যেসব শর্তে রাশিয়া-ইউক্রেনকে সমঝোতায় আনল তুরস্ক

অন্য এক দিগন্ত | Mar 29, 2022 09:39 pm
যেসব শর্তে রাশিয়া-ইউক্রেনকে সমঝোতায় আনল তুরস্ক

যেসব শর্তে রাশিয়া-ইউক্রেনকে সমঝোতায় আনল তুরস্ক - ছবি : সংগৃহীত

 

এর আগে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের আর এক প্রজাতন্ত্র বেলারুশে চার দফা বৈঠকেও ‘শান্তির পথ’ খোলেনি। কিন্তু তুরস্কে মঙ্গলবার রাশিয়া-ইউক্রেনের আলোচনা শুরুর পরেই দেখা গেল নাটকীয় পটপরিবর্তন। যুদ্ধের ৩৪তম দিনে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ এবং চেরনিহিভ শহর দখলের অভিযানে আপাতত রাশ টানতে সম্মত হলো ভ্লাদিমির পুতিনের দেশ।

ঘটনাচক্রে, আমেরিকার নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটো-র গুরুত্বপূর্ণ সদস্য তুরস্ক। যে ন্যাটো-তে যোগদানের জন্য ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির তৎপরতাকে যুদ্ধের ‘অন্যতম কারণ’ হিসেবে প্রকাশ্যে চিহ্নিত করেছে মস্কো! এই পরিস্থিতিতে কেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেন দখলের অভিযানে সাময়িক ইতি টানতে রাজি হলেন, তার নানা ‘ব্যাখ্যা’ শোনা যাচ্ছে কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মুখে। আর সেই সঙ্গে অনিবার্যভাবে উঠে আসছে তুরস্কের ভূমিকার কথা।

দেড় বছর আগেও একইভাবে মস্কোর উপর আঙ্কারার ‘প্রভাব’ দেখা গিয়েছিল। ২০২০ সালের শেষে নগোর্নো কারাবাখের দখল ঘিরে আজারবাইজান-আর্মেনিয়া যুদ্ধের সময় প্রকাশ্যে আজারবাইজানকে সামরিক সহযোগিতা দেয়ার ঘোষণা করেছিলেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েপ এরদোগান। যদিও পুতিনের সমর্থন ছিল আর্মেনিয়ার দিকে। দু’মাসের যুদ্ধে আর্মেনিয়া কোণঠাসা হয়ে পড়ে শান্তির পথে হাঁটতে বাধ্য হয়েছিল।

অনেকের মতে, রাশিয়ার ওপর তুরস্কের এই প্রভাবের পিছনে রয়েছে ভৌগোলিক অবস্থান। রাশিয়ার দলে থাকা ক্রিমিয়ার সেবাস্তিপোল বন্দরের সঙ্গে ইউরোপের নৌপথ যোগাযোগের একমাত্র পথ হলো কৃষ্ণসাগর হয়ে তুর্কি প্রণালীর মাধ্যমে ভূমধ্যসাগরের সাথে সংযোগ ঘটা এই কৃষ্ণ সাগরের তীরে পূর্ব ইউরোপের এবং ককেশাসের ৭টি দেশ রয়েছে। রাশিয়ার হাতে থাকা এক মাত্র সেবাস্তিপোল বন্দরই উষ্ণ স্রোতের কারণে সারা বছর সচল থাকে। যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে তুর্কি প্রণালী বন্ধ করার জন্য ইতিমধ্যেই তুরস্কের কাছে আবেদন জানিয়েছে ন্যাটো-র একাধিক সদস্যরাষ্ট্র। ফলে শঙ্কা ছিল মস্কোর।

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ভোর থেকে ইউক্রেনের মাটিতে আক্রমণ শুরু করেছিল রাশিয়া। পুতিনের দাবি ছিল, প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির জমানায় ইউক্রেনের মাটিতে ‘রুশ গণহত্যা’ রুখতেই এ হামলা। আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণার তিন দিন আগে পুতিন ইউক্রেনের সেই ‘গণহত্যাস্থল’ ডোনেৎস্ক ও লুহানস্ক অঞ্চলকে (যাদের একত্রে ডনবাস বলা হয়) স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার কথাও ঘোষণা করেছিলেন পুতিন।

তুরস্কের কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের দাবি, ডনবাসকে ‘স্বশাসন’ দেয়ার রুশ প্রস্তাব বিবেচনায় রাজি হয়েছে কিয়েভ। এ ছাড়া, ২০১৪ সালের যুদ্ধে ইউক্রেনের হাত থেকে বেদখল হওয়া ক্রাইমিয়াকে তাদের দেশের অংশ বলে স্বীকৃতি দেওয়া হোক বলেও দাবি করেছিলেন পুতিন। সে বিষয়েও ইতিবাচক ইঙ্গিত মিলেছে। আলোচনায় ক্রিমিয়ার পথে পশ্চিম ইউরোপে রুশ গ্যাস পাইপলাইন বসানোর প্রস্তাব নিয়েও আলোচনা হয়েছে বলে তুরস্ক সরকারের একটি সূত্র জানিয়েছে।

 শান্তি আলোচনার সময় রুশ অলিগার্ক রোমান আব্রামোভিচকে বিষপ্রয়োগের

ইউক্রেন বেলারুশ সীমান্তে এ মাসের শুরুতে এক শান্তি আলোচনায় অংশ নেবার সময় রুশ ধনকুবের রোমান আব্রামোভিচকে বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল বলে তার ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো সন্দেহ করছে।

ফুটবল ক্লাব চেলসি এফসির মালিক কয়েকদিন চোখে ব্যথা ও অস্বস্তি এবং শরীরের চামড়া উঠে যাওয়ার মত উপসর্গ নিয়ে ভুগেছেন। তিনি এখন সেরে উঠেছেন।

ইউক্রেনের দুইজন শান্তি আলোচকও আক্রান্ত হয়েছেন বলে জানা গেছে।

এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, রাশিয়ার কট্টরপন্থী যারা শান্তি আলোচনাকে বানচাল করতে চায় তারা সন্দেহজনক এই বিষপ্রয়োগের ঘটনা ঘটিয়েছে।

অভিযোগ ওঠার পর এক মার্কিন কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেছিলেন, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ধারণা করা হচ্ছে যে আক্রান্ত ব্যক্তিদের শারীরিক উপসর্গগুলো 'পরিবেশগত' কারণে হয়েছে, বিষপ্রয়োগের কারণে নয়।

পরে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট অফিসের একজন কর্মকর্তা জোভকাভা বিবিসিকে বলেছিলেন, তিনি যদিও আব্রামোভিচের সাথে কথা বলেননি, কিন্তু ইউক্রেনের আলোচক দলের সদস্যরা সবাই সুস্থ আছেন।

অন্য আরেকজন এই অভিযোগকে 'মিথ্যা' বলে দাবি করেছিলেনে।

কিন্তু বিবিসির নিরাপত্তা সংবাদদাতা ফ্র্যাঙ্ক গার্ডনার বলেছেন, এই যুদ্ধে কোন পক্ষ বিশেষ করে রাশিয়া রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করে থাকতে পারে - এমন সন্দেহকে যুক্তরাষ্ট্র ধামাচাপা দিতে চাইবে।

তার কারণ, সেটি হলে যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা ব্যবস্থা নেয়ার একটি বাধ্যবাধকতা তৈরি হয় যা তারা একেবারেই করতে চায় না।

'চোখ ফুটো হয়ে যাবার মতো ব্যথা'
ওয়ালস্ট্রিট জার্নালের উদ্ধৃত সূত্রে জানা যাচ্ছে, তেসরা মার্চ ওই ঘটনার পর মি. আব্রামোভিচ এবং ইউক্রেনের শান্তি আলোচক দলের সদস্য দেশটির পার্লামেন্টারিয়ান রুস্তেম উমেরভের অবস্থার উন্নতি হয়েছে এখন।

আব্রামোভিচের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র বিবিসিকে বলেছেন, তিনি সুস্থ হয়ে উঠেছেন এবং যুদ্ধ বন্ধের লক্ষ্যে শান্তি আলোচনায় অংশ নেয়া চালিয়ে যাচ্ছেন।

এই ঘটনার ফলে ইউক্রেন এবং রাশিয়ার মধ্য আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে মি. আব্রামোভিচের ভূমিকা সামনে এসেছে।

আলোচনায় তার অবস্থান ঠিক কী সেটি পরিষ্কার নয়, কিন্তু রাশিয়ার এই অলিগার্কের একজন মুখপাত্র এর আগে বলেছিলেন, আলোচনায় তার প্রভাব 'সীমিত'।

রোববার ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, আব্রামোভিচ তার দেশে রাশিয়ার হামলা সীমিত করতে তাকে সাহায্যের প্রস্তাব দিয়েছিলেন।

এ মাসের শুরুতে শান্তি আলোচনা আয়োজনের জন্য মস্কো এবং কিয়েভের মধ্যে কয়েকদফা আসা-যাওয়া করেছেন এই রুশ বিলিয়নিয়ার।

সফরে তিনি মি. জেলেনস্কির সাথে দেখা করেছিলেন, কিন্তু তিনি আক্রান্ত হননি এবং তার মুখপাত্র জানিয়েছেন ওই ঘটনা সম্পর্কে তিনি জানেন না।

অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা গ্রুপ বেলিংক্যাট বলছে, মি. আব্রামোভিচ এবং কয়েকজন আলোচক যে সব উপসর্গে ভুগেছেন, তা 'রাসায়নিক অস্ত্রের বিষক্রিয়ার মত'।

বেলিংক্যাট বলছে, এসব উপসর্গের মধ্যে রয়েছে, 'চোখ ও ত্বকে জ্বালাপোড়া এবং চোখে তীক্ষ্ম ব্যথা'।

ওই ঘটনার ১০ দিন পর আব্রামোভিচকে প্রথম জনসমক্ষে দেখা যায় ১৪ই মার্চ তেলআবিব এয়ারপোর্টে।

এ মাসের শুরুতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্র এবং তেলআবিব আব্রামোভিচের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।

যদিও ঘনিষ্ঠতার কথা বরাবর অস্বীকার করে এসেছেন আব্রামোভিচ।

তবে, আব্রামোভিচের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট মি. জেলেনস্কি।

তার বক্তব্য মস্কোর সাথে শান্তি আলোচনায় আব্রামোভিচ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবেন।

ক্রেমলিন বলেছে, শান্তি আলোচনার প্রাথমিক পর্যায়ে মি. আব্রামোভিচ ভূমিকা রেখেছিলেন, কিন্তু এ প্রক্রিয়া এখন কেবল দুই দেশের আলোচকদের হাতেই রয়েছে।

তুরস্কের ইস্তানবুলে আজ দুই দেশের বৈঠকে বসার কথা রয়েছে - দুই সপ্তাহের বেশি সময় পর প্রথম দুই দেশের প্রতিনিধিরা মুখোমুখি বৈঠকে বসবেন।

রহস্যজনক বিষক্রিয়া
মার্চের ৩ তারিখে রোমান আব্রামোভিচ রাশিয়া এবং ইউক্রেনের শান্তি আলোচনায় যোগ দিতে ইউক্রেন - বেলারুশ সীমান্তে পৌঁছান।

বিবিসির নিরাপত্তা সংবাদদাতা ফ্র্যাঙ্ক গার্ডনার বলেছেন, এর পর সেখানে যা ঘটেছে তা রীতিমত 'রহস্যজনক'।

অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা গ্রুপ বেলিংক্যাট বলছে, তেসরা মার্চ রাতে মি. আব্রামোভিচসহ তিনজন আলোচকের শরীরে নার্ভ এজেন্ট বিষক্রিয়ার উপসর্গ দেখা দেয়।

তাদের সবার শরীরের ত্বকে জ্বালাপোড়া, চোখে জ্বলুনি ও অস্বস্তি এবং চোখের পেছনের অংশে ব্যাপক ও তীক্ষ্ম ব্যথা দেখা যায়, যা সারারাত ছিল।

বৈঠকে কেউই পানি এবং চকোলেট ছাড়া অন্য কিছু খাননি।

ঘটনাটি বিশ্লেষণ করে রাসায়নিক অস্ত্র বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাদের বিশ্বাস এটি ইচ্ছাকৃতভাবে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের একটি উদাহরণ।

কিন্তু সেটি কোন পক্ষ করেছে সে সম্পর্কে ধারণা দেননি তারা।

কোনো পক্ষ দায় স্বীকারও করেনি।

অনেকেই ভাবছেন, কাজটি রাশিয়ার সামরিক গোয়েন্দা সার্ভিস জিআরইউ'র কাজ এটি, যাদের বিরুদ্ধে ২০১৮ সালে নভিচক সেইনসবরি বিষক্রিয়ায় জড়িত থাকার অভিযোগ এনেছিল ব্রিটেন।

রাশিয়ার তরফ থেকে এ নিয়ে এখনো কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি, এবং তারা কোনভাবে এ ঘটনা ঘটিয়েছে তেমন প্রমাণও নেই।

কিন্তু মনে হচ্ছে কেউ হয়ত শান্তি আলোচকদের কাছে একটি সতর্কবার্তা দেয়ার চেষ্টা করেছে। হয়ত বলার চেষ্টা করেছে, এটা প্রাণঘাতী ছিল না, এটা কেবলই হুঁশিয়ারি।

তবে মার্কিন কর্মকর্তার 'পরিবেশগত' প্রভাব বলে যে মন্তব্য তাকে অযথার্থ বলে মন্তব্য করেছেন রাসায়নিক অস্ত্র বিশেষজ্ঞ হামিশ ডি ব্রেটন-গর্ডন।

সূত্র : বিবিসি


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us