রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ : শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ব অবসানের সূচনা!
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ : শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ব অবসানের সূচনা! - ছবি : সংগৃহীত
তাবৎ দুনিয়ার যতগুলো মুসলিম দেশে সামরিক আগ্রাসন চালিয়েছে বিশ্বশক্তি, সবগুলোতেই আগ্রাসীদের সহযোগী ছিল ইউক্রেন। সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান- কোথায় নেই তারা। অথচ তারা কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী নয়। ইউক্রেন রাষ্ট্র মনে করে ইসরাইলের দখলদারি মনোভাব ও কার্যক্রমের অধিকার তাদের আছে। এরকম একটা রাষ্ট্রকে সমর্থন করতে হবে নাকি, মিডিয়া এমনভাবে প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে যেন তাদেরকে সমর্থন করা ওয়াজিব। অথচ তাদের হাতের রক্তের দাগ এখনো শুকায়নি। আবার রাশিয়ার হাতে চেচেন, দাগেস্তানসহ তাতার মুসলমানদের রক্ত আর দীর্ঘশ্বাস মাখা।
দুনিয়ার সমস্ত স্বৈরাচারী পরাশক্তি নিজেরা নিজেরা ধ্বংস হোক। বিশ্বমানবতার স্বার্থেই তাদের শক্তিহীন হওয়া দরকার।
তবে কিছু সময় থাকে যখন বৃহৎ স্বার্থে শত্রুতা ভুলে যেতে হয়। সে হিসেবে সারা দুনিয়ার অর্থনীতির স্বার্থে একটি বহু মেরুবিশিষ্ট ব্যবস্থা দরকার। আমেরিকার ফেডারেল ব্যাংকে সারা দুনিয়ার রিজার্ভ সঞ্চিত। চাইলেই যেকোনো দেশকে ফকির করে দিতে পারে। তাদের এই ব্যবস্থার সক্ষমতার ক্ষয় দরকার। বৈশ্বিক বাণিজ্য ও অর্থনীতির একক ঠিকাদারি হঠাতে এটাই মোক্ষম সময়।
সারা দুনিয়ার মধ্যে ইউরোপ সবচেয়ে ছোট অথচ নিরাপত্তা পরিষদে তাদেরই তিন দেশ। তাদের শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্বের পতনের জন্য সর্ব ইউরোপীয় অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ দরকার। যুদ্ধ জারি থাক কমপক্ষে ১০ বছর। বেশি হলো আরো ভালো। অর্থনীতির ভয়কে লালন করে লাভ নেই। সভ্যতার সূতিকাগার ইরাককে তছনছ করে দিয়েছে। দরিদ্র ইয়েমেনের শিশুরা এখন খাওয়ার জন্য পাতাও খুঁজে পায় না। বিধ্বস্ত আফগানিস্তানের রিজার্ভ আটকে রেখেছে আমেরিকা। সিরিয়াকে বিরানভূমি বানিয়ে ছেড়েছে। সিরিয়ার উপর তো বিশ্বযুদ্ধ হয়েই গেল। গ্লোবাল ওয়ার জোন সিরিয়া থেকে এখন ইউরোপে।
পরিস্থিতি যা দেখছি এই যুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। গ্রীষ্মে যুদ্ধের গতি বাড়বে। পোল্যান্ড নিজেই জড়িয়ে যেতে পারে এই যুদ্ধে। উদ্বাস্তু চাপ সামাল দিতে পারবে না ছোট ইউরোপীয়ান দেশগুলো।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এখন পর্যন্ত নীরবে রুশ ব্লকে। এই ব্লকে ফাটল চাইবে না রাশিয়া। সোভিয়েত জমানা থেকে আজ অবধি ভারতের ক্রয়কৃত সামরিক অস্ত্রের ৮৫ শতাংশ রাশিয়ার। গত বছরও ভারতের ক্রয়কৃত অস্ত্রের প্রায় ৫০ ভাগ অস্ত্র রাশিয়া থেকে কিনেছে। এই অস্ত্রশস্ত্রের রক্ষণাবেক্ষণে রুশ ইঞ্জিনিয়ারিং সহায়তা লাগবে। নাহলে এসব অস্ত্রশস্ত্র একবার ব্যবহারের পর পরিণত হবে ভাঙ্গারি লোহায়। ভারত তার সামরিক অস্ত্র ও সক্ষমতা টিকিয়ে রাখতেই রাশিয়াকে ছাড়তে পারবে না। রাশিয়া পাকিস্তানকে ছাড়তে পারবে না চীনের জন্য। বিকল্প বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে রাশিয়ার চীনকে লাগবেই। চীন-ইরান, চীন-রাশিয়া, চীন-সৌদি আরব আলাদা কয়েকটি নতুন চুক্তি এখন টক অব দ্য ওয়ার্ল্ড। এর সবগুলোরই লেনদেন হবে ইউয়ানে। এছাড়া রাশিয়ার অবন্ধু দেশ কিন্তু রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল তাদের লেনদেন করতে হবে রুবলে। এখনই যদি জার্মানিকে শর্ত দেয় গ্যাস রুবলে কিনতে হবে, জার্মানি বাধ্য। এখনো তাদের হাতে বিকল্প গ্যাসের যোগান নেই। এজন্য জার্মানি কিন্তু রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ দেয়নি। ইউরোপের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দেশ লিথুনিয়া, এস্তোনিয়া, মলদোভা- এরা রাশিয়ার পাশে থেকে রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক রাখতেই হবে। পাশের বৃহৎ প্রতিবেশির সাথে বৈরিতা স্বাধীনতার জন্য সবসময়ই হুমকির।
রাশিয়া তার স্বার্থেই এই যুদ্ধ থামাবে না। যুদ্ধ আপাতত থামছেও না। পুরো ইউক্রেনকে শাসন করতে না পারলেও এমন এক নতুন ইউক্রেন সৃষ্টি করবে রাশিয়া যার অবস্থান হবে সম্পূর্ণ মস্কোকেন্দ্রিক। মস্কোর নাকের ডগায় কিয়েভ যেমন মার্কিন মিউজিকে নাচছে, এটা উল্টে দেয়ার মিশন সফল না হওয়া পর্যন্ত রুশ অভিযান চলবে। এই যুদ্ধে চেচেনরা রাশিয়ার সহযোগী থাকায় আগামীতে রুশ প্রশাসনে তাদের প্রভাব বৃদ্ধি পাবে। ন্যাটো যদি সরাসরি এই যুদ্ধে না জড়ায় তাহলে ইউরোপের ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো রাশিয়ার সাথে বৈরিতায় যাওয়া নিয়ে নতুন করে ভাববে। রাশিয়ার কার্যক্রম দেখে অনুমান করা যাচ্ছে নিজেকে সে এমন জায়গায় নিতে চায় ইউরোপের সিদ্ধান্ত ইউরোপ নেবে সেটা হতে পারে কেবল রাশিয়ার নেতৃত্বে। যদিও কাজটা খুব সহজ না তবে ইউক্রেনকে এমন জায়গায় রাশিয়া নিয়ে যাবে যেন বাকি সবাই ন্যাটোর প্রতি আস্থা হারায়।
ইউরোপে আমেরিকার পাওয়ার হাউজ ন্যাটো যদি দুর্বল হয়ে পড়ে তাহলে রাশিয়ার লক্ষ্যপূরণ হতেও পারে। এটা নিশ্চিত রাশিয়া যে যুদ্ধ শুরু করেছে সেই যুদ্ধ ততক্ষণ পর্যন্ত তার তরফ থেকে থামবে না যতক্ষণ না নিরাপদে প্রস্থান করতে পারবে, যুদ্ধ ব্যয় উঠিয়ে আনতে পারবে সেই সাথে আঞ্চলিক রাজনৈতিক শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি পাবে।
লেখক : আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক