ভারত এখন কোন পথে
মোদি - ছবি : সংগ্রহ
পৃথিবীজুড়ে উষ্ণায়ন ও মহামারির আর যা পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলেছে, তা হলো সেই ১০০ বছর প্রাচীন কর্তৃত্ববাদের প্রত্যাবর্তন। গণতন্ত্র ও উদারবাদের পাঁচ দশকব্যাপী উৎসবের অবসানের প্রথম ঘণ্টা বেজেছিল ২০০৮ সালে, যখন উৎসব চালিয়ে যাওয়ার রসদ ফুরোতে শুরু করল। বন্ধ হল বিখ্যাত মার্কিন ব্যাংকের দরজা। আবার বেইজিংয়ে শি জিনপিং ক্ষমতায় আসীন হওয়ার সাথে সাথে উদয় হলো এ কালে গণতন্ত্রের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বীর। ২০১৮ সালে আইন বদলে নিলেন শি, যার ফলে প্রেসিডেন্ট হিসাবে তার শাসনকালের রইল না কোনো সময়সীমা। কিন্তু অস্ত্রবলে আমেরিকার প্রায় সমান বলীয়ান চীন বুঝিয়ে দিচ্ছিল যে ‘ডিক্টেটর’দের যুগ আবার ফিরে আসতেই পারে, এবং তা আটকানোর জন্য গণতন্ত্র নেহাতই ঠুনকো বীমা।
চীনের উত্থানের মধ্যে যে কত মারাত্মক বিপদের ইঙ্গিত রয়েছে, তা মানুষ বুঝে ওঠার আগেই এল আরো পরিবর্তন। যেমন আমেরিকায় এলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প, যিনি দৃশ্যত রিপাবলিকান দলের প্রার্থী হলেও কার্যত ঘোরতর একনায়কতন্ত্রী। তার আদর্শগত দোসর যদি কেউ হন, তবে তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন। দু’জনেই কর্তৃত্ববাদী এবং ক্ষমতালোভী। ক্ষমতার লিপ্সায় যে কত বেপরোয়া হতে পারেন পুতিন, তার প্রমাণ তার আদেশে ইউক্রেন আক্রমণ। সম্প্রতি পুতিন নিজেই (হয়তো শি-এর অনুকরণে) তার প্রেসিডেন্ট পদের মেয়াদ বাড়িয়ে নিয়েছেন ২০৩৬ সাল পর্যন্ত। আমেরিকার সাংবিধানিক গণতন্ত্র সৌভাগ্যবশত রাশিয়ার চেয়ে প্রাচীন ও মজবুত হওয়ার দরুণ ট্রাম্প নির্বাচনে হেরেছেন ২০২০-তে, পয়লা টার্ম সাঙ্গ করেই। তবে তিনি হোয়াইট হাউস ত্যাগ করেছেন রিপাবলিকান দলটিকে তার কোটের পকেটে গুঁজে। ফলে সেই পুরনো গৃহে তার যে পুনরাবির্ভাব হবে না তা বলা অসম্ভব। এ দিকে পৃথিবী জুড়ে আবির্ভাব হয়েছে দক্ষিণপন্থী আধিপত্যবাদীদের : ব্রাজিলে জাইর বোলসোনারো, হাঙ্গেরিতে ভিক্তর অর্বান, ব্রিটেনে বরিস জনসনের নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদের পুনরুত্থান।
এই পশ্চাৎপটে ভারতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উত্থান আকস্মিক নয়। যে প্রেক্ষাপটের উল্লেখ করা হলো, সেখানে সম্ভবত জনসনের ব্রিটেন ছাড়া অন্য কোথাও স্বৈরতান্ত্রিক নেতারা আভিধানিক অর্থে ‘রক্ষণশীল’ নন। তারা কেবলই স্বৈরতান্ত্রিক, এবং জাতীয়তাবাদী সাজার জন্য তাদের অবলম্বন করতে হয় কল্পিত জাতি ও তার কল্পিত ইতিহাসের উপর। এরা সকলেই সচেষ্ট তাদের নিজেদের দেশে গণতন্ত্রের ভিতটি দুর্বল করতে, কারণ প্রকৃত গণতন্ত্রের সাথে স্বৈরতন্ত্রের সহাবস্থান সম্ভব নয়। গণতন্ত্র নড়বড়ে করার যা কিছু প্রয়োজন, তা ঘটেই চলেছে মোদির ভারতে। আইনের দ্বারা তৈরি হয়েছে ইলেকশন বন্ড, যেখানে পার্টির নির্বাচনী তহবিলে কেউ দান করতে চাইলে দাতার নাম ‘গোপন’ রাখা হয়। এ এক প্রহসন! যে দল ক্ষমতাসীন, তার পক্ষে কোনো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান টাকা দিচ্ছে কোন দলের তহবিলে, তা নির্ণয় করা এক লহমায় সম্ভব। সুতরাং, নির্বাচন বাবদ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের করমুক্ত চাঁদার ৯০ শতাংশ যাচ্ছে বিজেপির তহবিলে।
বন্ডে রাজনৈতিক দাতার ঘোষিত ‘গোপনীয়তা’কে সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ করেছে সিপিএম ও অন্যেরা, চার বছর আগে। কিন্তু আদালত এখনও শুনানি সম্পর্কে মনস্থির করতে ‘দ্বিধাগ্রস্ত’। তবে স্বাভাবিক ভাবেই সম্পদের এই বিপুল বৈষম্য বিজেপির সামনে হাজির করেছে এক অভূতপূর্ব অর্থ ও লোকবল। প্রতিটি নির্বাচনে তা নিয়োজিত হচ্ছে বিভিন্ন উপায়ে। দলিত ও ওবিসি ভোটের জন্য অর্থের বিনিময়ে হাত করা হচ্ছে গোষ্ঠীনেতাদের।
তদুপরি আছে বিরোধী নেতাদের ভড়কে দেয়ার জন্য সিবিআই, আয়কর বিভাগ বা বিদেশী অর্থ সংক্রান্ত এনফোর্সমেন্ট ডায়রেক্টরেটকে ব্যবহারের রেওয়াজ। পার্টির মতপ্রচারের জন্য কোটি কোটি টাকা দিয়ে তৈরি এক ‘তথ্যপ্রযুক্তি সেল’, যার বিশেষ উদ্দেশ্য হল বিভেদনীতির প্রসার। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নেহরুকে চিত্রিত করা এক অক্ষম ও নারীলোলুপ মানুষ হিসেবে। জেনারেল স্যাম মানেকশ-কে দেখানো ১৯৭১ বাংলাদেশ যুদ্ধের প্রধান কারিগর হিসেবে— যেন ইন্দিরা গান্ধী কেউ নন। পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনের সময়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে চিহ্নিত করা হয় মুসলিম বলে।
ট্রাম্প তার ২০১৬ নির্বাচন জিতেছিলেন প্রধান প্রতিপক্ষ হিলারি ক্লিন্টনের নামে টুইটার মারফত কুৎসার বন্যা বইয়ে দিয়ে। শোনা যায়, এই রটনার কাজে পুতিন তাকে সাহায্য করেছিলেন, রাশিয়ার অগুনতি সাইবার-অপরাধীর সাহায্য নিয়ে। পুতিন নিজে বারংবার নির্বাচন জিতেছেন দেশের তেল, গ্যাস ও অস্ত্র বেচা ধনকুবেরদের সাহায্য নিয়ে।
তবে পুতিন বা ট্রাম্প এবং মোদির মধ্যে একটি তফাত আছে। পুতিন কখনো গণতন্ত্রের জয়গান গান না। ট্রাম্পের কোনো বিশেষ দুর্বলতা নেই গণতন্ত্রের প্রতি, শুধু তার যে নিয়মগুলো জনসমক্ষে আলোচনা করা দরকার সেটুকুই করেন। মোদি কিন্তু নিজেকে গণতন্ত্রের পূজারি হিসাবে দেখান দুনিয়ার সর্বত্র। প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর সংসদ ভবনের সোপানে তিনি মাথা ঠেকিয়েছিলেন গণতন্ত্রের এই মন্দিরের প্রতি তার ‘ভক্তি’ প্রদর্শনের জন্য।
কিন্তু এখন সময় পাল্টাচ্ছে। শুধু অভিনয়ে কাজ হবে না। রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের পর গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি— যথা, বিনা প্ররোচনায় প্রতিবেশী দেশে চড়াও হওয়া, সেখানে হাসপাতালে বোমা বর্ষণ- ভারতের দায়বদ্ধতার প্রমাণ দেওয়ার প্রয়োজন হয়েছে। এবং সেখানেই মোদির ভারত তটস্থ। সম্প্রতি রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদ, জেনারেল অ্যাসেম্বলি ও মানবাধিকার পরিষদ- এই তিন কক্ষেই রাশিয়ার বিরুদ্ধে আনা প্রস্তাব যখন অজস্র দেশ সমর্থন করেছে তখন ভারতকে ভোটদানে গরহাজির থাকতে হয়েছে, পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে পা মিলিয়ে। এ কথা সত্য যে, রাশিয়ান ভেটোর দয়ায় ভারত অনেক বার বেঁচে গিয়েছে পশ্চিমি দেশের কোপদৃষ্টি থেকে। এখন মুশকিল হল, ‘বৃহত্তম গণতন্ত্র’ ও ‘রাশিয়ার মিত্র’, এই দুই পরিচিতির মধ্যে একটি এ বার ভারতকে বেছে নিতে হবে। ইউক্রেন আক্রমণের পর ওই দ্বিতীয় পরিচিতিটিতে পশ্চিমি দুনিয়ায় কিন্তু মুখরক্ষা ভার।
সোভিয়েট ইউনিয়ন পতনের তিন দশক পরে আবার ঘুরছে ইতিহাসের চাকা। আমেরিকান ইতিহাসবিদরা বলেন, ১৯৬২ থেকে ১৯৭৮ হল উদারবাদের অধ্যায়। তার পর যে রক্ষণশীল অধ্যায়ের শুরু, তা এখনও চলেছে। মনে হয়, যুক্তিটি অংশত সত্য। অংশত, কারণ এখন রাশিয়া, ব্রাজিল, হাঙ্গেরি, ভারতসহ যে দক্ষিণপন্থীরা ক্ষমতা অধিকার করছে তারা আক্ষরিক অর্থে রক্ষণশীল নয়। অষ্টাদশ শতকের ব্রিটিশ রক্ষণশীলতার স্তম্ভ এডমন্ড বার্ক ফরাসি বিপ্লবের নিন্দা করে লিখেছিলেন, “রাজমুকুট আমাদের (ব্রিটেনের) উত্তরাধিকার।” রক্ষণশীলরা ঐতিহ্যপরায়ণ। সে অর্থে নয়া দক্ষিণপন্থীরা রক্ষণশীল নন। মোদীর পক্ষে ‘ঐতিহ্য’ আবিষ্কার দুরূহ কাজ— তাই শ্রীরামচন্দ্রের জন্মস্থান নিয়ে এত বিতর্ক! ট্রাম্প, পুতিন, শি জিনপিং, মোদি, সকলেই স্বৈরতান্ত্রিক। মোদির সমস্যা, জনসমর্থনে তার ঘাটতি না থাকলেও তিনি এখনো ডিক্টেটরদের সমাজে- যেটি তার মানসিক বলয়- তেমন পাত্তা পাননি। না অর্থবলে, না অস্ত্রবলে।
ঘটনাপ্রবাহ চলেছে সে দিকেই। শোনা গেল, ভারত রাশিয়া থেকে তেল আমদানি করতে খুঁজছিল এমন এক কারেন্সি, যা আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার কবল থেকে মুক্ত। কথা চলছে চীনা ইউয়ান নিয়ে। তা হবে গণতন্ত্রের ‘আবর্ত’ থেকে ভারতের মুক্তির প্রথম পদক্ষেপ।
সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা