মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা
দুই প্রিন্স - ছবি : সংগ্রহ
জাতীয় পর্যায়ের যুদ্ধ যখন বৈশ্বিকভাবে ছড়িয়ে পড়ে তখন মহাযুদ্ধ শুরুর একটি পরিবেশ তৈরি হয়। মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনা সেটিই তৈরি করছে বলে মনে হয়। প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও বাদশাহ ফয়সল যখন যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবে ক্ষমতায় ছিলেন তখন দু’দেশের মধ্যে এই মর্মে চুক্তি হয় যে আমেরিকার জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে সৌদি আরব আর জ্বালানি তেল বিক্রি করা হবে কেবলমাত্র মার্কিন ডলারে। এর বিনিময়ে আমেরিকা সৌদি রাষ্ট্র ও রাজপরিবারের ক্ষমতা ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেবে।
আরব বসন্তের সময় দেশে দেশে একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যে জনবিদ্রোহ দেখা দেয় তার পেছনে য্ক্তুরাষ্ট্রের ইন্ধন সক্রিয় ছিল বলে সৌদি আরব ও তার মিত্র দেশগুলোর ধারণা ছিল। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের ক্রাউন প্রিন্স মুহাম্মদ বিন সালমান ও মুহাম্মদ বিন জায়েদের মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে প্রভাবশালী হিসাবে উত্থান ঘটে। আমেরিকায় ক্ষমতায় আসা রিপাবলিকান দলের ডোনাল্ট ট্র্যাম্পের সাথে বিশেষ সমীকরণ তৈরির মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে একনায়কত্ব বা রাজতন্ত্রের সামনে থাকা চ্যালেঞ্জকে শেকড়হীন করার প্রচেষ্টা তারা ক্ষমতার দুর্দমনীয় প্রয়োগের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেন।
যুক্তরাষ্ট্রে রিপাবলিকান দল ও ট্র্যাম্পের শাসনের পরাজয়ের পর জো বাইডেনের নতুন প্রশাসন মধ্যপ্রাচ্যের দুই ক্রাউন প্রিন্সের কর্তৃত্বকে মেনে নিতে চাইছেন বলে মনে হয় না। এতে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বিন সালমান ও বিন জায়েদ দুজনই বিকল্প বৈশ্বিক শক্তি চীন রাশিয়ার সাথে তৈরি করেন বিশেষ সমীকরণ। সৌদি আরব আমেরিকার বিকল্প তেলের বাজার হিসাবে চীনকে ব্যবহার করে আর সেই সাথে সৌদি আরব নতুন নির্মাণাধীন কৌশলগত নিওম নগরীসহ নানা ক্ষেত্রে চীনা বিনিয়োগের ক্ষেত্র সৃষ্টি করে। রাশিয়ার কাছ থেকে সমরাস্ত্র কিনে একটি বিশেষ সম্পর্ক তৈরি করে রিয়াদ। একই পথে হাঁটে আমিরাত মিসরসহ আরো কিছু মিত্র দেশ।
ইউক্রেন সংঘাতে আমেরিকার সাথে মধ্যপ্রাচ্যের এই রাজতান্ত্রিক শাসকদের দূরত্ব তীব্রভাবে প্রকাশ হয়। রাশিয়ার ওপর তেল গ্যাসে আমেরিকান নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর বাজার ঠিক রাখতে জো বাইডেন তেল উৎপাদন বাড়ানোর অনুরোধ জানানোর জন্য দুই ক্রাউন প্রিন্সকে টেলিফোন করেছিলেন। বলা হচ্ছে, তাদের দুজনের কেউই সেই ফোনে সাড়া দেননি। বরং এরপরই মুহাম্মদ বিন সালমান ঘোষণা করেন, সৌদি আরব এখন এককভাবে মার্কিন ডলারে তেল বিক্রির নীতি থেকে সরে আসবে এবং চীনকে তার জাতীয় মুদ্রা ইয়েন তেল সরবরাহ করবে। এর প্রভাব যে মার্কিন ডলারে কতটা পড়বে তা বোঝা যায় তাৎক্ষণিকভাবে ইরানের রিপাবলিকান গার্ডের ওপর আমেরিকান নিষেধাজ্ঞা তুলে দেয়ার ঘোষণায়। এই রিপাবলিকান গার্ডই ইয়েমেন থেকে শুরু করে সিরিয়া ইরাক লেবানন পর্যন্ত সর্বত্র ইরানি প্রক্সির সমন্বয়কারী ভূমিকা পালন করে আসছে। এ ছাড়াও ইরানের সাথে পরমাণু চুক্তি পুনর্বহাল এবং দেশটির ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার সিদ্ধান্ত ওয়াশিংটন নিতে যাচ্ছে বলে আভাস দেয়া হচ্ছে।
এর সরল অর্থ হলো বৈশ্বিক সংঘাতে সৌদি আরব আমিরাত ও তার মিত্ররা চীন রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়ার সাথে সাথে বাইডেন প্রশাসন ইরানকে সর্বোতভাবে মদদ দেয়া শুরু করবে। সৌদি আরব ৮১ জনের শিরোশ্ছেদের রায় কার্যকর করার পর ইরানের সাথে এর মধ্যে উত্তেজনা বেড়ে গেছে। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা এসব ব্যক্তির অর্ধেকই হলো ইরানপন্থী ও শিয়া।
মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টির এই পরিস্থিতি যেকোনো সময় ভয়ঙ্কর এক রূপ নিতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যদিও এক্ষেত্রে অনেক খেলাই এখনো বাকি রয়েছে বলে মনে হয়। তুরস্ক ও ইসরাইলেরও এই সমীকরণে প্রভাবশালী ভূমিকা থাকবে। তবে এই দুটি দেশ কোনো এক পক্ষে প্রান্তিকভাবে না ঝুঁকে ভারসাম্য বজায় রাখার নীতি নিতে পারে।