ইউয়ান নিয়ে রুশ-ভারত সমীকরণ
ইউয়ান - ছবি : সংগ্রহ
অতএব, বাইডেন ইউরোপ সফরে এসেছেন। অর্থাৎ জেলেনস্কি কীভাবে কত দ্রুত শেষ করতে চাইছেন অথবা সাদা চামড়ার শরণার্থীরা কত দ্রুত ঘরে ফিরতে চাইছেন- সেগুলো নয়, বাইডেনের চাওয়া এখানে ডমিনেট করবেই, এমন দশায়। তাই বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই ইইউ হেড কোয়ার্টার-ব্রাসেলসে বসে বাইডেন বৈঠক করে গেছেন যার মূল বিষয় ইইউ সদস্যদের রাশিয়ান গ্যাসের বিকল্পের সন্ধান দেয়া শুধু নয়, একেবারে ব্যবস্থা করে দেয়া।
এতে ‘ত্রাতা’ বাইডেন যা করতে চাইছেন তা যেন উচ্ছ্বাস দেখিয়েই হাজির করতে হবে। তাতে এটি যে, আসলে প্রপাগান্ডা তা লুকিয়ে কাজটা করতে চাইলেও লুকানো থাকেনি। বিবিসি বাংলা আর আমাদের ‘প্রথম আলো’ সেই উচ্ছ্বাস তৈরি করতে তেমন শিরোনাম করেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ : রাশিয়ার বদলে এখন থেকে ইউরোপের গ্যাস আসবে আমেরিকা থেকে- এই হলো বিবিসি বাংলার শিরোনাম। আর তা দেখে বিচার-বিবেচনা ভুলে প্রথম আলোর শিরোনাম- ‘রাশিয়াকে হটাতে ইউরোপে গ্যাস দেবে যুক্তরাষ্ট্র’। প্রপাগান্ডায় আরো সরস দেখাতেই যেন ‘হটাতে’ শব্দটার ব্যবহার। শুনলে মনে হবে- হ্যাঁ, এবার ‘ঘ্যাগের ওষুধ’ পাওয়া গেছে! কিন্তু আসলেই কী তাই?
জবাব হলো- না, ঠিক তা নয়। বিবিসি বাংলার রিপোর্টের ভেতরেই তা নিয়ে খোলাসা করে কথা বলা হয়েছে। যেমন- ‘যুক্তরাষ্ট্র কি ইউরোপের চাহিদা মেটাতে পারবে? এই প্রশ্ন তুলে বিবিসি বাংলা নিজেই উত্তরটা দিয়ে দিয়েছে। বলেছে, ‘বিবিসি নিউজের অনলাইন ইউরোপ এডিটর পল কিরবি এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন। তিনি তুলে ধরেন, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের সরবরাহে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে একটি বড় চুক্তির ঘোষণা কিছু সময় আগে জানা গেছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের সরবরাহ ব্যাপক বাড়ালেও, ইইউভুক্ত ২৭টি রাষ্ট্রের জন্য এটি সামান্য মাত্র।’ অর্থাৎ বাইডেনের কথায় বাকচাতুরি আছে।
এদিকে বাইডেনের ইউরোপ সফর নিয়ে ইংরেজি বিবিসি একটি রিপোর্ট করেছে ‘পাঁচ চ্যালেঞ্জ’ শিরোনামে এবং বলতে গেলে তা খুবই খারাপ রিপোর্ট না হলেও বাইডেনের জন্য কঠিন বাধাগুলোই তুলে আনা হয়েছে সেখানে। যেমন, প্রথম চ্যালেঞ্জটি হলো ‘ঐক্য দেখানো’। মানে হলো- ইউরোপের সাথে আমেরিকা যে ঐক্যবদ্ধ আছে তা দেখাতে হবে। অথচ ওখানেই বলা হয়েছে ‘যেখানে যত দিন যাচ্ছে ততই অনৈক্যের সম্ভাবনা বাড়ছে’।
আসলে বড় অনৈক্যই প্রকাশিত হয়ে গেছে। অথচ তেল-গ্যাস নিয়ে যতই আমেরিকা বিকল্প আছে বলে এটা-সেটা দেখাক না কেন, কথার মধ্যে বড় ফাঁক আছে। আর তা সামলাতে না পেরেই তো অনেক আগেই ইইউ নেতারা বিশেষত জার্মানির সোজা কথা- ‘অন্তত ১৯২৭ সালের আগে রাশিয়ার ওপর থেকে জ্বালানি-নির্ভরতা কমানোর সুযোগ নেই।’ আর এ নিয়ে তবু বিবিসি বাংলা নিউজ প্রপাগান্ডার লাইন ধরে। এই প্রথমত বিবিসি বাংলার খবরে সুনির্দিষ্ট করে প্রকাশিত হয়েছে যে, ‘জার্মানি ও ইউরোপের আরো কয়েকটি দেশের আপত্তির মুখে, রুশ তেল ও গ্যাস এখনো এই নিষেধাজ্ঞার আওতার বাইরে। কারণ রুশ জ্বালানির ওপর, বিশেষ করে গ্যাসের ওপর, তাদের নির্ভরতা।’ অর্থাৎ ইউরোপের রাশিয়ান তেল-গ্যাস ক্রয়কে এখনো নিষেধাজ্ঞার বাইরেই রাখা এবং বিবিসি আরো জানিয়েছে, জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শোলৎস বুধবারও বলেছেন, ‘রাশিয়ার তেল ও গ্যাসের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিলে ইউরোপ অর্থনৈতিক মন্দার কবলে পড়বে’। এ ছাড়া রয়টার্স আরো সোজাসাপ্টা করে কথাটা এক এক্সপার্ট অ্যানালিস্টের বরাতে বলে দিয়েছে। লিখেছে, ‘সাধারণত একটি নতুন উৎপাদন ব্যবস্থা চালু হতে দুই-তিন বছর লাগে। অতএব এই ডিলটা সম্ভবত উপস্থিত চালু সাপ্লাইকে নতুন দিকে নিয়ে যাওয়া যতটা না, এটা নতুন উৎপাদন সক্ষমতা তৈরি করার কথা বলেছে।’
এ ছাড়া ইউরোপ সফরে বাইডেনের আরেক গন্তব্যস্থল হলো পোল্যান্ড। হ্যাঁ, পোল্যান্ড যে এখন ২০ লাখ ইউক্রেনীয় রিফুজি নিয়ে পেরেশান। বলা হচ্ছে- ‘সেটা নাকি এখন তার ছোট অর্থনীতিকেই ভেঙে ফেলতে উদ্যত।’ কিন্তু এই পোল্যান্ড ও পাশেই রোমানিয়া- এরা এখন ন্যাটোর সদস্য যারা আগে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের বাফার রাষ্ট্র। মানে পশ্চিম ইউরোপ থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নকে সুরক্ষা দেয়ার জন্য মাঝের বাফার রাষ্ট্র। যেটা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন এরা। ২০১৪ সালের পরপরই ন্যাটোর সদস্য হয়ে গেছে অথচ তখন রাশিয়া কিছু বলেনি, তাহলে এখন কেন পুতিন ইউক্রেনের বেলায় এত আপত্তি করছেন? অথচ জবাবটা খুবই সহজ। আপনি তখনই বাধা দেন যখন আপনার সামর্থ্য-মুরোদ সংগৃহীত হয়েছে বলে আপনার মনে হয়। যেমন- ২০১৪ সাল ছিল আমেরিকার দিক থেকে কঠোর অবরোধ আরোপের বছর আর সেটাই আবার চীনের সাথে নয়া অর্থনৈতিক সম্পর্ক শুরুর বছর। যেটা চীনে ইরানের ২৫ বছর তেল-গ্যাস সরবরাহের বিনিময়ে চীনের বিনিয়োগ পাওয়ার চুক্তি সেটা আসলে সর্বপ্রথম তৈরি হয়েছিল চীন ও রাশিয়ার মধ্যে। তাই ডলারশূন্য হয়েও বা ডলার থেকে বের করে দিলেও রাশিয়া পরে টিকে গিয়েছিল চীনের সাথে ওই অর্থনৈতিক চুক্তির কারণে। সোজা কথায়, ২০১৪ আর ২০২২ সালের রাশিয়া একই অর্থনৈতিক অবস্থায় নেই। এ কারণেই ২০১৪ সালে পোল্যান্ড-রোমানিয়াকে কিছু বলতে না পারলেও এখন ইউক্রেনের বেলায় পুতিন সোচ্চার।
যে কথা বলছিলাম, বাইডেনের আরেক গন্তব্যস্থল পোল্যান্ড কেন? আসলে আগেই বলেছি, বাইডেন ইউক্রেন ইস্যুতে কিছু না করে জেলেনস্কিকে যুদ্ধে নামিয়েছেন, এই অভিযোগে ধোলাই হয়ে যাওয়ার ভয় করছেন। মূলত এ জন্যই রাশিয়া-ইউক্রেন আপস আলোচনা শুরু করতে মরিয়া জেলেনস্কি প্রতিদিন সকালে উদাত্ত আহ্বান জানালেও তা ঘটছে না। তাই সেই অপবাদ ঘুচাতে তিনি ইউক্রেনকে দূর থেকে কিছু অস্ত্র ছুড়ে দিতে চান। কিন্তু পুতিন হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছেন- পড়শি কোনো রাষ্ট্র এমন ‘পৌঁছে দেয়ার কাজ করলে’ সে রাশিয়ার বিরুদ্ধে সামরিক কাজ করেছে বলে তিনি গণ্য করবেন। তাই বাইডেন নিজে সফর করে হয়তো পোল্যান্ডকে সাহসী করে কাজটা করাতে চাইছেন; এটাই মুখ্য কারণ।
আর সর্বশেষে, চীন যে গভীর মনোযোগে ডলারের বিকল্প হিসেবে চীনা মুদ্রা ইউয়ানকে দাঁড় করাতে চাইছে। আসলে এটাই ২০১৫ সাল থেকেই রাশিয়াকে সাথে নিয়ে শুরু করা এক চীনা পরিকল্পনা। আর ২০১৫ সাল থেকে এ জন্য যে, ওই বছরই আইএমএফ ইউয়ানকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। কারণ চীনা ইউয়ান আইওএমএফের সব শর্তই তখন পূরণ করেছিল। ফলে অন্য চারটি আন্তর্জাতিক মুদ্রা- ডলার, পাউন্ড, ইউরো ও ইয়েনের সাথে পঞ্চম সমতুল্য মুদ্রা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। কিন্তু এখন ইউয়ানের সেই ধীর গতি ও বিকাশকেই চীন ত্বরান্বিত করতে চাইছে মাত্র। তখনই বলা হয়েছিল যে, চীন সৌদি আরব থেকে তেল কিনে তা ইউয়ানে পরিশোধ করতে পারলেই ইউয়ান অনেক আগেই বিশ্বাস ও আস্থাযোগ্য প্রধান আন্তর্জাতিক মুদ্রা হয়ে যেতে পারে। স্বভাবতই এতে এটি বাইডেনের পাগলা পুতিনকে সাঁকো না নাড়ানোর মতো কথা মনে করিয়ে দেয়া হয়ে যেতে পারে। আর সামনের নভেম্বরের মিড টার্ম থেকে ২০২৪ সালের নির্বাচন পর্যন্ত এসব কথা তুলেই প্রতিদ্বন্দ্বী ট্রাম্প বাইডেনের পাবলিক রেটিং আরো নিচে নামানোর চেষ্টা করে যাবেন, বলাই বাহুল্য! এই ভয় বাইডেনকে তাড়া করছে- ইউরোপে দৌড়াদৌড়ি করছেন তিনি!
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com