ইউক্রেন যুদ্ধে চীন কি রাশিয়াকে সামরিক সহায়তা দেবে?

অন্য এক দিগন্ত | Mar 22, 2022 03:06 pm
ইউক্রেন যুদ্ধে চীন কি রাশিয়াকে সামরিক সহায়তা দেবে?

ইউক্রেন যুদ্ধে চীন কি রাশিয়াকে সামরিক সহায়তা দেবে? - ছবি : সংগ্রহ

 

সম্প্রতি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলেছে যে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে চীনকে সামরিক সহায়তা দিতে বলেছে রাশিয়া। চীনও নাকি ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। মস্কো ও বেইজিং উভয়ই এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। একজন চীনা মুখপাত্র এটিকে আমেরিকার দাবিকে বিভ্রান্তি বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও এনিয়ে আলাদা বিবৃতি দিয়েছে।

আমেরিকা কী বলেছে?

চীনের কাছে রাশিয়া সামরিক সহায়তা চেয়েছিল বলে প্রাথমিক প্রতিবেদনের পর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মার্কিন কর্মকর্তারা বলেছেন যে ওয়াশিংটন তার দাবিতে স্থির থাকছে যে রাশিয়াকে সামরিক সাহায্য চেয়ে চীনের কাছে সংকেত পাঠিয়েছে। বেইজিং সামরিক সহায়তা দিতে ইচ্ছুক। এছাড়াও পশ্চিমী নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব পড়বে, সেই প্রভাব কম করতে আর্থিক সহায়তা দিতেও রাজি হয়েছে লাল চীন। সোমবার রোমে একটি বৈঠকে মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান চীনা পররাষ্ট্র নীতি বিষয়ক উপদেষ্টা ইয়াং জিচিকে এই ধরনের সমর্থন দেয়ার বিরুদ্ধে সতর্ক করেছিলেন। তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, নিষেধাজ্ঞার ফাঁস থেকে রাশিয়াকে মুক্ত করার কোনো চেষ্টা করলে তার ফল ভুগতে হবে বেজিংকে। মার্কিন টিভি নেটওয়ার্ক সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, 'বেইজিংয়ের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করে আমরা বলেছি নিষেধাজ্ঞা ভাঙার বড় কোনো চেষ্টা দেখা গেলে অবশ্যই তার পরিণতি ভোগ করতে হবে। আমাদের দেয়া নিষেধাজ্ঞা ভাঙার কোনো চেষ্টা বিশ্বের কোথাও আমরা সফল হতে দেব না।'

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনের উদ্দেশ্যও সম্পর্কে সতর্ক। কারণ চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সরকার রাশিয়ার আক্রমণের সমালোচনা করতে অস্বীকার করেছে, এমনকি তারা আলোচনার আহ্বান জানিয়ে যুদ্ধ থেকে নিজেকে দূরে রাখতে চায়। নিরাপত্তা পরিষদে এবং পরে সাধারণ পরিষদের রাশিয়াকে নিন্দা করে আনা প্রস্তাবের পক্ষে তারা ভোট দেয়নি। যদিও চীন পরবর্তীকালে জানিয়েছে, কোনো দেশের ভূখণ্ডকে অবশ্যই সম্মান করতে হবে।

জো বাইডেন-শি জিনফিং ফোনালাপ :

শুক্রবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রায় ২ ঘণ্টা ফোনে কথা বলেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সাথে। তাদের মধ্যে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে কথা হয়েছে। রাশিয়াকে সমর্থন করলে তার পরিণাম সম্পর্কে চিনা রাষ্ট্রপ্রধানকে জানিয়ে দিয়েছেন বাইডেন। হোয়াইট হাউস এক বিবৃতিতে বলেছে, বাইডেন ইউক্রেনের শহর ও অসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে নৃশংস হামলা চালানোর জন্য রাশিয়াকে সহায়তা দিলে এর প্রভাব ও পরিণতি বর্ণনা করেছেন। চীনের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন সিসিটিভি জানিয়েছে যে পাল্টা শি বলেছেন যে যুদ্ধ কারো স্বার্থের পক্ষে নয়। রাষ্ট্র থেকে রাষ্ট্র সম্পর্ক সামরিক শত্রুতার পর্যায়ে যেতে পারে না। যাই হোক, জিনপিং আবারো ক্রেমলিনের সরাসরি কোনো সমালোচনা করেননি। চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি বলছে, বাইডেনকে শি বলেছেন যে যুদ্ধ থামাতে সব পক্ষের আলোচনা দরকার। শি বলেছেন, 'ইউক্রেন সঙ্কটের মূল সমাধান এবং রাশিয়া ও ইউক্রেন উভয়ের নিরাপত্তা উদ্বেগ কমাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোরও রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনায় বসা উচিত।'

চীন কী সহায়তা দিতে পারে?

ফাইটার জেট এবং ট্যাঙ্কের চেয়ে চীন বুলেট এবং খাবার সরবরাহ করতে পারে রাশিয়াকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীন সম্ভবত একটি সংঘাতের মধ্যে রাশিয়ার কাছে হাই-প্রোফাইল বা বড় অস্ত্র বিক্রি এড়াতে চায়। যা বেইজিংকে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার মুখে ফেলবে। বদলে বেইজিং খুচরা যন্ত্রাংশ, ভোগ্যসামগ্রী, গোলাবারুদ এবং এমন সরঞ্জাম সরবরাহ করতে আরো ইচ্ছুক হবে যার কারণে নিষেধাজ্ঞা চাপবে না। উদাহরণস্বরূপ, রাশিয়ান হেলিকপ্টারগুলো সম্ভবত স্টিংগারের মতো বহনযোগ্য স্বল্প-পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র মোকাবিলায় তাদের শিখা ব্যবহার করছে। মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগের সাবেক কর্মকর্তা ড্রিউ থম্পসন বলেন, চীন তার কিছু ফ্লেয়ার রাশিয়াকে বিক্রি করতে পারে, যদি সেগুলো রাশিয়ান সিস্টেমের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। এছাড়াও রাশিয়ার কাছে নজরদারি ও গোয়েন্দা তথ্যও শেয়ার করতে পারে চীন।

অস্ট্রেলিয়ার লোই ইনস্টিটিউটের আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা কর্মসূচির পরিচালক স্যাম রোগভেইন বলেছেন, ওয়াশিংটনের সতর্কবার্তার পরিপ্রেক্ষিতে চীন সম্ভবত রাশিয়ান সেনাদের জন্য খাদ্যসামগ্রী পাঠাতে পারে। তিনি যোগ করেছেন যে রাশিয়া এই ধরনের সংক্ষিপ্ত নোটিশে চীনা অস্ত্রসরঞ্জামগুলো তার সশস্ত্র বাহিনীতে কমিশনড করা কার্যত অসম্ভব বলে মনে করে।

চীন কি রাশিয়াকে সাহায্য করবে?

কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। বেশ কয়েকটি কারণ এ ক্ষেত্রে কাজ করছে। প্রাথমিকভাবে এটি খারাপ দেখাতে পারে। বেইজিংয়ের রেনমিন ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক শি ইয়িংহং বলেছেন, 'ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে তার সাহায্য এবং অন্যান্য সহায়তা ব্যবহার করা এড়াতে চীন তার যথাসাধ্য চেষ্টা করবে।' তিনি যোগ করেছেন যে ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াকে কোনো রকম সহায়তা দেয়ার কোনো উদ্দেশ্য নেই চীনের। রোগভেইন একমত হয়েছেন যে মস্কোকে সহায়তা করার ক্ষেত্রে চীনের জন্য কোনো স্পষ্ট বার্তা নেই। বরং রাশিয়া দুর্বল হলে চীনের কৌশলগত এবং অর্থনৈতিক সুবিধা হতে পারে।

চীনা কর্মকর্তারা বলেছেন যে সমস্ত দেশের আঞ্চলিক অখণ্ডতা এবং সার্বভৌমত্বকে সম্মান করা উচিত। যদিও সমালোচকরা বলছেন যে রাশিয়ার আক্রমণের সমালোচনা করতে অস্বীকার করা চীনের সেই অবস্থানের মৌলিক বিরোধী।

ইনস্টিটিউট অফ ইউরোপিয়ান অ্যান্ড এশিয়ান-র ডিরেক্টর পরিচালক লি জিন বলেছেন, 'ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান প্রকৃতিগত ভাবে একটি আগ্রাসনে পরিণত হয়েছে এবং চিন কখনই একটি দেশকে অন্য সার্বভৌম দেশে আক্রমণ করতে সহায়তা করার জন্য অস্ত্র সরবরাহ করবে না এবং এটি আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে ঠিক নয়।' ড্রিউ থম্পসন বলেন, চীন এই যুদ্ধকে আররোখারাপ হতে বা সহ-যুদ্ধকারী হিসেবে নিজেকে নিয়ে যেতে চায় না, তাই যে কোনো চীনা সাহায্যক পরিমাপ করা হবে এবং সাবধানে ক্যালিব্রেট করা হবে।

ইউক্রেন যুদ্ধে কী কী অস্ত্র রাশিয়া ব্যবহার করছে?

যুদ্ধবিমান এবং মিসাইল : রাশিয়ান সামরিক বাহিনী যুদ্ধবিমান এবং কালিব্র ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে ইউক্রেনের সামরিক স্থাপনাগুলিতে আঘাত হানার জন্য। কালিব্র একটি নির্ভুল অস্ত্র, তাই ইউক্রেনীয় সামরিক স্থাপনা এবং সরকারি ভবনগুলো আবাসিক এলাকার কাছাকাছি অবস্থিত হওয়াতে অসামরিক নাগরিকদের মৃত্যু হচ্ছে। একই কথা প্রযোজ্য রাশিয়ান যুদ্ধবিমান থেকে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রের ক্ষেত্রেও। মূল লক্ষ্যগুলোকে আঘাত করার জন্য রাশিয়ান সামরিক বাহিনী ইস্কান্দার ক্ষেপণাস্ত্রও ব্যবহার করেছে, যার রেঞ্জ ৫০০ কিলোমিটার পর্যন্ত এবং অনেক বেশি শক্তিশালী ওয়ারহেড বহন করতে পারে এই ক্ষেপণাস্ত্র। বড় ভবন এবং কিছু সুরক্ষিত স্থাপনা ধ্বংস করতে পারে এটি। কয়েকটি ইস্কান্দার ক্ষেপণাস্ত্র রাশিয়ার মিত্র বেলারুশের অঞ্চল থেকে ছোড়া হয়েছিল বলে জানা গিয়েছে। ইউক্রেনে হামলা চালানোর জন্য বেলারুশের মাটি ব্যবহার করছে মস্কো।

রকেট এবং আর্টিলারি : ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি ভলোদিমির জেলেনস্কি এবং অন্যান্য কর্মকর্তা রাশিয়ান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আবাসিক ভবন, স্কুল এবং হাসপাতালে নির্বিচারে গোলাবর্ষণের জন্য অভিযোগ করেছেন। সোভিয়েত জমানার গ্র্যাড (হাইল), স্মারচ (টর্নেডো) এবং উরাগান (হারিকেন) একাধিক রকেট লঞ্চারগুলো সেনাবাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করতে বা সামরিক সরঞ্জামের ধ্বংস করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। রকেট লঞ্চারগুলো দিয়ে জনবহুল এলাকা হামলা হলে বহু মানুষের হতাহতের আশঙ্কা থাকে। রাশিয়ান সামরিক বাহিনীতে শক্তিশালী আর্টিলারি ইউনিটের বিস্তৃত পরিসরও রয়েছে। মস্কো দাবি করেছে যে তারা শুধুমাত্র সামরিক ঘাঁটি এবং অবকাঠামোকে লক্ষ্য করছে। কিন্তু কিভ, খারকিভ এবং ইউক্রেনজুড়ে অসংখ্য অন্যান্য শহরে অসামরিক অবকাঠামো এবং আবাসিক এলাকায় ব্যাপক ক্ষতির খবর পাওয়া গেছে।

জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার কমিশনের প্রধান মিশেল ব্যাচেলেট জেনেভায় মানবাধিকার কাউন্সিলে বলেছেন, 'অধিকাংশ অসামরিক নাগরিকের হতাহতের ঘটনা ঘটেছে ভারী কামান, মাল্টি-লঞ্চ রকেট সিস্টেম এবং জনবহুল এলাকায় বিমান হামলার কারণে। অসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে ক্লাস্টার যুদ্ধাস্ত্রের ব্যবহার করা হচ্ছে।' তবে, কোন পক্ষ সেগুলো ব্যবহার করেছে তা তিনি উল্লেখ করেননি।

ক্লাস্টার যুদ্ধাস্ত্র এবং থার্মোবারিক অস্ত্র : ইউক্রেনের কর্তারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে ক্লাস্টার অস্ত্র ব্যবহার করার অভিযোগ এনেছেন, যদিও ক্রেমলিন সেই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। এই ধরনের অস্ত্র একটি বিস্তৃত এলাকায় শত্রু সেনা এবং অস্ত্র সরঞ্জামকে লক্ষ্য করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। জনবহুল এলাকায় তাদের ব্যবহার অনিবার্যভাবে অসামরিক লোকজনের মৃত্যু হচ্ছে। ক্লাস্টার বোমা, রকেট এবং আর্টিলারি শেলগুলো আকাশে খুলে যায়, এরপর সাবমিনিশন বা বোমলেট ছেড়ে দেয়, যা একটি বিশাল এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে একাধিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করে। এই ধরনের হামলা হলে বহু মানুষের মৃত্যু হতে পারে এবং বহু মানুষ পঙ্গু হয়ে যেতে পারে। থার্মোবারিক অস্ত্রে একটি জ্বালানি ধারক এবং দুটি পৃথক বিস্ফোরক চার্জ থাকে, প্রথমটি জ্বালানি কণাগুলিকে ছড়িয়ে দিতে বিস্ফোরণ ঘটায় এবং দ্বিতীয়টি বাতাসে বিচ্ছুরিত জ্বালানি এবং অক্সিজেনকে প্রজ্বলিত করে, যা চরম চাপ এবং তাপের একটি বিস্ফোরণ তরঙ্গ তৈরি করে যা একটি আবদ্ধ স্থানে আংশিক ভ্যাকুয়াম তৈরি করে। আবদ্ধ স্থানের জন্য এই অস্ত্রটি তখন ধ্বংসাত্মক হয়ে ওঠে।

সূত্র : নিউজ ১৮


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us