির ওপর দেশের নির্ভরতা হ্রাস করবে।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব ও গ্রন্থকার