ইউক্রেনকে কী কী সামরিক সাহায্য দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র?
ইউক্রেনকে কী কী সামরিক সাহায্য দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র? - ছবি : সংগ্রহ
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভ্লদিমির জেলেনস্কি আরো সামরিক সহায়তার জন্য মার্কিন কংগ্রেসে একটি আবেগপূর্ণ আবেদন জানান। সেই আবেদনের কয়েক ঘণ্টা পরেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বিস্তৃত অস্ত্র ও সরঞ্জামাদির তালিকা তুলে ধরেন, যা রাশিয়ার আক্রমণ প্রতিহত করতে ইউক্রেনকে দেয়া হবে। নতুন ৮০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সাহায্য প্যাকেজ অস্ত্রের উপর কেন্দ্র করে, যা ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী ইতিমধ্যে রাশিয়ানদের বিরুদ্ধে কার্যকরভাবে ব্যবহার করছে। এর মধ্যে রয়েছে জরুরিভাবে প্রয়োজনীয় আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। আমেরিকায় তৈরি নয় এমন দূরপাল্লার বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পেতে সাহায্য করার জন্য বাইডেন প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ইউক্রেনকে। রাশিয়ার তৈরি এস-৩০০এস বা অনুরূপ সারফেস-টু-এয়ার মিসাইল সিস্টেম, যা অন্যান্য ন্যাটোভুক্ত পূর্ব ইউরোপের দেশগুলির কাছে রয়েছে। এই ধরনের সিস্টেমগুলো অত্যন্ত কার্যকর এবং বিমানগুলোকে গুলি করতে পারে এবং ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রকে বাধা দিতে পারে।
বাইডেন পরে একজন প্রতিবেদককে বলেছিলেন যে তিনি মনে করেন রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন একজন 'যুদ্ধপরাধী'। যদিও হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র জেন সাকি পরে বলেছিলেন যে বাইডেন তার হৃদয় থেকে কথা বলছিলেন। স্টেট ডিপার্টমেন্ট এখনো নির্ধারণ করেনি যে পুতিন আসলেই যুদ্ধপরাধ করেছেন কিনা।
একজন ঊর্ধ্বতন মার্কিন প্রতিরক্ষা কর্তা বুধবার বলেছেন যে ইউক্রেনীয়দের এমন সিস্টেম সরবরাহ করা হবে যা তারা ব্যবহার করতে জানে, তারা ইতিমধ্যে প্রশিক্ষিত এবং ব্যবহার করার জন্য সজ্জিত এবং তারা আগে কার্যকরভাবে ব্যবহার করছে।
দুটি বিষয় ছিল যা জেলেনস্কি বারবার অনুরোধ করেছেন। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো দৃঢ়ভাবে সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছে। একটি হলো- রাশিয়ায় তৈরি মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান ইউক্রেনে পাঠানো এবং দ্বিতীয়টি হলো ইউক্রেনের উপর একটি নো-ফ্লাই জোন স্থাপন। পশ্চিমারা বিশ্বাস করে এর যেকোনো একটি করলে রাশিয়ার সাথে বৃহত্তর যুদ্ধ শুরু হতে পারে। হোয়াইট হাউস আরো বলেছে যে ওয়াশিংটন ইউক্রেনীয়দের অতিরিক্ত, দীর্ঘ পরিসরের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পেতে সহায়তা করছে।
কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক অধ্যাপক স্টিফেন বিডল বলেছেন যে যদিও ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহ করার ঝুঁকি রয়েছে, তবে সেটা মিগ যুদ্ধবিমান সরবরাহ করা বা নো-ফ্লাই জোন কার্যকর করার চেয়ে কম ঝুঁকি রয়েছে। তিনি উল্লেখ করেছেন যে জার্মানি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লেন্ড লিজ প্রোগ্রামের অধীনে ট্যাঙ্ক, বোমারু বিমান এবং অন্যান্য অস্ত্র ব্রিটেনে পৌঁছতে বাধা দেয়ার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আক্রমণ করেনি।
বিডল বলেন, 'ইউক্রেন যুদ্ধে কোনো কিছুই ঝুঁকিমুক্ত নয়। সমস্যাটি এখন ঝুঁকির ভারসাম্য তৈরি করছে, যা এড়ানো যায় না। আমরা যত বেশি প্রাণঘাতী অস্ত্র হস্তান্তর করব তত বেশি ঝুঁকি। পুতিনকে ইউক্রেন ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর অনুমতি দেয়ার মধ্যেও ঝুঁকিও রয়েছে।'
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনে যা যা অস্ত্র সরঞ্জাম পাঠাচ্ছে
নতুন অস্ত্র এবং সরঞ্জাম :
* ৮০০টি স্টিংগার অ্যান্টি-এয়ারক্রাফ্ট সিস্টেম
* ২০০০টি সারফেস-টু-এয়ার জ্যাভলিন মিসাইল, যেগুলো কাঁধে বসিয়ে ছোড়া যায়
* ১০০০টি হালকা অ্যান্টি-আরমার অস্ত্র
* ৬০০০টি এটি-৪ বহনযোগ্য অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক অস্ত্র
* ১০০টি কৌশলগত মানবহীন সিস্টেম
* ১০০টি গ্রেনেড লঞ্চার
* ৫০০০টি রাইফেল, ১০০০টি পিস্তল, ৪০০টি মেশিনগান এবং ৪০০টি শটগান
* ২০ মিলিয়নেরও বেশি রাউন্ড গোলাবারুদ এবং গ্রেনেড লঞ্চার এবং মর্টার রাউন্ড
* বডি আর্মার এবং হেলমেটের ২৫০০০ সেট
* সামরিক সরঞ্জাম ইতিমধ্যে দেয়া হয়েছে বা প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে :
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যেই ইউক্রেনকে ১.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার নিরাপত্তা সহায়তা দিয়েছে বা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে-
৬০০টিরও বেশি স্টিংগার অ্যান্টি-এয়ারক্রাফ্ট সিস্টেম
প্রায় ২৬০০ জ্যাভলিন অ্যান্টি আর্মার সিস্টেম
৫টি এমআই-১৭ হেলিকপ্টার
৩টি টহলদারি নৌকা
৪টি কাউন্টার-আর্টিলারি এবং কাউন্টার-মানবহীন এরিয়াল সিস্টেম ট্র্যাকিং রাডার
৪টি কাউন্টার-মর্টার রাডার সিস্টেম
২০০ গ্রেনেড লঞ্চার এবং গোলাবারুদ
২০০ শটগান এবং ২০০ মেশিনগান
প্রায় ৪০ মিলিয়ন রাউন্ড গোলাবারুদ এবং ১ মিলিয়নেরও বেশি গ্রেনেড, মর্টার এবং আর্টিলারি রাউন্ড
৭০টি উচ্চ গতিশীল বহুমুখী চাকার যান এবং অন্যান্য যানবাহন
ইলেকট্রনিক শনাক্তকরণ সিস্টেম, বডি আর্মার, হেলমেট এবং অন্যান্য কৌশলগত গিয়ার
সামরিক চিকিৎসা সরঞ্জাম
বিস্ফোরক নিষ্ক্রিয় সরঞ্জাম
স্যাটেলাইট ছবি এবং বিশ্লেষণ ক্ষমতা
রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেন কী কী অস্ত্র ব্যবহার করছে?
ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী সোভিয়েত জমানায় নির্মিত একাধিক রকেট লঞ্চার এবং হাউইৎজারের উপর নির্ভর করেছে, এই সরঞ্জাম রাশিয়ান সামরিক বাহিনীতেও রয়েছে। রাশিয়ার ইস্কান্দার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং কালিব্র ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের মতো অত্যাধুনিক দূরপাল্লার নির্ভুল অস্ত্র ইউক্রেনের হাতে নেই। ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীতে সোভিয়েত যুগের তোচকা-ইউ স্বল্প-পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে, যার শক্তিশালী ওয়ারহেড আছে। কিন্তু রাশিয়ান অস্ত্রের তুলনায় তা দুর্বল। পুরনো সোভিয়েত-নির্মিত অস্ত্র ছাড়াও ইউক্রেন পশ্চিমা অস্ত্রের বড় চালান পেয়েছে, যেমন মার্কিন জ্যাভলিন অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক মিসাইল এবং স্টিংগার অ্যান্টি-এয়ারক্রাফ্ট মিসাইল। ইউক্রেনের কর্তারা বলেছেন যে দেশটির সামরিক বাহিনী এগুলো ব্যবহার করে আক্রমণকারী রুশ বাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করেছে। যুদ্ধের আগে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী তুরস্ক থেকে কেনা বায়রাক্টার ড্রোনও ব্যবহার করেছে। কিভ একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে যাতে রাশিয়ান সামরিক কনভয়ের বিরুদ্ধে বায়রাক্টারের আক্রমণ দেখা যাচ্ছে।
কেন ইউক্রেন তার পারমাণবিক অস্ত্র ছেড়ে দিয়েছিল?
১৯৮৯ সালে বার্লিন প্রাচীরের পতনের পর ভেঙে যাওয়া সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীনতার পথে যাত্রা শুরু করে ইউক্রেন। ১৯৯০ সালে সার্বভৌমত্বের ঘোষণা করে তারা যা সোভিয়েত রাশিয়ার ভেঙে যাওয়ার ঠিক এক বছর আগে। ইউক্রেন প্রজাতন্ত্র সোভিয়েত রাশিয়ার ১৫টি দেশের মধ্যে একটি ছিল। ১৯৮৬ সালে চেরনোবিল বিপর্যয়ের সময় ইউক্রেনের পারমাণবিক অস্ত্রের কমান্ড এবং নিয়ন্ত্রণ ছিল মস্কোতে। তৎকালীন ইউক্রেনীয় নেতারা আশঙ্কা করেছিলেন যে এটি তাদের স্বাধীনতার পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। সেই সময়ে, ইউক্রেনের কাছে ১৭৬টি ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালিস্টিক মিসাইল, ৪৪টি ক্রুজ মিসাইল সজ্জিত কৌশলগত বোমারু বিমান ছিল। উপরন্তু, ছিল ২ হাজার ৬০০ কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র। কিন্তু প্রশ্নটি তখন ওঠে যে এই অস্ত্রের মালিকানা কার কাছে থাকবে। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধান উত্তরসূরি রাষ্ট্র হিসাবে রাশিয়ার কাছে থাকবে, নাকি ইউক্রেন বা বেলারুশ বা কাজাখাস্তানের কাছে থাকবে। ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালিস্টিক মিসাইলের দীর্ঘ পরিসরের পরিপ্রেক্ষিতে অস্ত্রাগারের রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়টি ছিল মাথায়। অস্ত্র ধরে রাখার অর্থ হল ইউক্রেন এনপিটির বাইরে একটি পারমাণবিক রাষ্ট্র হবে। (পি৫ দেশ ব্যতীত অন্যান্য স্বাক্ষরকারীদের অ-পারমাণবিক রাষ্ট্র হতে হবে অথবা পারমাণবিক অস্ত্র ছেড়ে দিতে হবে)। ইউক্রেন, যারা ইউরোপের অংশ হতে চেয়েছিল তারা নিষেধাজ্ঞা এবং বিচ্ছিন্নতার মধ্যে দিয়ে নতুন যাত্রা শুরু করতে চায়নি।
১৯৯৪ সালের শুরুর দিকে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের চুক্তি করে ইউক্রেন। বুদাপেস্ট মেমোরেন্ডাম নামে পরিচিত ওই চুক্তিতে সই করেছিল রাশিয়া, ইউক্রেন, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র। চুক্তিতে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল যে আত্মরক্ষা ব্যতীত কোনও দেশই ইউক্রেনের বিরুদ্ধে শক্তি ব্যবহার করবে না এবং সবাই দেশটির সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতাকে সম্মান জানাবে। চুক্তিতে আরও বলা ছিল, আগ্রাসন হলে ইউক্রেনকে সহায়তার জন্য চুক্তিকারীরা রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে অবিলম্বে পদক্ষেপ নেবে। চুক্তিতে স্বাক্ষরকারীরা ছিলেন ইউক্রেনের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট লিওনিড কুচমা, মার্কিন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন, রাশিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিন এবং ব্রিটেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জন মেজর। পরে চীন এবং ফ্রান্সও স্বাক্ষর করে। তবে সবটাই ছিল একটি আশ্বাস ছিল, কোনো নিরাপত্তা গ্যারান্টি নয়।
বুদাপেস্ট মেমোরেন্ডাম স্বাক্ষরের দুই বছরের মধ্যেই ১৯৯৬ সালে ইউক্রেন তার মাটিতে থাকা সমস্ত পারমাণবিক অস্ত্র রাশিয়ার কাছে হস্তান্তর করে। ইউক্রেনও কঠিন দর কষাকষি করতে সক্ষম হয়েছিল। রাশিয়া তার প্রতিবেশীকে ১ বিলিয়ন ডলারের অর্থ প্রদানের মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ দিয়েছে এবং ইউক্রেনের সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুদ কেনার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও বিশাল অর্থ দিয়েছে। যদিও ইউক্রেনের উদ্বেগ অব্যাহত ছিল কারণ রাশিয়া নতুন আন্তর্জাতিক সীমানা পুরোপুরি মেনে নেয়নি। রাশিয়া ন্যাটোর সম্প্রসারণের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। ভ্লাদিমির পুতিন ১৯৯৯ শেষের দিকে বরিস ইয়েলৎসিনের স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন। ২০০৭ সালে মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে ন্যাটোর সম্প্রসারণ নিয়ে প্রথম উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন পুতিন। তিনি সরসারি এই বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে অভিযোগের আঙুল তোলেন। পুতিনের অভিযোগ ছিল, আমেরিকা নিজেকে আন্তর্জাতিক আইনের ঊর্ধ্বে বিবেচনা করছে এবং একতরফা পদক্ষেপের মাধ্যমে নতুন অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু করেছে।
সূত্র : নিউজ ১৮