বেড়াল কামড় দিলেই কি র্যাবিস ইঞ্জেকশন লাগবে?
বেড়াল কামড় দিলেই কি র্যাবিস ইঞ্জেকশন লাগবে? - ছবি : সংগৃহীত
পাড়ার পাগলাটে ছেলেটি কুকুর দেখলেই ঢিল ছুঁড়ত। কুকুরের চিৎকারে তার ভারী আমোদ হতো। বয়োজ্যেষ্ঠরা বার বার নিষেধ করতেন- ‘বাবা, কুকুর বড় কৃতজ্ঞ প্রাণী। একটা বিস্কুট দে, সারাজীবন ন্যাওটা হয়ে থাকবে। ঢিল মারিস না।’ ছেলে শুনবে কেন? বরং সে দ্বিগুণ উৎসাহে এবার আধলা ইঁট ছুড়তে শুরু করল। একদিনে পড়ল ছেলেটি বিপদে। ইঁট খাওয়া একটা কুকুর একদিন তাকে ঘুরে তাড়া করল। তার ঘাড়ে উঠে ওর কাঁধের ঝোলাটা নিয়ে টানাটানি শুরু করল। প্রায় কামড়েই দিত। গা থেকে কুকুরটাকে কোনোভাবে ঝেড়ে ফেলে সে এবার ল্যাম্পপোস্টে ঝুলে রইল।
‘কী রে কামড়েছে কুকুরটা? চল তাহলে ইঞ্জেকশন নেবি চল :— বললেন পাড়ার এক লোক। ছেলেটি উত্তর দিলো- ‘না। কামড়ায়নি।’
প্রত্যক্ষদর্শীরাও ঠিকঠাক বলতে পারল না তাকে কুকুরে কামড়েছে কি না। তবে রাস্তার কলে গোসল করার সময় দেখা গেল তার পিঠে একটা ছোট দাগ। রক্ত বেরচ্ছে না। কেউ আর সেভাবে খেয়াল করল না। ল্যাম্পপোস্টে উঠতে গিয়ে হয়তো লেগেছে আঘাত। এমন তো হয়ই!
সাত দিন পরে তার প্রবল জ্বর দেখা গেল। ঘনঘন অজ্ঞান হয়েও যেতে লাগল। হাতে পায়ে কেমন খিল ধরার মতো লক্ষণ। সকলে মিলে ওকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। ডাক্তারবাবু দেখেই বললেন, আর কিছু করার নেই। র্যাবিস সংক্রমণ হয়েছে। তিন দিন কষ্ট পেয়ে সে ইহলোক ত্যাগ করল।
র্যাবিস। পশুবাহিত এক ভাইরাস। অনন্ত কাল ধরে মানুষের নেমেসিস হয়ে এসেছে এই রোগ। মানবসভ্যতার ইতিহাসে পশুর স্থান অপরিহার্য। ভারবাহী পশুর কাজ করেছে হাতি বা গাধা, রক্ষীর কাজ করেছে কুকুর, যাত্রার সময়ে সঙ্গী হয়েছে ঘোড়া। কিন্তু এইসব উপকারী পশু থেকে নানা অসুখও আমাদের দেহে প্রবেশ করেছে যুগে যুগে। এই ধরনের অসুখকে বলা হয় জুনোসিস। র্যাবিস সেইরকম এক ভয়ঙ্কর অসুখ। এই ভাইরাস মানুষের শরীরে প্রবেশ করে আস্তে আস্তে পৌঁছে যায় মস্তিষ্কে। তারপর সেই রোগী মস্তিষ্কের প্রদাহ বা এনসেফালাইটিস এ আক্রান্ত হয় এবং নিদারুণ কষ্ট পেয়ে মৃত্যুবরণ করে। একবার মস্তিষ্কে এই ভাইরাস পৌঁছে গেলে চিকিৎসকের আর কিছুই করার থাকে না।
শুনতে অবাক লাগলেও সারা পৃথিবীর মধ্যে সবথেকে বেশি র্যাবিস রোগী পাওয়া যায় ভারতেই। এবং এর এক প্রধান কারণ ভারতে বেওয়ারিশ কুকুরের সংখ্যাধিক্য। ভারতে এমন কোনো শহর নেই যেখানে রাস্তায় পথকুকুরের দেখা পাওয়া যায় না। এইসব কুকুরের কোনো চিকিৎসা হয় না। টিকা পাওয়ার প্রশ্নই নেই। ফলে এইসব প্রাণী র্যাবিস ভাইরাসের রিজার্ভার-এর কাজ করে। এবং সমীক্ষায় দেখা গেছে যে এই কুকুরের কামড়ে সবথেকে বেশি আক্রান্ত হয় শিশুরাই। ফলে ভারতে র্যাবিস রোগীর মধ্যে ১৫ বছরের কম শিশুদের সংখ্যাই সর্বাধিক। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যে রাস্তার কুকুরের থেকে শিশুদের এইরকম বিপদের আশঙ্কা থাকলেও এই প্রাণীদের নিয়ন্ত্রণ করার ব্যবস্থা সেভাবে করা হয়নি।
তবে শুধু রাস্তার কুকুর বা বিড়াল থেকেই যে র্যাবিস হয়, তা নয়। অনেক সময়েই বাড়ির পোষা কুকুর বা বিড়ালের মধ্যেও এই ভাইরাস থাকতে পারে। বাড়িতে কোনো প্রাণী থাকলে নিয়ম হল তার লাইসেন্স করানো এবং নিয়মিত তার টিকাকরণ করা। কিন্তু আমাদের দেশে কতজন এই কাজ ঠিকমতো করেন? বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাড়ির কুকুর টিকা পায় না এবং রোগের বাহক হিসেবে কাজ করে।
এশিয়া বাদে পৃথিবীর অন্যান্য জায়গায় এই ধরণের প্রাণী থেকে র্যাবিস প্রায় দেখাই যায় না। এর কারণ ইউরোপ বা আমেরিকায় পথকুকুর নেই। বেওয়ারিশ প্রাণী দেখলেই তার আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হয় ওই সব দেশে। আর বাড়ির পোষা প্রাণীকে নিয়মিত চিকিৎসক দেখাতেই হয়। তাই ইউরোপে বা আমেরিকায় র্যাবিস হয় মূলত বাদুড়ের কামড়ে বা বিরল ক্ষেত্রে, বন্যপ্রাণীর আক্রমণের পর। আমাদের দেশেও বন্যপ্রাণীর কামড়ে র্যাবিস হতে পারে। শিয়াল বা বনবিড়াল কামড়ানোর পরেও তাই র্যাবিস হতেই পারে।
এই জন্য কোনো অজানা প্রাণীর কামড় বা আঁচড় খেলে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। বানর, বাঘরোল বা উত্তর বঙ্গের ক্ষেত্রে, চিতাবাঘ, যদি আঁচড়ে বা কামড়ে দেয়, তাহলে প্রথমেই কাজ হলো সেই স্থানটি ভালো করে ধুয়ে ফেলা। এর জন্য বিশেষ কোনো দ্রবণ দরকার নেই। সাধারণ কলের পরিষ্কার পানিতেই ধুয়ে নেয়া যায়। পুকুরের পানিতে সাধারণত সংক্রমণের ভয় বেশি থাকে। ফলে পুকুরের পানি ব্যবহার না করাই উচিত। যদি প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ শুরু হয়, তাহলে অবশ্যই ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।
যদি হাতের কাছে সাবান থাকে, তাহলে সাবান দিয়ে বারবার ঘষে ঘষে ধুয়ে নেয়াই ভালো। ক্ষতস্থানটি একটি গজকাপড় দিয়ে ঢেকে নিলে ভালো হয়। আমাদের দেশে র্যাবিস টিকা সব জায়গায় পাওয়া যায় না। ফলে ক্ষতস্থানটি ধুয়ে নেয়ার পর অনেক সময়েই টিকার জন্য রোগীকে দূরে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু তার আগে, যদি টিটেনাস টিকা সহজলভ্য হয়, তাহলে সেটা নিয়ে নেয়া উচিত।
সেই ক্ষতস্থান সঙ্গে সঙ্গে ধুতে হবে, টিটেনাস এর টিকাও নিতে হতে পারে। এবং তার সঙ্গেই চাই র্যাবিসের টিকা। পশুর কামড়ের পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই টিকার প্রথম ডোজ নিয়ে নিতে হবে। এরপর বাকি তিনটি বা চারটি ডোজ প্রোটোকল মেনে নিতেই হবে। মাঝপথে টিকা বন্ধ করে দিলে কিন্তু রোগের আশঙ্কা থেকেই যাবে। খুব বেশি ক্ষত হলে এই টিকার সাথে ইমিউনোগ্লোবিউলিন ইঞ্জেকশনও নিতে হবে। সেই ব্যাপারে আপনার চিকিৎসক সঠিক পরামর্শ দিতে পারবেন।
সুতরাং সবশেষে এটাই বলার যে, পশুর কামড় বা আঁচড়কে কখনই তাচ্ছিল্য করবেন না। পশু মানুষের পরম বন্ধু ঠিকই, কিন্তু তার লালারসে বা নখে যে জীবাণু থাকে, সে বন্ধু নয়। তাই কোনো বন্য বা গৃহপালিত পশুর সংস্পর্শে আসার পর সন্দেহ হলেই সঠিক পরামর্শ নিন।
সূত্র : বর্তমান