সর্বাত্মক বিজয় চাইছেন পুতিন?
পুতিন - ছবি : সংগ্রহ
ইউক্রেনের চার পাশে সেনা সমাবেশ ঘটানোর পর থেকেই রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে এক ধরনের কট্টর স্বর ধ্বনিত হচ্ছিল। যুক্তরাষ্ট্র আর ন্যাটোকে তিনি তখন বলেন, ন্যাটোর পূর্বমুখী সম্প্রসারণ বন্ধ রাখা এবং এর আগে ১৯৯৭ সালের পর যে সম্প্রসারণ করা হয়েছে তা পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নেবার অঙ্গীকার করতে হবে। পুতিন ভালো করে জানতেন এটি যুক্তরাষ্ট্র বা ন্যাটোর পক্ষে করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। বাস্তবে ঘটেছেও সেটিই।
এরপর বেলারুশকে সাথে নিয়ে ইউক্রেনের ওপর সর্বাত্মক সামরিক অভিযানে ঝাঁপিয়ে পড়ে রাশিয়া। যুদ্ধ শুরু হবার পর রাশিয়া তিন দফা সমঝোতার জন্য শান্তি আলোচনায় মিলিতও হয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই তাদের স্বর ও শর্ত আরো চড়া হয়েছে। ইউক্রেনকে অসম্ভব সব শর্ত মেনে নেয়ার জন্য চাপ দিয়েছে আর সে সাথে যুদ্ধের বিধ্বংসী তৎপরতা বাড়িয়েছে ক্রেমলিন। সর্বশেষ তাদের দুই স্তরে যেসব শর্তের কথা প্রকাশ করা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে, ইউক্রেনকে সুইডেন অস্ট্রিয়ার মতো নিরপেক্ষ থাকার অঙ্গীকার করতে হবে, ন্যাটো বা ইউরো জোনে না যাবার বিষয়টি সংবিধান সংশোধন করে নিশ্চিত করতে হবে, ইউক্রেনীয় সামরিক বাহিনীর নিরস্ত্রীকরণের পদক্ষেপ নিতে হবে, রাশিয়ার স্বীকৃতি অনুযায়ী ডনবাসের দুটি অঞ্চলের স্বাধীনতাকে মেনে নিতে হবে, ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অংশ হিসেবে মেনে নিতে হবে আর সংশ্লিষ্ট সমুদ্রাঞ্চলে রুশ নিয়ন্ত্রণের স্বীকৃতি দিতে হবে আর সে সাথে ক্রাইমিয়ার জন্য মিষ্টি পানির সরবরাহের নিশ্চয়তাও বিধান করতে। এছাড়া রাশিয়ার ‘নব্য নাৎসি’ হিসাবে চিহ্নিত রুশবিরোধী দলকে নিষিদ্ধ করতে হবে।
ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির পক্ষে তার দেশকে নিরপেক্ষ রাখা বা ন্যাটো-ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদান না করার অঙ্গীকারের বাইরে অন্য কোনো দাবি মেনে নেয়া সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। রাশিয়াও তার আক্রমণের ধারা অব্যাহত রাখতে চেষ্টা করবে আর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ গোপনে অস্ত্র দিয়ে ইউক্রেনের প্রতিরোধ যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা করবে। সেই প্রচেষ্টা যতটা তীব্রতা পাবে যুদ্ধের শাখা-প্রশাখা ততটা নানা স্থানে বিস্তৃতি পাবে।
কেন উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ছে?
যুদ্ধ উত্তেজনা ইউক্রেন অঞ্চল থেকে বাইরে ছড়িয়ে পড়ার যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে তার পেছনের মূল কারণই হলো বিদ্যমান বিশ্বব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ জানানো। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখলের পর রাশিয়ার ওপর আর ট্রাম্প জমানায় চীনের সাথে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরুর পর বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে নিষেধাজ্ঞা ও অবরোধ আরোপের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। ইউক্রেন অভিযান শুরু হবার পর রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক অবরোধকে সর্বোচ্চ তীব্র আকার দেয়া হয়েছে। একই সাথে রাশিয়াকে সমর্থন দেয়া হলে চীনের ওপর একই ধরনের অবরোধ বা নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি দেয়া হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে। এ নিয়ে জো বাইডেন সরাসরি শি জিন পিনের সাথে কথাও বলেছেন।
এ ধরনের অবরোধ আরোপের দুই প্রধান অস্ত্র হলো বৈশ্বিক বাণিজ্য লেনদেনের তথ্য জোগান নেটওয়ার্ক সুইফট এবং বৈশ্বিক লেনদেনে মার্কিন ডলারভিত্তিক আন্তর্জাতিক মুদ্রা ও ব্যাংকব্যবস্থা। দুই ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ রয়েছে আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের হাতে।
রাশিয়া ও চীন বহু দিন ধরে বিশ্ব অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণের এই দুই প্রধান অস্ত্রকে অকার্যকর করার জন্য কাজ করে আসছে। এজন্য রাশিয়া ও চীন সুইফটের দুটি বিকল্প লেনদেন তথ্য নেটওয়ার্ক সিস্টেম চালু করেছে। কিন্তু এই নেটওয়ার্কের আওতা সীমিত থাকায় বৈশ্বিক বাণিজ্যে তা তেমন প্রভাবশালী হয়ে উঠতে পারেনি। তবে এর নেটওয়ার্ক বিস্তৃত হচ্ছে ক্রমে। অন্যদিকে বিশ্ববাণিজ্যে ডলারের আধিপত্য খর্ব করতে জাতীয় মুদ্রায় বাণিজ্যিক লেনদেনের একটি প্রক্রিয়া তৈরির চেষ্টা করছে চীন-রাশিয়া বলয়ের দেশগুলো। জাতীয় ও বৈশ্বিক লেনদেনের অভিন্ন বৈশ্বিক ডিজিটাল মুদ্রা প্রচলনের উপরও কাজ করছে চীন।
এই দুটি উদ্যোগ সফল হওয়ার অর্থ হলো আমেরিকান বা পশ্চিমা নিয়ন্ত্রক আধিপত্য ব্রেটন-উড চুক্তির মাধ্যমে সুচিত বিশ্বব্যবস্থায় গৌণ হয়ে পড়া। এই উদ্যোগ সমাপনীর দিকে যাবার আগে তাতে বাধা তৈরিতে ইউক্রেন যুদ্ধ হয়তো বা একটি সুযোগ সৃষ্টি করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সামনে। সুইফট বা ডলারের কার্যক্ষমতা ভোঁতা হবার আগেই সেটিকে চূড়ান্তভাবে প্রয়োগের প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে।