ককেসাস তুরস্ক ও ইরান সমীকরণ : নেপথ্যে পুতিনের খেলা
ককেসাস তুরস্ক ও ইরান সমীকরণ : নেপথ্যে পুতিনের খেলা - ছবি : সংগৃহীত
ককেসাস ও মধ্য এশিয়া নিয়ে রুশ কৌশলবিদ ও দার্শনিক আলেকজান্ডার ডুগিনের চিন্তা এক কথায় ভয়ংকর। ডুগিন জর্জিয়ার আবখাজিয়া ও সাউথ ওশেটিয়াকে রুশ নিয়ন্ত্রণে আনার পরামর্শ দেন। তার মতে জর্জিয়াকে টুকরো টুকরো করা উচিত। আবখাজিয়া এবং ‘ইউনাইটেড ওসেটিয়া’ (যার মধ্যে জর্জিয়ার দক্ষিণ ওসেটিয়া অন্তর্ভুক্ত) রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত হতে হবে।
ককেশাস অঞ্চলের প্রজাতন্ত্রগুলোতেও রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পরামর্শ দেন ডুগিন। এ ব্যাপারে একটি অক্ষ গড়ে তোলার পরামর্শ দেন তিনি। তার প্রস্তাবিত অক্ষ হলো রুশ-ইরান-আর্মেনিয়াকে নিয়ে। ককেশাস ও নিকটবর্তী অঞ্চলের জন্য যে পরিকল্পনা ডুগিন প্রকাশ করেন তাতে উল্লেখ করা হয়, আজারবাইজান দখল করে এর একটি অংশকে ইরানের হাতে দিয়ে বাকি অংশ রাশিয়ান নিয়ন্ত্রণে নিতে হবে। এই পরিকল্পনায় ইরানী, আর্মেনিয়ান ও কুর্দিদের আর্য বংশোদ্ভূত হিসাবে বর্ণনা করা হয়। একই সাথে আরো বলা হয়, এই তিন জাতিগোষ্ঠীকে তুরস্কের ভেতর অস্থিরতা তৈরির জন্য কাজে লাগাতে হবে। আর রাশিয়াকে তুরস্কের মধ্যে ‘ভূ-রাজনৈতিক ধাক্কা’ তৈরি করতে হবে। কুর্দি, আর্মেনিয়ান এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদের এ কাজে নিয়োগ দিয়ে লক্ষ্য অর্জন করা যেতে পারে।
ডুগিন কাস্পিয়ানের পূর্ব এবং উত্তর উপকূল (কাজাখস্তান এবং তুর্কমেনিস্তানের অঞ্চল) এবং মধ্য এশিয়াসহ (কাজাখস্তান, উজবেকিস্তান, কিরগিজস্তান এবং তাজিকিস্তান) ককেশাসকে একটি রাশিয়ান অঞ্চল হিসাবে বিবেচনা করেন। এই অঞ্চলের রুশ কর্মকা- গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে ক্রেমলিনের এই ধরনের একটি পরিকল্পনা এগিয়ে নেবার ব্যাপারে কিছু কার্যক্রমের অস্তিত্ব দেখা যাবে।
প্রথমত, আজারবাইজানের নার্গনো কারাবাখ অঞ্চল আর্মেনিয়া দখল করে নিয়েছিল রাশিয়ার প্রত্যক্ষ সামরিক সহায়তায়। পরবর্তী সময়ে আজারবাইজান রাশিয়ার সাথে বিভিন্ন সামরিক ক্রয় ও অন্যবিধ চুক্তির মাধ্যমে মস্কোকে নিরপেক্ষ জোনে আনার চেষ্টা করে। অবশেষে নাগর্নো কারাবাখের- একটি অংশ আজারবাইজান জয় করতে সক্ষম হয়। পরে রাশিয়ান মধ্যস্থতায় একটি শান্তিচুক্তি হয় যার আওতায় এই অঞ্চলে রুশ ও তুর্কি সেনাদের অবস্থান তৈরি করা হয়। কিন্তু তুরস্কের সাথে মহাসড়ক সংযোগসহ এই চুক্তির অনেক বিষয় রাশিয়া পরবর্তী পর্যায়ে বাস্তবায়ন করতে দেয়নি। বরং আজারবাইজানের সাথে বিশেষ চেষ্টা সত্ত্বেও শান্তি প্রতিষ্ঠার আঞ্চলিক উদ্যোগ বাস্তবায়িত হয়নি। কয়েক দিন আগে রুশ শান্তি রক্ষীদের ওপর আজারবাইজানের ড্রোন হামলার অভিযোগ আনে মস্কো। এর রেশ ধরে আজারবাইজানে কোনো রুশ সামরিক অভিযান পরিচালিত হওয়ার সম্ভাবনা ইউক্রেন অভিযানের পর কোনোভাবেই উড়িয়ে দেয়া যায় না।
আলেকজান্ডার ডুগিন যে কৌশলগত লক্ষ্যের রূপরেখা রাশিয়ার জন্য তৈরি করে দিয়েছেন সেটিকে সংক্ষিপ্তভাবে বলা যাবে স্টালিনের আমলের সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব ও শক্তিমত্তা ফিরিয়ে আনা, যার শক্তির উৎস হবে কমিউনিজমের পরিবর্তে অর্থোডক্স খ্রিষ্টবাদ ও উগ্র রুশ জাতীয়তাবাদ। ভ্লাদিমির’ নামে একজন শাসক রাশিয়ায় অর্থোডক্স সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পুতিনের নামের সাথেও ‘ভ্লাদিমির’ রয়েছে। আর এক সময় অর্থোডক্স খ্রিষ্টবাদের প্রাণকেন্দ্র ছিল কনস্টান্টিনিপল বা আজকের ইস্তাম্বুল। এই ইস্তাম্বুলের প্রতি ওসমানীয় শাসন এবং এর পরেও রুশ ও সোভিয়েত নেতাদের বিশেষ নজর ছিল। ডুগিন তার কৌশলপত্রে তুরস্ককে দুর্বল করতে আর্মেনীয়, কুর্দি ও ইরানীদের ব্যবহারের কথা বলেছেন। এ কারণে সিরিয়া ও ইরাকে ইরানীদের বিশেষ মিলিশিয়া উপস্থিতি এবং সিরিয়ায় রাশিয়ানদের সামরিক উপস্থিতি তৈরিকে একেবারে হালকাভাবে দেখার অবকাশ সম্ভবত নেই।
ইউরোপ নিয়ে খেলবেন পুতিন
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মস্তিষ্ক হিসেবে রুশ কৌশলবিদ ও দার্শনিক আলেকজান্ডার ডুগিনের আরেকটি পরিকল্পনা ইউরোপীয়দের বিশেষভাবে উৎকণ্ঠিত করে তুলেছে। ডুগিন বলেছেন, এডলফ হিটলার রাশিয়া আক্রমণের ভুলটি না করলে যুক্তরাজ্য ভেঙে যেত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের নেতৃত্বে বসতে পারত না। যুক্তরাষ্ট্র ঘরেই বিচ্ছিন্ন এবং বিভক্ত হয়ে থাকত। আর জাপান রাশিয়ার জুনিয়র অংশীদার হিসাবে চীনকে শাসন করত।
ডুগিনের রূপরেখায় রুশ সরকারকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে জার্মানির সাথে বিশেষ অক্ষ তৈরি করে ইউরোপকে ফিনল্যান্ডের মতো দন্তহীন নিরপেক্ষতায় নিয়ে যেতে। ডুগিন আরো প্রস্তাব করেছেন, জার্মানির হাতে ক্যাথলিক ও প্রটেস্টান্ট ইউরোপীয় বলয়ের কর্তৃত্ব তুলে দিতে। এ জন্য ১৯৯৭ সালেই ডুগিন রুশ সরকারের জন্য প্রস্তাব করেছিলেন যুক্তরাজ্যকে যাতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে আলাদা করতে গোপন তৎপরতা চালানো হয়। এ জন্য যুক্তি হিসাবে উল্লেখ করা হয় ব্রিটেন সব সময় আমেরিকান পদাঙ্ক অনুসরণ করতে চায়। যুক্তরাজ্য ইইউ থেকে আলাদা হয়ে গেলে ন্যাটোর প্রতি ফ্রান্সের আপত্তিকে কাজে লাগিয়ে জার্মানি-ফ্রান্স একটি অক্ষ তৈরির প্রচেষ্টা নিতে বলা হয়।
ঘটনাক্রমে অথবা কৌশলগত দাবা খেলার পরিণতিতে ব্রেক্সিটের মাধ্যমে যুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বিদায় নেয়। জার্মানির সাথে রাশিয়ার তৈরি হয় বিশেষ সম্পর্ক। এ সম্পর্ক আরো এগিয়ে নিতে নর্থ স্টিম পাইপ লাইন-২ তৈরি হয়। এমনকি ইউক্রেন উত্তেজনা শুরু হবার পরও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ ও জার্মান চ্যান্সেলর শুলজ পৃথকভাবে রাশিয়া সফর করেন। ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের জন্য ইউরোপের মধ্যে এই দুটি দেশ সবচেয়ে বেশি উদ্যোগী ভূমিকায় রয়েছে।
এই কথা সত্যি যে, ইউক্রেনে রাশিয়ার সর্বাত্মক সামরিক আগ্রাসনের পর জার্মানি ফ্রান্স ন্যাটোর প্রতি বৈরিতার পরিবর্তে সম্পর্ক বৃদ্ধি এবং প্রতিরক্ষা ব্যয় ও সক্ষমতা বাড়াতে চাইছে। পুতিন এক এক করে ডুগিনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এগুনোর কারণে রুশ সীমান্তবর্তী দেশগুলো এখন নিজেদের স্বাধীনতার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন। আর ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোর সংহতির ব্যাপারে যে ধরনের ভাঙন বা শৈথিল্য তৈরি হয়েছিল সেটিও এখন আর দেখা যাচ্ছে না।