মওলানা ভাসানীর চীনা কারাগারে যা দেখেছেন
মওলানা ভাসানী - ছবি : সংগ্রহ
একদিন রাষ্ট্রদূতের ডাক পড়ল পিকিং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। চীন সরকারের ইচ্ছে, দেশে সরকারপ্রধানের সম্মান দেবেন। থাকবে একটি উড়োজাহাজ, তার ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য। সফরসূচি নির্ভর করবে মওলানা সাহেবের ওপর। মওলানা সাহেব রাজি। ঠিক হলো।
দূতাবাস থেকে আমি যাব মওলানা সাহেবের সঙ্গে, দোভাষী হিসেবে।
পরদিন আমার ডাক পড়ল হাসপাতালে। দু-এক দিনের মধ্যেই হাসপাতাল থেকে। ছাড়া পেয়ে মওলানা সাহেব চলে আসবেন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে। মওলানা সাহেব। আমাকে বললেন, ‘সফরের প্রোগ্রাম বানাবে তুমি। শুধু শীত যেখানে বেশি সেখানে যাব না। আরো একটি কথা। যেখানেই যাই না কেন, সেখানে অন্তত একটি করে কৃষি। কমিউন আমি দেখব। তারপর হেসে বললেন, বসো। তুমি সেদিন ১৯৪৬ সালে নওগাঁর একটি জনসভায় আমার বক্তৃতার কথা বলছিলে।
মওলানা ভাসানী তখন ছিলেন আসাম মুসলিম লীগের সভাপতি। সেই জনসভায় স্কুলের ছাত্র হিসেবে আমিও উপস্থিত ছিলাম। তাঁর বক্তৃতায় , ব্রিটিশ সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেছিলেন, প্রয়োজন হলে এই জনসভায় উপস্থিত আমরা সবাই জেলে যাব।
তিনি বললেন, “তুমি বলছিলে তোমার সেদিন ভয় হচ্ছিল আমার সঙ্গে তোমাকেও যদি জেলে যেতে হয়। সেদিন যাওনি। এবার চলো।
‘জেলে যাব? কেন? আপনিই বা কেন যাবেন জেলে? অবাক বিস্ময়ে বললাম আমি। হেসে উঠলেন মওলানা সাহেব। চোখেমুখে হাসতেন তিনি । প্রাণখোলা হাসি। বললেন, ‘জেলে যাব, জেল দেখতে। তুমি যাবে সঙ্গে। আমারও জেল দেখা হবে। চীনের জেল। তোমারও জেলে যাওয়া হবে প্রথমবারের মতো।
জেল দেখার ঔৎসুক্য আমারও কম নয়। যদি জেল দেখতে যাওয়া হয়, ভাবলাম , বোধহয় আমি হবো চীনের জেল দেখা প্রথম বিদেশি কূটনীতিবিদ। কিন্তু মওলানা সাহেবকে বললাম , জেল' দেখতে যাওয়া? কোনোক্রমেই অনুমতি পাওয়া যাবে না চীনে। কেন? পৃথিবীর কোথাও বোধহয় সম্ভব নয় বিদেশি কোনো মেহমানকে জেল সফরে নিয়ে যাওয়া।
দমবার পাত্র নন ভাসানী। বললেন, আমি একজন অসাধারণ বিদেশি মেহমান। তোমরা চীনের কর্তৃপক্ষকে বলবে , জেলেই আমি কাটিয়েছি আমার জীবনের বিরাট একটি অংশ। তাই আজ চীনে এসে জেল না দেখলে মনে আমার দুঃখ থেকে যাবে?
অকাট্য কি সেই যুক্তি? জেলে ছিলেন বলে জেল দেখবেন? তবু সম্মানিত অতিথি। মওলানা ভাসানী। তাঁর ইচ্ছে চীনের কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছানো দায়িত্ব দূতাবাসের।
তা-ই করা হলো। মওলানা সাহেব বলে দিয়েছিলেন, প্রত্যেক হলে তাঁর এই অনুরোধ যেন প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইয়ের কাছে পৌঁছানো হয়। চীনের পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তা মাথা নেড়ে বললেন, 'এটা এমনই এক অনুরোধ যে শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে তা পেশ করতেই হবে।
আমরা অপেক্ষায় রইলাম। দু-তিন দিনের মধ্যেই এল অবিশ্বাস্য সিদ্ধান্ত। মওলানা সাহেবের অনুরোধ মঞ্জুর। সঙ্গে আমিও যেতে পারি, দোভাষী হিসেবে। দোভাষীর ভাগ্য আমার । দোভাষী হয়ে বিশেষ বিমানে ইচ্ছেমতো বেড়াব চীনে। দোভাষী হয়ে দেখব চীনের কারাগার। কূটনীতিবিদ হিসেবে যেখানে যাওয়া অসম্ভব, দোভাষীর সেখানে রয়েছে প্রয়োজন।
পিকিংয়ের কাছেই জেলটি। বিরাট। চারদিকে দেয়াল। বাইরে থেকে এমন কোনো বৈশিষ্ট্য নেই, যা চোখে পড়ে। জেলে পৌঁছালাম আমরা কজন। মওলানা ভাসানী, আমি, আরও একজন দোভাষী, আর চীন সরকারের দু-একজন কর্মকর্তা। জেলের গেটে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল জেলের কর্তৃপক্ষ। প্রথমে একটি বসার ঘরে চীন দেশের কায়দায় পরিবেশিত হলো চীনের চা।
কারাগারপ্রধান জেল সম্বন্ধে আমাদের বললেন, জেলের জনসংখ্যা নিম্নগামী। চুরিচামারি, খুনখারাবি কমে গেছে সমাজতন্ত্রী চীনে। সন্ত্রাস নেই। নেই সেরকম কোনো সমাজবিরোধী কার্যকলাপ । জুয়া নেই । নেই বেশ্যাবৃত্তি। তবে বিপ্লবের সময়ে অথবা বিপ্লবোত্তর বছরগুলোতে যারা দেশবিরোধী অথবা সমাজবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত ছিলেন, তাঁরা রয়েছেন জেলে।
চারদেয়ালের অভ্যন্তরে চীনের জেলকে মনেই হয় না জেল। জেলের ভেতর সম্বন্ধে বইপড়া ধারণা আমার । কিন্তু মওলানা সাহেবের মূল্যায়ন একজন বা জেল বিশেষজ্ঞের। তিনিই বললেন, এরা জেলখানাকে কারখানা বানিয়ে ফেলেছে।
সত্যি তা-ই । শুধু কারখানা কেন? সত্যিকার অর্থে জেলখানাতে জুতা সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ চলছে। চেয়ারম্যান মাওয়ের রচনাবলি পাঠ।
জেলের ভেতরে সবজির বাগান, হরেক রকম শাকসবজি লাগিয়ে জেলের কয়েদিরা। মনে হয় যেন ছোটখাটো একটি কৃষিখামার। মওলানা ভাসানী প্রীত। পুলকিত। হাতে নিচ্ছেন কুমড়ো। আলু। বেগুন। মনে হচ্ছে সব যেন তারই বাগানের তরকারি আর ফসল। এত আদর, ভালোবাসা দিয়ে শাকসবজির গায়ে হাত বোলাতে কাউকে দেখিনি কোনো দিন।
একটি চেয়ারে বসে একজন মধ্যবয়সী কয়েদি বই পড়ছেন। কী বই পড়ছেন আপনি? ' জিজ্ঞেস করলেন মওলানা সাহেব। চেয়ারম্যান মাওয়ের কবিতা, এল উত্তর।
আরও এগিয়ে গেলাম। খাবার ঘর। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। টেবিলের সঙ্গে বসার জন্য বেঞ্চ। পাশেই রান্নাঘর। একজন বয়স্ক ব্যক্তি বাসন মাজছেন।
'আপনি জেলে কেন?' জিজ্ঞেস করলেন মওলানা সাহেব।
আমি জেলে, কারণ আমি বিপ্লবের সময়ে দেশের বিরুদ্ধে, সমাজের বিরুদ্ধে কাজকর্মে লিপ্ত ছিলাম। আমি ছিলাম দেশদ্রোহী আর সমাজদ্রোহী।' নতমুখে বললেন বাসন মাজারত বয়স্ক কয়েদিটি।
‘আপনি কী ছিলেন? আবার মওলানার প্রশ্ন। ‘আমি ছিলাম চিয়াং কাইশেকের সেনাবাহিনীতে তিন তারকাবিশিষ্ট জেনারেল।
আমি আমার অতীত কার্যকলাপের জন্য দুঃখিত এবং লজ্জিত। এখানে কাজ করে আয় এখন কাজের মর্যাদা অনুধাবন করার সুযোগ পেয়েছি।'
কথাগুলো যেন কিছুটা মুখস্থের মতো আওড়ে গেলেন সেই তিন তারকাবিশিষ্ট চিয়াং কাইশেক বাহিনীর লেফটেন্যান্ট জেনারেল।
আরও কিছুদূর এগিয়ে সুদর্শনা, লম্বা, ফরসা একজন তরুণী। কী যেন সেলাই করছেন। উঠে দাঁড়ালেন আমাদের দেখে। উত্তর চীনেরই হবেন। কালো ঘন তার চোখের ভুরু। ডাগর চোখ। বিষন্ন চেহারা। কাছে এসে দাঁড়ালেন মওলানা ভাসানী। চীনের বিপ্লবে যোগদানের বয়স তরুণীটির ছিল না। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘জিজ্ঞাসা করো, ও কেন এখানে। আমি ইংরেজিতে তরজমা করলাম তার প্রশ্ন। চীনা দোভাষী করলেন চীনা ভাষায়। মেয়েটি দাঁড়িয়ে রইলেন। অপলক দৃষ্টিতে। কোনো কথা না বলে।
‘উত্তর দিচ্ছে না কেন?' জিজ্ঞেস করলেন মওলানা সাহেব।
মেয়েটি নীরব। শুরু হলো আমাদের সঙ্গী চীনা কর্মকর্তাদের মধ্যে কথোপকথন। চীনা ভাষায়। মিনিট দুয়েক পর বুঝলাম, তারা মেয়েটির ব্যাপারেই আলোচনা করছেন। কথা শেষে তাদের জ্যেষ্ঠতম কর্মকর্তা কেশে একটু গলাটা পরিষ্কার করলেন। বললেন, ‘এই মেয়েটি ছিল লোভী। লোভের বশে অর্থের প্রত্যাশায় একই সময়ে একাধিক ব্যক্তির কাছে সে তার প্রেম নিবেদন করত । তাই তাকে মৃদু শাস্তি দেওয়া হয়েছে।
দোভাষী হিসেবে বাংলায় বলা আমার এই কথাগুলোকে মুখ থেকে কেড়েনিয়েই যেন মওলানা ভাসানী বললেন, ‘ও, বুঝেছি। মেয়েটি বেশ্যা। সরকারিভাবে চীনারা স্বীকার করে না যে সমাজতন্ত্রী এই দেশে বেশ্যাবৃত্তি আছে। কথাটি তাই তাঁরা ঘুরিয়ে বলছেন।
জেল থেকে ফেরার পথে গাড়িতে বসেই মওলানা ভাসানীর প্রশ্ন , “কী, অবশেষে তোমার তাহলে জেলে যাওয়া হলো!'
প্রশ্নটি আমাকে। তাই দোভাষী হিসেবে এবারের মতো আর তরজমার কোনো। প্রয়োজন ছিল না ।
* মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ১৯৬৩ ও ১৯৬৪ সালে চীন সফর করেছিলেন। তার সফরকাহিনী মাও সে-তুঙ-এর দেশে নামে প্রকাশিত হয়েছে। ওই কাহিনী ফারুক চৌধুরীর জীবনের বালুকাবেলায় প্রকাশিত হয়েছে।