কথায় কথায় টেস্ট? সব দোষ কি শুধু ডাক্তারের?
কথায় কথায় টেস্ট? সব দোষ কি শুধু ডাক্তারের? - ছবি : সংগ্রহ
পরীক্ষাগারে রোগীকে যন্ত্রনির্ভর পরীক্ষানিরীক্ষায় পাঠিয়ে রোগ নির্ণয় বনাম নাড়ি টিপে ক্লিনিক্যাল ডায়াগনোসিস। এই প্রসঙ্গ উঠলে অবধারিতভাবে যেসব বৃহৎ উদাহরণ উঠে আসে, তারা অবশ্যই ডা. বিধানচন্দ্র রায় ও ডা. নীলরতন সরকার প্রমুখের নাম। এটা ঠিকই যে তারা রোগ ধরতে পটু ছিলেন। ক্লিনিক্যাল ডায়াগনসিসে তাদের যে অভিজ্ঞতা, তাদের যে ব্যুৎপত্তি তা সেভাবে আর কেউ অর্জন করতে পারলেন কোথায়! আবার এটাও মনে রাখতে হবে, তাদের চ্যালেঞ্জ করার কেউ ছিল না। এখান যুগ পাল্টেছে। বদলেছে চিকিৎসাশাস্ত্রের পাঠক্রম, তা আত্মস্থ করার ছাত্র, তার ইচ্ছাশক্তি সবই। বদলেছেন অধ্যাপকরাও। পরীক্ষাগারে পাঠিয়ে একগাদা টেস্ট করে রোগীর পরিবারের অনেকটা আর্থিক খরচ করিয়ে দেয়ার পর চিকিৎসক রোগ নির্ণয় করলে রোগীর তরফ থেকে উষ্মা প্রকাশ হবেই। কিন্তু কেন এই প্রবণতা?
আধুনিকীকরণ ও বিশ্বায়ন : একটা সময় শিক্ষকরা ক্লাসে আসতেন চক ও ডাস্টার নিয়ে। এখন প্রোজেক্টর, নানা প্রোজেক্ট, বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ও গ্যাজেটস নিয়ে শিক্ষাদান চলছে। দুটি ক্ষেত্রেই কিন্তু ভালো শিক্ষার্থী তৈরি হচ্ছে। আগে ডা. বিধানচন্দ্র রায় কোনো অসুখের নিদান দিলে ধরে নেয়া হতো, রোগী সেই রোগেই ভুগছে। কিন্তু ১০০ শতাংশ চিকিৎসা কি এভাবেই নির্ভুল হতো? এখন পরীক্ষাগারেও নানা আধুনিক যন্ত্রাদি ‘হিউম্যান এরর’-এর জায়গা কমিয়েছে।
ক্রেতা সুরক্ষা আইন : এই আইনের পথ ধরে চিকিৎসকরা শুধুই ‘পণ্য পরিষেবা প্রদানকারী’। না রোগীর বন্ধু, না সহায়। চিকিৎসককে মারের ভয়ে প্রাণ হাতে বসে থাকতে হয়। তিনিও তাই নিজের ‘রিস্কে’ রোগ নির্ণয় না করে পাঠিয়ে দেন টেস্ট করতে।
সিলেবাস ও পরিকাঠামো : যন্ত্রনির্ভর চিকিৎসা বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে লাভ নেই। এমন কিছু বেসরকারি কলেজ তো বাইরে থেকে রোগী ভাড়া করে এনে নিজেদের ৭০-৮০ শতাংশ ‘বেড অকুপাই’ দেখিয়ে মেডিক্যাল পড়ানোর ছাড়পত্র পায়। সেখানে ছাত্রছাত্রীরা নাড়ি টিপে ডাক্তারি করার অভিজ্ঞতাই পান না। সরকারি কলেজে তা পেলেও অমানুষিক পরিশ্রম রোগী ধরে পড়ে থাকা, সিলেবাসের বাইরের বেরিয়ে বিস্তারিত জানার ইচ্ছে- সবকিছুতেই কোপ মারছে। ফলে ক্লিনিক্যাল ডায়াগনোসিসে ওস্তাদ হয়ে ওঠার সিলেবাসও নেই। শেখার সময়, পরিসর কিছুই নেই। এমন নানা কারণেই আজকাল যন্ত্রনির্ভর পরীক্ষার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি আমরা। তবে এই ধরনের চিকিৎসার সুবিধাও আছে।
• এর মাধ্যমে খুব দ্রুত বিভিন্ন রোগ নির্ণয় করা যায়। এই ধরুন ব্রেস্ট ক্যান্সার। একটা সময় ছিল যখন এই রোগ ধরাই পড়ত স্টেজ ফোর-এ। এখন ম্যামোগ্রাফি, প্যাপ স্মিয়ার ইত্যাদি পরীক্ষায় অসুখ অনেক আগে ধরা পড়ে।
• আজকাল যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রোগও জটিল হয়েছে। ছোট ছোট উপসর্গ থেকে বড় অসুখ হয়ে যায়। তাই প্রথমেই পরীক্ষা করিয়ে নিলে অনেকটা নিরাপদ থাকা যায়।
• আগেও বলেছি, হিউম্যান এররের হাত থেকে বাঁচা যায়। তবে যন্ত্র যিনি চালান তিনিও মানুষ। যে চিকিৎসক রিপোর্ট নির্ণয় করেন তারও ভুল তারও হতে পারে। তাই পরীক্ষার রিপোর্টও ভুল আসে। সেক্ষেত্রে কোনো রিপোর্টে সন্দেহ হলে আর একবার ভিন্ন জায়গা থেকে সেই পরীক্ষা করিয়ে নিয়েই এগনো উচিত।
* সবশেষে বলি, পুরোটাই ক্লিনিক্যালি বা পুরোটাই যন্ত্রনির্ভর না হয়ে দুই মিলেই আধুনিক চিকিৎসা সম্ভব।
লেখক : রাজ্যের প্রাক্তন স্বাস্থ্য অধিকর্তা (শিক্ষা)