পুতিনের টার্গেট
ভ্লাদিমির পুতিন - ছবি : সংগ্রহ
রাশিয়াকে ভূ-রাজনৈতিক পরিসরে কোণঠাসা করার ইচ্ছা কি পশ্চিমের তরফে এখনও বিরাজমান?
ইউক্রেন সঙ্কটকে কেউ তিনটি স্তরে বিচার করতে পারেন। একেবারে সরলভাবে দেখলে ভ্লাদিমির পুতিন একজন ‘দুষ্টু লোক’, যিনি কি না একটি স্বাধীন রাষ্ট্রকে অধিবাস্তব ভাবে ‘রাষ্ট্র নয়’ বলে ঘোষণা করে আক্রমণ করে বসে আছেন।
ইউক্রেনবাসীরা কার্যত পশ্চিমের অংশভাগী হতে চেয়েছিলেন, এই বিষয়টিকে ভুল বুঝে বা তার অপব্যাখ্যা করে পুতিন সমরাভিযান চালিয়ে যাবতীয় স্থিতিকে বিনষ্ট করে দিয়েছেন। এর অর্থ এমন হতে পারে যে, এই মুহূর্তে তিনি কোনো বৃহত্তর লাভের আশায় তার খাঁই আর ঝুঁকি বাড়িয়ে চলেছেন ক্রমাগত এবং/অথবা নিজের দেশের অভ্যন্তরে তিনি প্রবল সমস্যার সম্মুখীন। যাই হোক না কেন, তাঁর দেশ এবং সে দেশের অর্থনীতি পশ্চিমের দেশগুলোর কাছে অস্পৃশ্য বলেই বিবেচিত হয় এবং এক হতাশাব্যঞ্জক ভবিষ্যৎ সে দেশের সামনে ফুটে ওঠে। কোনো বোধবুদ্ধিসম্পন্ন নেতাই তার জনগণকে এমন বেকায়দায় ফেলবেন বলে মনে হয় না।
দ্বিতীয় বা ভূ-রাজনৈতিক স্তর থেকে বিষয়টিকে দেখলে আবার অন্য রকম মনে হতে পারে। তিন দশক আগে যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলয় ঘটে, হেনরি কিসিঙ্গার এবং জেবিনিউ ব্রেজিনস্কির মতো রাজনৈতিক ভাষ্যকারেরা এই মত ব্যক্ত করেছিলেন যে, সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলোপ মানে এই নয় যে, রাশিয়ার তরফ থেকে কৌশলগত হুমকির অবসান ঘটল। কার্যত, ১৯০৪ সালে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ ভূগোলবিদ হ্যালফোর্ড ম্যাককিন্ডার যে তত্ত্ব ব্যক্ত করেছিলেন, সেই দিকেই এই ভূ-রাজনীতির ভাষ্যকাররা ইঙ্গিত করেছেন।
ম্যাককিন্ডার বলেছিলেন, বিশ্ব দু’টি মাত্র ভাগে বিভক্ত ছিল- প্রথমটি এক ইউরেশীয় ‘কেন্দ্রভূমি’, যার মধ্যে পূর্ব ইউরোপ এবং এশিয়ার অভ্যন্তরের দেশগুলো পড়ে আর দ্বিতীয়টি হলো ‘অধীনস্থ’ নৌশক্তি কেন্দ্রিক দেশগুলো, যার অন্যতম হলো আমেরিকা। এখনকার দিনে দাঁড়িয়ে বিচার করলে দেখা যাবে যে, ম্যাককিন্ডার জার্মানি ও রাশিয়ার মধ্যে স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোর একটি বলয়কে বর্ণনা করতে চেয়েছিলেন, যা সেই দুই মহাশক্তিধর (১৯০৪ সালের প্রেক্ষিতে) রাষ্ট্রশক্তির মাঝখানে ‘বাফার’ বা আঘাত-সহায়কের ভূমিকা পালন করবে।
গত তিন দশকে পশ্চিমী শক্তিগুলো বস্তুত উপরোক্ত পরামর্শকে অগ্রাহ্য করে পূর্বদিকে সম্প্রসারণের নীতি অনুসরণ করে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং ন্যাটোকে রাশিয়ার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছে। কার্যত তারা ইউরেশীয় ‘কেন্দ্রভূমি’-র দেশগুলোকে এ কথা বোঝাতে চেয়েছে যে, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের প্রতি যে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিল, পরবর্তী সময়ের রাশিয়া ঠিক তেমনটি করবে না।
পুতিন তার দেশকে কোণঠাসা করা হচ্ছে বলে সাবধানবাণী শুনিয়েছিলেন, বিশেষ করে ইউরেশীয়-তত্ত্বকে উল্লেখ করে এক স্মরণীয় বক্তৃতায় তিনি পশ্চিমে রুশ প্রভাবিত অঞ্চলের দাবি জানিয়েছিলেন। কিসিঙ্গার স্বয়ং গত কয়েক মাসে যুক্তি দেখিয়েছিলেন (যদিও সে যুক্তিতে কোনো কাজ হয়নি) যে, রাশিয়া এবং পশ্চিমের মধ্যে কিছু ‘বাফার’ বা ‘আঘাত প্রতিরোধক’ নিরপেক্ষ রাষ্ট্রকে রাখা হোক। এখন যা পরিস্থিতি, তাতে এই সঙ্কট মেটাতে গেলে ইউক্রেন (এবং বেলারুশ)-কে আঘাত প্রতিরোধক অঞ্চল হিসেবে গণ্য করতে হয়। আর এই বিষয়টিই রাশিয়া দীর্ঘ কাল ধরে চেয়ে এসেছে।
এই মুহূর্তে যে বিষয়টি অজানা সেটি হলো এই যে, রাশিয়ার বিরুদ্ধে জারি করা বিবিধ প্রকার অবরোধের দ্বারা কি এই ধরনের ব্যবস্থার বাস্তবায়ন পর্যন্ত টিকে থাকবে? যদি তা থাকে, তবে বুঝতে হবে যে, রাশিয়াকে ভূ-রাজনৈতিক পরিসরে কোণঠাসা করার ইচ্ছা পশ্চিমের তরফে এখনও বিরাজমান।
তৃতীয় যে স্তরে এই সঙ্কটকে দেখা যেতে পারে, সেটি হলো এই- ইউরোপে নব্য দক্ষিণপন্থা এবং তার রূপভেদগুলোর উত্থানের প্রেক্ষিত। এত কাল পর্যন্ত রাজত্ব-করা উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ভাবধারাগুলোকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল উঠে আসছে এবং এমনকি, তারা হাঙ্গেরির মতো দেশে ক্ষমতাও দখল করেছে। পাশাপাশি, জার্মানি, ফ্রান্স এবং সুইডেনের মতো দেশে তারা জাতপাত-ভিত্তিক জাতীয়তাবাদের প্রতি ঝুঁকে থাকা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পিছনে মদতও যোগাচ্ছে। এই চ্যালেঞ্জের পিছনে ক্রিয়াশীল থেকেছে সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু বৌদ্ধিক ঐতিহ্য। এক শতাব্দী আগে রুশ, জার্মান বা ফরাসি দার্শনিক, ইতিহাসবিদ এবং সাংবাদিকদের বলে যাওয়া বেশ কিছু বক্তব্য এই ঐতিহ্যের পিছনে প্রণোদন হিসেবে বিদ্যমান, যার মধ্যে কিছু বক্তব্যকে আবার নাৎসি বা ইউরোপীয় ফ্যাসিবাদের সঙ্গে একীভূত করে দেখা যায়।
উদারনীতিবাদ, সমানাধিকার, ‘মানবাধিকার’ প্রভৃতি দর্শন, যা ব্যক্তিস্বাধীনতার কথা বলে, এই সব লেখক তাদের প্রতি প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলেন এবং তার বদলে সমাজের এক সম্প্রদায়-ভিত্তিক দর্শন, হিংসার অমেয় ব্যবহার, নিজস্ব জাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য বা নিয়তিবাদের জয়গান এবং নেতাভিত্তিক গোষ্ঠীর উত্থানের কথা ক্রমান্বয়ে বলে গিয়েছিলেন।
তারা ‘জনগণতন্ত্রের উত্থান’-এর কথা বলেছিলেন, ‘ভেদমূলক শাসন’-এর অবসানকল্পে প্রযুক্ত সর্বজনীন মূল্যবোধের বাচনকে বাতিল বলে ঘোষণা করেছিলেন। এবং সে সবের পরিবর্তে এক ধরনের জাতপাত-সম্প্রদায় ভিত্তিক জাতীয়তাবাদের জয়গান গেয়েছিলেন, যা স্তরবিভাজিত সামাজিক কাঠামোকে অনুমোদন দেয় এবং বাস্তব পৃথিবীর বাইরে অবস্থানরত এক প্রকার সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের বিন্দুতে দাঁড়িয়ে সংখ্যালঘুদের একেবারেই অস্বীকার করে। আর এ সমস্ত কিছুই তারা করেছিলেন এক শিকড়ে প্রোথিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে।
এই স্বয়ংসিদ্ধ, স্বতঃপ্রমাণিত মতবাদের ভারতীয় প্রতিরূপটি ব্যক্তিগত অধিকারকে সর্বাগ্রে গুরুত্ব দিয়ে উদারপন্থী গণতন্ত্রের উদ্ধেশ্যে গঠিত সাংবিধানিক কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বিবিধ ধারণা ও ভঙ্গিমাকে ব্যক্ত করছে (কোনো যুক্তিপ্রমাণ ছাড়াই)। কিন্তু পুতিন নিজে এই সব লেখকদের রচনা থেকে যখন উদ্ধৃতি দেন, তখন সম্ভবত তিনি দোহারের ভূমিকাই পালন করেন। যখন তিনি রাশিয়াকে বিশ্বপ্রগতির স্বয়ংসিদ্ধ কেন্দ্রে পরিণত করার জন্য তার বিভিন্ন ধারণা ব্যক্ত করেন, তখনো কিন্তু তাকে মূল গায়েন বলে মনে হয় না। তবুও এ কথা সত্য যে, তার বক্তৃতায় উল্লিখিত ইউরেশীয় ও অন্য ধারণাগুলো রুশ বনাম ইউক্রেনের ইতিহাসকে ‘নিছক তথ্যের’ সীমার বাইরে নিয়ে যায়। পুতিনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা হয়তো অনর্গলভাবে বেরিয়ে আসছে তার অতিমাত্রায় উচ্ছ্বাসের কারণে, কিন্তু বৃহত্তর আদর্শগত চ্যালেঞ্জের ক্ষেত্রে ম্যাককিন্ডারের বিশ্বদর্শন এখনো কিছু মূল্য রাখে- এ কথা মানতেই হবে।
সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা