রাষ্ট্রদ্রোহী এক সম্রাটের সাথে মওলানা ভাসানীর সাক্ষাত
মওলানা ভাসানী - রাষ্ট্রদ্রোহী এক সম্রাটের সাথে মওলানা ভাসানীর সাক্ষাত
সম্রাটমহিমাচ্যুত পৃথিবীতে এখন আমাদের বাস। বিংশ শতাব্দীতে ইতিহাসের। রঙ্গমঞ্চ থেকে একে একে সম্রাটরা নিয়েছেন বিদায়। পালা শেষে হয়েছে তাদের।
জীবননাট্যের যবনিকাপতন। তাদের মঞ্চে ফিরিয়ে আনার জন্য পড়েনি কোনো। হাততালি। ইথিওপিয়ার হেইলি সেলসি, মধ্য আফ্রিকার জা বিদেল বোকাসা। ইরানের রেজা শাহ পাহলভি। তাঁরা অনেকেই বিদায় নিয়েছেন কোনো বিয়োগান্ত জীবননাট্যের অশ্রুভেজা অন্তিম দৃশ্যে নয়, উৎফুল্ল জনতার হর্ষধ্বনির মধ্যে। ইতিহাসের বিবর্তনে তারা হয়ে পড়েছিলেন অবান্তর এবং অবাঞ্ছিত।
সাধারণ নৃপতিদের দলে নাম লিখিয়ে রয়ে গেছেন একজন। ইংল্যান্ডের রাজা অথবা রানি। তাসের চার রাজা এবং চার রানির মতোই নাকি তাদের স্থায়িত্বের নিশ্চয়তা। তবে তারা রয়ে গেছেন সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। একদিন যার সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যেত না, আজ তার রাজ্যে একটানা বহুদিন মেঘের আড়াল থেকে সূর্য উকি পর্যন্ত মারে না। ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার সময় থেকে ইংল্যান্ড শুরু করেছিল সাম্রাজ্য সংকোচনের পর্ব। ১৯৯৭ সালে হংকংকে চীনের হাতে ফিরিয়ে দেওয়ার পরই ঘটল সেই পর্বের সমাপ্তি। সময়ের চাপে বহু শতাব্দীর গড়া সাম্রাজ্য ভেঙে যেতে লাগল। মোটা পঞ্চাশটি বছর। ১৯৪৭ থেকে ১৯৯৭।
কিন্তু সম্রাট হিসেবে এখন রয়ে গেছেন একজনই। জাপানের সম্রাট। আকিহিতো। চীন-জাপান সম্পর্ক দুই হাজার বছরের। কিন্তু গণচীনের সঙ্গে জাপানের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে মোটে কয়টি দশক। কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের বিশ বছরের পূর্তি উপলক্ষে দুই হাজার বছরের দ্বিপক্ষীয় ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো জাপানের সম্রাট চীন সফর করলেন। নতুন এশিয়ার এই দুই মহাশক্তির হৃদ্যতা নিঃসন্দেহে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।
১৯৩১ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত জাপান চীনের ওপর আগ্রাসন চালিয়েছিল । সেই আগ্রাসনের পন্থা ছিল কিছুটা অভিনব। মাঞ্চুরিয়ায় চীনের একটি টুকরো কেটে নিয়ে, জাপানের সক্রিয় প্ররোচনায় ১৯৩২ সালে মাঞ্চুকো বলে একটি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হলো। ১৯৩৪ সালে জাপানিরা মাঞ্চুকোর সম্রাট হিসেবে অধিষ্ঠিত করলেন চীনের ভূতপূর্ব সম্রাট পু ই - কে। ১৯১২ সালে চীনের গণবিপ্লবে চীনের সর্বশেষ সম্রাট পু ই হয়েছিলেন বিতাড়িত। ২২ বছরের বেকারত্বের পর সম্রাট হিসেবে তাঁর হলো পুনর্নিয়োগ, অন্য একটি দেশের সম্রাট হিসেবে। সাম্রাজ্য বিস্তারের খেলায় জাপানিদের পুতুল নাচের পুতুল হয়ে রইলেন পু ই আর তার ক্রীড়ানক সরকার। সাম্রাজ্যবাদী জাপানের অভিপ্রায় ছিল মাঞ্চুকোর প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ। জাপানের শিল্পায়নের সহায় হলো মাঞ্চুরিয়া থেকে রপ্তানি করা কয়লা, লোহা, তেল ও বনজ সম্পদ। মাঞ্চুরিয়ার ইতিহাস হয়ে রইল পুনর্নিয়োজিত সম্রাট পু ইর পুতুলনাচের ইতিকথা।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের সঙ্গে সঙ্গে ১৯৪৫ সালে মাঞ্চুকোর তাসের ঘর গেল ভেঙে। রুশদের হাতে বন্দী হলেন পু ই। ১৯৪৯ সালে। গণচীনের অভ্যুত্থানের সময় পু ই -কে হস্তান্তর করা হলো চীনাদের হাতে। গণচীনের বিপ্লবের মানবিক দিকটা আমার কাছে আকর্ষণীয়। প্রতিশোধের নৃশংসতা যথাসম্ভব পরিহার করেছিলেন চল্লিশের দশকের গণচীনের বিপ্লবীরা। চীনের বিপ্লবে গণচীনের নেতাদের। রাষ্ট্রসংগঠক হিসেবে পরিপক্কতার ছাপ সর্বত্র বিদ্যমান। পু ইর ক্ষেত্রেও কোনো তাৎক্ষণিক প্রতিশোধ নেওয়া হলো না। তাঁকে কারাগারে বহু বছর ধরে বিপ্লবের অদির্শে দীক্ষাদান করা হনো যত দিন পর্যন্ত না তিনি তার অতীতের কর্মকাণ্ড সম্বন্ধে অনুতপ্ত হয়েছেন। তারপর তাঁকে দেওয়া হলো কাজ করার সুযোগ। তাঁর ছিল গাছপালা ফুল ফলের শখ। ইতিহাসের পুতুল নাচের এই নায়কের ইতিহাসেও ছিল প্রচুর আগ্রহ। বোটানিক্যাল উদ্যানে তিনি কর্মরত হলেন উদ্ভিদবিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে। পিকিংয়ের গ্রন্থাগারে তাঁকে দেওয়া হলো লেখাপড়ার সুযোগ। ইতিহাসের করুণা। উদ্রেককর মানুষটি সুযোগ পেলেন সাধারণ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করার।
সম্রাটদর্শন বোধ হয় আমাদের খুব একটা ভাগ্যে নেই। ইরানের শাহানশাহ ছাড়া কোনো সম্রাটকে আমার চাক্ষুষ দেখার সৌভাগ্য হয়নি। সম্রাট আকিহিতোকে দেখেছি যখন তিনি যুবরাজ। ইংল্যান্ডের রানির সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে বহুবার। কিন্তু সাম্রাজ্যের শেষ সূর্য তখন অস্ত গেছে। ইংল্যান্ডের রানি সাধারণ নৃপতির দলে। চাকরিরত ছিলাম আবুধাবি, বেলজিয়াম, হল্যান্ড আর লুক্সেমবুর্গে। রাষ্ট্রপ্রধানেরা সেখানে সাধারণ রাজা। সম্রাট নন। কিন্তু আমার জীবনের অন্যতম চাঞ্চল্যকর সাক্ষাৎ ছিল দুবারের ভূতপূর্ব সম্রাট পুইর সঙ্গে। ১৯৬৩ সালে পিকিংয়ে।
মওলানা ভাসানী তখন চীনে। তার কল্যাণে আমার হলো প্রাণভরে চীন দেখা। বিশেষ বিমানযোগে প্রায় সপ্তাহ দুয়েক আমরা ঘুরে বেড়ালাম চীনের বিভিন্ন অঞ্চলে। ঐতিহাসিক সৌধগুলো, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য খ্যাত দ্রষ্টব্য স্থানসমূহ, প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষার হাতেখড়ি থেকে আধুনিক মেডিকেল কলেজে জটিল অস্ত্রোপচার, কলকারখানা, কৃষিখামার, কমিউন, নগর, বন্দর সবই দেখলাম। এমনকি পিকিংয়ে একটি জেলখানাও। সেই সময়ে চীন ভ্রমণ ছিল দুরূহ এবং বিরল একটি ব্যাপার। পিকিংয়ে নিয়োজিত কূটনীতিবিদদের মধ্যে আমিই যেন হয়ে গেলাম ব্যতিক্রম।
মওলানা ভাসানীর সঙ্গে চীন দর্শন শেষে ফিরে এসেছি পিকিংয়ে। তার পরদিনই। তলব পড়ল তাঁর কাছে যাওয়ার।
‘বেশ তো চীন দেখলাম ’বললেন তিনি তাঁর স্বভাবসিদ্ধ হাসি হেসে। তখনই বুঝে গেলাম মওলানা সাহেবের মাথায় নতুন কোনো চিন্তা এসেছে। ‘চীনের কর্তৃপক্ষকে কি আরও একটি অনুরোধ করা যায় না?' বললেন তিনি। ‘কী, বলুন। ভাবলাম আবার জেল দেখতে যাওয়ার ইচ্ছে নেই তো।'
‘আমি পু ইর সঙ্গে দেখা করব।' অনুরোধের স্বরে নয়, আদেশের দৃঢ়তা নিয়েই মওলানা সাহেব উচ্চারণ করলেন কথাগুলো।
পুই কে, তা আমি জানতাম। কিন্তু তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের ইচ্ছা এর আগে কাউকে প্রকাশ করতে শুনিনি। আমার জানামতে, চীনে কোনো বিদেশি তখন ছিলেন না , সরি । সঙ্গে পু হর কোনো দিন দেখা হয়েছে। অবশ্য আমার জানামতে, পিকিংয়ের জেল। দেখেছেন এমন কোনো বিদেশিও ছিলেন না। মওলনি সাহেব ইতিপূর্বে সেই অসাধ্য। সাধন করেছেন। তার সঙ্গে জেল দেখার বোনাস আমার ভাগ্যেও জুটেছে। অতএব এবার নেতিবাচক কোনো কিছু না বলে মাথা নেড়ে বললাম।
‘জি! আপনার অনুরোধ চীনের কর্তৃপক্ষের কাছে আজই পৌছে দেব।' ‘শুধু অনুরোধ করলেই হবে না। তোমার রাষ্ট্রদূতকেও বলে যে পুইর সঙ্গে আমি দেখা করবই করব।'
উপায় নেই। ছুটলাম রাষ্ট্রদূতের কাছে। তিনি তো অবাক। ‘পুই? তিনি কি পিকিংয়ে আছেন? জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
বললাম, 'আমি জানি না। তবে মওলানা সাহেবের কথায় তো তা-ই মনে হলো। মওলানা সাহেবের অনুরোধ পৌছে দেওয়া গেল কর্তৃপক্ষের কাছে। দ্বিতীয় দিনেই এল। সুখবর। মওলানা ভাসানী নিশ্চয়ই পু ইর সঙ্গে দেখা করতে পারেন পিকিং বোটানিক্যাল উদ্যানের কার্যালয়ে। পরদিন বিকেল পাঁচটায়। আমার দোভাষীর কপাল আবার গেল খুলে। বলা হলো, আমিও তার সঙ্গে যেতে পারি।
যথাসময়ে পৌছালাম বোটানিক্যাল উদ্যানের কার্যালয়ের সদর দরজায়। নভেম্বর মাস। পিকিংয়ে শীতের হিমেল হাওয়া তখন বইতে শুরু করে দিয়েছে। হেমন্তে শুকনো লালপাতা ঝরে ঝরে পড়ছে শীতের হাওয়ার ছোবলে । বিকেল পাঁচটার দিকেই সন্ধ্যা নেমে আসে নভেম্বরের পিকিংয়ে। ডুবন্ত সূর্যের শেষ রশ্মি পড়ছে রাত জমে থাকা ঝরাপাতার ওপরে। উদ্যানের অসংখ্য তরুরাজির কাছ থেকে হেমন্তে সোনালি পরিপূর্ণতা নিচ্ছে বিদায়। আর কিছুদিনের মধ্যেই বাগান হবে রিক্ত। শীত নামবে পিকিংয়ে । দীর্ঘ ছয়টি মাস । বিরাজ করবে শীতের কঠোর রিক্ততা। যত দিন না, ছমাস পর, সকালে একদিন, পাখি ডেকে ওঠে; গাছের রিক্ত ডালের প্রান্তে শ্যামল মঞ্জরি উঁকি দেয়, বসন্তের আলোছায়ার মাখামাখিতে রিক্ততা মুখ লুকায়।
মনে চাপা উত্তেজনা। চীনের শেষ সম্রাটের সঙ্গে হবে দেখা। শিশুসম্রাট হিসেবে যিনি ১৯০৮ সাল থেকে ১৯১২ সাল পর্যন্ত বসেছিলেন চীনের সিংহাসনে। মাষ্ণুকোর একমাত্র সম্রাট ছিলেন তিনি । ১৯৩৪ থেকে ১৯৪৫ সালে যিনি ছিলেন সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসনে জাপানিদের হাতের খেলার পুতুল।
গাড়িবারান্দায় আমাদের গাড়ি এসে থামল। এগিয়ে এলেন দু-তিনজন চীনা কর্মকর্তা মওলানা ভাসানীকে স্বাগত জানাতে। উগ্রীব দৃষ্টি আমার পু ই-কে খুঁজছে। বারান্দায় দরজার কাছে দেখি দাঁড়িয়ে আছেন চশমা পরা ক্ষীণকায় একটি মানুষ। দাঁড়িয়ে আছেন সলজ্জ হাসিতে অতি সাধারণ একজন মানুষ, প্রৌঢ়ত্ব আর বার্ধক্যের।
সীমারেখা মাড়িয়ে। কিছুটা যেন সংকোচ, কুণ্ঠা আর দ্বিধায় হাত বাড়ালেন তিনি। মওলানা ভাসানী হাত মেলালেন।
ইনিই কমরেড পু ই। আমাদের দোভাষীর ইংরেজির তরজমার আর প্রয়োজন হলো না আমার। ‘আপনার সঙ্গে দেখা করার খুব ইচ্ছে ছিল আমার।' বললেন মওলানা সাহেব।
‘আমি এদের কাছ থেকে আপনার কথা শুনেছি।' পু ই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা চীনা কর্মকর্তাদের দেখিয়ে উত্তর দিলেন।
দুটি মোটা সোফায় পাশাপাশি বসলেন মওলানা ভাসানী আর পু ই। পু ইর পরনে গাঢ় নীল রঙের একটি প্যান্ট। প্যান্টটা আরও সামান্য লম্বা হলে যেন ভালো হতো। আর তার চেয়ে হালকা নীল রঙের গলাবন্ধ একটি কোট। ধোপদুরস্ত নয় তার কাপড় মোটেও। বেশ ক'দিন যেন ইস্ত্রি করা হয়নি। কোটের পকেট চারটি। পাশের পকেট দুটি ফুলে আছে। হয়তো কাগজে। ওপরের একটি বুকপকেটে আটকানানো একটি কলম। মুখে তার বার্ধক্যের ছাপ পুরোপুরি না পড়লেও চোখে পড়েছে। মৃদু সলজ্জ হাসি। মোটা সোফাটিতে বসে কিছুটা যেন হারিয়ে গেছেন দুই দেশের দুই সিংহাসনে বসা শীর্ণকায় মানুষটি।
এই সাক্ষাৎকারের ২৫ বছর পর, ১৯৮৮ সালে আমি ব্রাসেলসে পু ইর জীবনের ওপর তৈরি একটি চলচ্চিত্র দেখেছিলাম- বেরনার্দো বেরতুলুচ্চির দ্য লাস্ট এমপেরর (শেষ সম্রাট )। ছবিটি বেরতুলুচ্চির তৈরি। আমি বলতে বাধ্য যে আমার দেখা পু ই আর ছবিতে দেখা পু ইর মধ্যে ব্যবধান অনেক। আমার মনে হয়নি যে বেরতুলুচ্চি পু ইর ব্যক্তিত্বকে সঠিকভাবে তার নায়কের মাধ্যমে ধরতে পেরেছেন। ছবি দেখে আমার সেদিন মনে হয়েছিল, ঐতিহাসিক কত ছবিরই হয়তো রয়েছে বাবের সঙ্গে খুব কম মিল।
মওলানা পরেছেন চীনে তৈরি ধূসর রঙের গলাবন্ধ একটি মাও স্যুট। গোল কালোটুপি। পায়ে নীল রঙের ক্যানভাসের জুতা। চামড়ার জুতা তাঁর পছন্দ নয়। আজীবন স্যান্ডেল পরা মওলানা ভাসানী। পাশাপাশি বসে একজন সিংহাসনচ্যুত সম্রাট আর একজন জননেতা।
খুব বেশি প্রশ্ন করা হলো না পু ই -কে। তিনি নিজেই বলে গেলেন তাঁর জীবনের ইতিহাসের কিছু অধ্যায় । তিনি জানেন এই সাক্ষাত্তারের মুখ্য উদ্দেশ্য। তাঁরই মুখে তাঁর জীবন থেকে নেওয়া ঘটনা কিছু শোনা।
রাজার ঘরে জন্মানোর জন্য তিনি নিজেকে দায়ী করতে অবশ্যই পারেন না, বললেন তিনি। কিন্তু তাঁর জীবনের সবচেয়ে বিয়োগান্ত দিকটিই হচ্ছে যে তাঁর জীবনের প্রথম চল্লিশটি বছর কেটেছে রাজা রাজা খেলায়। সিংহাসনে বসা ছাড়া যে জীবনের অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে, এটা তাঁকে কখনো বুঝবার অথবা ভাববার সুযোগই নিয়তি দেয়নি। তাঁর জীবনের প্রথম চারটি দশক। এটা চিরকাল তার বিরাট দুঃখ রয়ে যাবে।
চীনের বিপ্লব না এলে তিনি অমানুষ রয়ে যেতেন, বলতে থাকলেন পু ই। মাও সেতুংয়ের শিক্ষা তাঁর জীবনকে প্রথমবারের মতো অর্থবহ করেছে। তিনি অনুতপ্ত তাঁর। প্রথম জীবনের কার্যকলাপের জন্য। তিনি দুঃখিত যে তাঁর প্রথম জীবনে প্রাসাদের। চার দেয়ালের ভেতর ক্ষমতায় ফিরে আসার যড়যন্ত্র ছাড়া তাকে বেশি কিছু করি।
তার ঔৎসুক্য ছিল উদ্ভিদবিদ্যায়। চীনের ইতিহাসে। গণচীনে ফিরে জীবনে এই প্রথমবারের মতো তিনি পেয়েছেন কাজের অনিন্দ। সিংহাসন এর সুযোগই কাছে কিছুই নয়। চীনের বিপ্লব আর চেয়ারম্যান মাওয়ের কাছে তিনি চিরঋণী।
কথাগুলো কি আন্তরিক, না শেখানো কথা? তোতাপাখির মতো বলে যাওয়ার? তার উত্তর দিতে পারতেন একমাত্র পুই। তবে পিকিংয়ে সেই সন্ধ্যা, আমার আজও মনে আছে, আমার সন্দেহপ্রবণ মনেও কথাগুলো আন্তরিকই মনে হয়েছিল।
নতুন জীবনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে তার কি কোনো অসুবিধা হয়নি? আমাদের প্রশ্ন। আবার সলজ্জ হাসি। ‘অবশ্যই। অনেক অসুবিধা হয়েছে।' বললেন তিনি। সবচেয়ে বড় অসুবিধা ছিল এটা ভাবতে যে তিনি সবার মতো একজন। আলাদা কেউ নন।
এই সত্যকে অবশ্য তিনি শুরুতেই গ্রহণ করেছিলেন। তবে এই গ্রহণ করাটাকে স্বাভাবিক অভ্যাসে পরিণত করতে তাঁর লেগেছে বহুদিন ।
আরও একটি বিরাট অসুবিধা তার ছিল, হেসে বললেন তিনি। সেটা হচ্ছে মুদ্রামান ভালো করে বোঝা । কোন জিনিসটা কম মুল্যের আর কোনটা বেশি মূল্যেও, তা বুঝতে তার লেগেছিল বহুদিন। অর্থের কোনো মূল্যই ছিল না তার কাছে। টাকার গায়ে তাঁকে কোনো দিন লাগাতে হয়নি হাত। এক কিলো সোনা আর এক কিলো আপেল। কোনটার কত দাম তা নিয়ে তাঁকে রাজার জীবনে মাথা ঘামাতে হয়নি।
তিনি কি এখন সচ্ছল? প্রশ্ন আমাদের ।
‘যা চাইছি তাই যখন পাচ্ছি, সচ্ছলই তো বলব নিজেকে। থাকার ঘর। পরনের কাপড়। খাওয়াদাওয়া। আর সবচেয়ে বড় কথা, কাজের আনন্দ। গাছে গাছে। ফুলে ফুলে। গ্রন্থাগারে, ইতিহাসের বইয়ের পাতায় পাতায়।
শেখানো কথা? কে জানে?
একটি কথাই বারবার তার মনে হয়, বললেন পু ই। সেটা হচ্ছে এই যে বিপদ তাঁর কেটে গেছে। প্রথম জীবনে ক্ষমতার ষড়যন্ত্রে সব সময় থাকত বিপদের ভয়। আজ তিনি স্বাধীন। মুক্ত। পিকিংয়ে ফিরে এসে বিপদে তিনি একদিইন পড়েছিলেন। এক আত্মীয়ের সঙ্গে শহরে বেরিয়েছিলেন। বাসে চড়ে শহর দেখবেন বলে। বাস এসে থামল। আত্মীয়টি বাসে উঠলেন। তিনি উঠতে যাবেন। হঠাৎ দেখলেন পেছনে একজন।
মহিলা দাঁড়িয়ে। পথ তিনি ছেড়ে দিলেন। কিন্তু মহিলাটি ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বাসটি দিল ছেড়ে। বিপদে পড়লেন পু ই। তিনি কোথায় থাকেন, কোথায় যাবেন, কী করে যাবেন, কিছুই জানেন না। পকেটে নেই পয়সা। তাঁর মনে হলো, যেখানে আছেন সেখানে দাঁড়িয়ে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ। আত্মীয়টি নিশ্চয়ই ফিরে আসবেন। আত্মীয়টি ফিরে এলেন কয় মিনিটের মধ্যেই।
‘আপনার কী হলো? বাসে উঠলেন না কেন?' জিজ্ঞেস করলেন আত্মীয়টি। ‘আমি কী করব?’ বললেন পু ই। মহিলাটি ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই তার বাসটি দিল ছেড়ে।
‘মহিলাকে আপনি উঠতে দিলেন কেন?’ আত্মীয়ের প্রশ্ন ।
‘তুমি তো আমাকে শিখিয়েছিলে, মহিলা এলে উঠে দাঁড়াতে হয়। কোথাও যেতে মহিলাকে পথ দিতে হয় ছেড়ে। আমি তো তা-ই করলাম । কিন্তু বাস দিল ছেড়ে। পু ইর উত্তর।
কিন্তু সেই মহিলা যে ছিল বাসেরই কন্ডাকট্রেস। তাই তার বাস দিল ছেড়ে।
তাঁর আত্মীয়ের এই উত্তর পুনরাবৃত্তি করে হেসে উঠলেন পু ই। এই প্রথমবারের মতো সশব্দ তার উচ্চ হাসি। বাইরে হাসির ছটা। ভেতরে কি চোখের জল তার ছিল? কে দেবে তার উত্তর?
এই সাক্ষাৎকারের চার বছর পরই ১৯৬৭ সালে পিকিংয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন চীনের শেষ সম্রাট, মাঞ্চুকোর একমাত্র সম্রাট, পু ই।
ফারুক চৌধুরী, জীবনের বালুকাবেলায়; প্রথম প্রকাশ : জানুয়ারি ২০১৪, পৃষ্ঠা ১২৩-১৩৩