দুনিয়াতেই সব পেয়ে যাই, তবে পরকালে কী পাবো

দুনিয়াতেই সব পেয়ে যাই, তবে পরকালে কী পাবো - ছবি : সংগৃহীত
‘আপনি অনেক টাকা খরচ করে বড় রেস্টুরেন্টে খেলেন, এটার তৃপ্তি ততক্ষণই, যতক্ষণ তা জিহ্বায় লেগে থাকে। আর এর চেয়ে অনেক কম টাকায় একজন ক্ষুধার্থ মানুষকে খাওয়ালে তার মুখের যে হাসি, সেটি সারা জীবন মনে থাকবে।’ এমন সরল কথাগুলো বলছিলেন এমন একজন ব্যক্তি যার নিজের ঘরে ঘড়ি ছিল না। সূর্য আর বাড়ির পাশের কারখানার ঘণ্টাই ছিল সময় নির্ণয়ের প্রধান উপকরণ। তার বাবা মুক্তিযুদ্ধে যখন শহীদ হন তার মা তখন সবেমাত্র মেট্রিক পাশ করেছেন। একই সঙ্গে তিন সন্তানের ভরণপোষণ সামলিয়েছেন। এই অবস্থাতেই তিনি গ্রাজুয়েশন শেষ করেছেন। এরপর শিক্ষকতায় যোগ দিলেন। পরিবারের ব্যয় মেটাতে নিজ প্রতিষ্ঠানে চাকরি শেষে কয়েকটি টিউশনি করাতেন। ওদিকে সন্তানেরা মাকে দেখার জন্য অধির আগ্রহে অপেক্ষা করত। মা বাসায় ফিরতে রাত আটটা নয়টা বেজে যেত। তবুও কারো কাছে হাত পাতেননি। তিন আর কেউ নন, স্বাধীনতা পদক জয়ী ১ হাজার ৭৪ কিডনি প্রতিস্থাপনকারী চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলাম।
তিনি যখন ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হন, শুধু পড়ালেখাই ছিল তার একমাত্র ধ্যানজ্ঞান। পড়াশোনার বাইরে কোনো কিছুই তার ছিল না। এক অনুষ্ঠানে তারই মেডিকেল কলেজ সহপাঠি স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, 'শেষ বর্ষে এসে আমরা দেখি কামরুল মাঝে মাঝে আমাদের সঙ্গে দরকারি-অদরকারি বিষয়ে কথা বলে। আমরা তখন বান্ধবীরা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতাম, ‘কামরুল না এখন কথা বলে’।" তিনি এমনই নিভৃতচারী মানুষ ছিলেন।
সরকারি চাকরিরত অবস্থায় দেখলেন নানা করণে নিজের ইচ্ছেমতো কাজ করার সুযোগ হয় না। ২০০৭ সালে চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিভৃতে শুরু করেন কিডনি রোগীর সেবা। শ্যামলীর একটি বাসায় শুরু করেন তার কিডনি প্রতিস্থাপন কার্যক্রম। শুরুতে না প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছেন। তবে তার বন্ধুরা সবাই বিভিন্ন জায়গায় প্রতিষ্ঠিত বলে অনেক ক্ষেত্রেই সহযোগিতা পেয়েছেন। সাবার চোখের আড়ালে ১ হাজার কিডনি প্রতিস্থাপন করে ফেললেন। অথচ তার কোনো উদযাপন নেই। এর পর কয়েকজন সাংবাদিক বিষয়টি নিয়ে রিপোর্ট করলে আলোচনায় আসেন দেশের উজ্বল এই নক্ষত্র। দেশী ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচারিত হতে থাকে তার কৃতিত্বের কথা।
মিডিয়ায় প্রচারণাই তার প্রধান ভয়। যদি দুনিয়ায় সব সম্মান পেয়ে যাই তাহলে পরকালে পাওয়ার কি থাকবে! এই ভয়েই তিন কখনও মিডিয়ার সামনে আসতে চাইতেন না। এই পুরস্কার প্রাপ্তির পিছনে নিজের চেয়ে বেশি কৃতিত্ব দিতে চান তার প্রতিষ্ঠান ও সহকর্মীদের। তিনি বলেন, আমার দ্বারা কখনই এমন কাজ করা সম্ভব হতো না। সবাই আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করেন এখানে।
মাত্র দুই লাখ টাকায় একটি কিডনি প্রতিস্থাপন করেন। শুধু তাই নয়, সারা জীবনের জন্য তিনি কিডনি দাতা ও গ্রহীতাকে বিনামূল্যে চেক-আপ দিয়ে থাকেন। এটি তার অনেক বড় মহানুভবতার প্রতীক। তার স্বল্প ব্যয়ের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘আমরা যে টাকা নিয়ে কিডনি প্রতিস্থাপন করি তাতে আমদের ভর্তুকি দিতে হয় না। বরং আমদেরে স্টাফদের সবাইকে কিছু না কিছু করে আমরা দিতে পারি। শুধু সেবার মানুষিকতা থাকলেই সেটি সম্ভব। আমাদের হাসপতালে যে সেবগুলো আছে সেগুলোর প্রত্যেকটিতে আমাদের লাভ হয়, কিডনি খাতটিতে আমরা খুব কম লাভেই সেবা দিয়ে থাকি।
তার কাজের বড় সহযোগী মেডিকেল কলেজের বন্ধুরা। মেডিকেলে বন্ধুদের অনেকেই এখন প্রতিষ্ঠিত। সবাই অধ্যাপক কামরুল ইসলামের মতো বন্ধু পেয়ে নিজেদের ধন্য মনে করেন। এক হাজার তম কিডনি প্রতিস্থাপনের পর একটি ঘরোয়া অনুষ্ঠনের আয়োজন করেছিলেন তার ব্যাচের বন্ধুরা।
সেদিন বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছিলেন, ‘আমার গর্ব হয়, আমি কামরুলের বন্ধু।’ কলেজ জীবনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ডা. দীপু মনি বলেছিলেন, ‘আমরা বিভিন্ন সাংগঠনিক কাজে পড়াশোর খেই হারিয়ে ফেলতাম। পরীক্ষার আগে আমার একমাত্র ভরসা ছিল কামরুল। ও সময় করে নোটগুলো একটু বুঝিয়ে দিত। আমার আর টেনশন ছিল না। কারণ ওর নোটে আমরা কখনও ভুল পেতাম না। এমন নিভৃতচারী চিকিৎসকরাই আমাদের সম্পদ। এমন কামরুল স্যারদের হাত ধরেই এগিয়ে যাক আমাদের চিকিৎসা খাত।
লেখক : গণমাধ্যম কর্মী