বিশ্ব সমস্যার সমাধানে এখনো যুদ্ধ!
বিশ্ব সমস্যার সমাধানে এখনো যুদ্ধ! - ছবি : সংগৃহীত
সুন্দর চরিত্রের আরেক নাম বিবেক। যার মধ্যে বিবেক কাজ করে, সে অমানুষ বা দানব হতে পারে না। সুশিক্ষার জন্য যেমন দরকার সততা এবং সুন্দর পরিকল্পিত প্রশিক্ষণ ঠিক সুন্দর চরিত্র পেতে দরকার পরনিন্দা ও পরচর্চা বর্জন করা এবং সর্বোপরি আমাদের চিন্তা-চেতনায় এবং কর্মে বিবেককে সংযুক্ত রাখা। এখন আমার লেখা পড়ে সবাই বলবে তাহলে পাশ্চাত্যের মানুষ কিভাবে দানব হলো? তাদের সংসারে অভাব নেই, শিক্ষার ঘাটতি নেই, তারা কেন দানব হলো?
আমি ভেবেছিলাম, পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে হয়তো নতুন করে যুদ্ধ দেখতে হবে না। যেহেতু গোটা বিশ্বে প্রতিযোগিতার বন্যা বয়ে চলছে নানাভাবে। সেক্ষেত্রে আমি ধরে নিয়েছিলাম মানুষ জাতি যুদ্ধ নয়, ক্রিয়েটিভ পদ্ধতি অবলম্বন করে প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে বিজয়ের বার্তা শোনাবে। কিন্তু না আমার সে ধারণা স্বপ্ন হয়েই রয়ে গেল। যুদ্ধের ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি এবং কিনে তা গুদামজাত করা থেকে কেউই বিরত নেই। ধনী দেশগুলোতে না হয় মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের অভাবে কেউ দৈনন্দিন জীবন পার করছে না বিধায় তাদের হয়তোবা শোভা পায়, কিন্তু যেসব দেশ মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো আজও পূরণ করতে পারেনি তারাও ক্ষেপণাস্ত্র কিনে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি পর্ব গ্রহণে মগ্ন। অস্ত্র যখন আমদানি এবং রফতানি হচ্ছে সেখানে কিভাবে আশা করা যেতে পারে এই পৃথিবী শান্তির মুখ দেখবে? জেনে শুনে যখন বিশ্ব এমন একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাহলে কী দরকার আছে কূটনীতি এবং জাতিসঙ্ঘের? তারা শুধু অন্ন ধ্বংস আর স্বচ্ছ পানিকে ঘোলা করা ছাড়া আর কী করছে?
যুদ্ধ এবং অবৈধ ক্ষমতার অপব্যবহার করেই যদি বিশ্বের নেতৃত্ব দিতে হবে তাহলে কী দরকারই বা আছে শুধু শুধু গণতন্ত্রের কথা বলার। শিক্ষা, খেলাধুলা এবং টেকনোলজির মধ্য দিয়ে হতে পারতো ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ কিন্তু তা না হয়ে হচ্ছে যুদ্ধের প্রতিযোগিতা! আমরা এমন একটি পৃথিবীর নাগরিক যেখানে কেউ যুদ্ধ করছে পেটে এক মুঠো খাবার পেতে আর কেউ যুদ্ধ করছে বিশ্বের শান্তি ধ্বংস করতে।
আমরা শ্রেণিকক্ষে নৈতিকতার কথা বলছি, সততা, দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ার প্রতিশ্রুতি নিচ্ছি, অন্যদিকে একে অপরকে খুন করছি। যদি নিজ নিজ পরিবারের দিকে খেয়াল করি তবে কী দেখতে পাচ্ছি? খুব যে ব্যতিক্রম কিছু তা বললে ভুল হবে। আমার জন্মের শুরুতেই পরাধীনতার অভিশাপ থেকে রেহাই পেতে আমরা যুদ্ধ করেছিলাম। তখন কিন্তু ভাবিনি মানুষ হয়ে মানুষকে খুন করছি। তখন মনে হয়েছে শত্রুকে খুন করছি। পরে জীবন গড়ার সাথে, বিশ্বায়নের ভালোমন্দ দেখে শিখেছি অনেক কিছু। বিবেকের উন্মুক্ত মঞ্চ সব সময় ভালো দিকগুলোতেই অনুপ্রাণিত হয়েছে, তাই সব সময় সেগুলোকেই নানাভাবে তুলে ধরতে চেষ্টা করে চলেছি। কিন্তু আশানুরুপ ফলাফল দেখতে পাচ্ছি বলে মনে হচ্ছে না! এই না পারার সম্ভব্য কারণগুলো কী?
তার আগে যারা সমাজের খেয়ে সমাজের বারোটা বাজাতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তাদের কথা বলতে হয়। আমি ফ্যাসিলিটেটরদের কথা বলছি। ফ্যাসিলিটেটর (Facilitator) শব্দের অর্থ সমন্বয়কারী। পাশ্চাত্যে শব্দটির একটি গুণগত মান রয়েছে ইতিবাচক অর্থে। কিছু লোক পৃথিবীতে রয়েছে যারা একজন ভালো ফ্যাসিলিটেটর হিসেবে একটি পরিবার বা সমাজে কাজ করে থাকে। এদের কাজের মূল উদ্দেশ্য হলো সমন্বয় সৃষ্টি করা এক বা একাধিক ব্যক্তির মাধ্যমে।
চোকলখোর শব্দটি এমন কোনো ব্যক্তিকে বুঝায় যে অন্যের কাছে নিজেকে আপন করে তুলতে, নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে, ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করতে এবং সুযোগ-সুবিধা লাভে একজনের কথা অন্যজনের কাছে বলে বেড়ায়। অকৃতজ্ঞ শব্দের অর্থ যে উপকারীর উপকার স্বীকার করে না। আর নেমকহারাম উপকারীর উপকার স্বীকার করে না বরং পারলে ক্ষতি করে।
ফ্যাসিলিটেটর আবার একজন চোগলখোর, বেঈমান, অকৃতজ্ঞ বা নেমকহারামের এক সম্মিলিত চরিত্র হতে পারে।
এ ধরনের ফ্যাসিলিটেটরদেরকে দানবের সঙ্গে তুলনা করতে পারি। প্রশ্ন হতে পারে দানব কী? আমি নিজেও জানি না তবে ভূত, পেত্নীর মতো কুৎসিত অদৃশ্য কিছু একটা হবে। এ ধরনের ফ্যাসিলিটেটর পরিবার, সমাজ বা একটি দেশে বিরাজ করছে তাকি আমরা জানি? আমরা কী জানি যে এরা সমাজের সবচেয়ে কুৎসিত চরিত্রের মানুষ নামের এক দানবগোষ্ঠী? আমরা শুধু দুর্নীতি, ঘুষখোর, সুদখোর, ধর্ষক, মোনাফিক এদের কথাই বলি যে এরা মানুষ জাতির কলঙ্ক। কখনো ভেবেছি কি সমাজে যে সব ফ্যাসিলিটেটর, চোকলখোর, বেঈমান, অকৃতজ্ঞ এবং নেমকহারাম রয়েছে তারা একটি পরিবার, সমাজ এবং দেশকে ধ্বংস করতে যথেষ্ট? কিভাবে শনাক্ত করা যেতে পারে এদেরকে? একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার করতে চেষ্টা করি।
বাংলাদেশে এমন কোনো পরিবার নেই যেখানে মতামতের বিভেদ নেই। কিন্তু আমাদের এমন স্বভাব যে আমরা কখনো নিজেদেরকে নিয়ে সমালোচনা করি না। আমরা অন্যের পরিবারে কী হচ্ছে তা নিয়েই মাথা ঘামিয়ে থাকি বেশি। পরনিন্দা, পরচর্চায় পঞ্চমুখ হতে পাকা। আমরা ভুলে যাই যে আমাদের নিজেদের পেট বর্জ্যে ভরা এবং তা যখন শরীর ত্যাগ করে সে গন্ধ সহ্য করা কঠিন যদিও নিজেদেরই বর্জ্য। মৌলভীদের ভাষায় বলতে হয় 'চিল্লায় বলেন ঠিক কিনা?' পরিবারে অনেক সময় ভাইয়ে-ভাইয়ে মনমালিন্য হয়ে থাকে। যা হতে পারে অর্থ সংক্রান্ত বা মতভিন্নতার কারণে। সেক্ষেত্রে পরিবারের দুর্বল একাত্ববোধের সুযোগ নিয়ে এগিয়ে আসে অনেকে। এরা দুই পক্ষের খবরাখবর বিকৃত করে কথা চালাচালি করে আনন্দ পায়। অনেকে কখনো বা কারো কাছ থেকে কোনো বিষয়ে উপকৃত হয়েছে, বিনিময়ে কৃতজ্ঞতার ঋণ শোধ করতে না পেরে কুৎসা রটাতে উঠে পড়ে লাগে।
এরা জেনে শুনে এ ধরনের কর্ম করে। এ ধরনের কর্ম যারা করে তাদের মস্তিষ্ক এক ধরনের বিকৃত রোগে আক্রান্ত। এদের থেকে রেহাই পেতে একমাত্র উপায় যত সমস্যাই হোক না কেনো পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে সরাসরি কথোপকথনের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা, তাতে করে সমাজের কার্লপ্রিটগুলো পরিবারের মধ্যে ঢুকে সম্পর্ককে খারাপের দিকে নিতে পারবে না। মনে রাখতে হবে পরিবর্তন পরিবার থেকে শুরু করতে হবে, এবং দুষ্টু লোককে আদৌ সুযোগ দেয়া যাবে না।
ঘরের কথা ঘরের লোকের সঙ্গে আলোচনা করা শিখতে হবে। ঘরের কথা পরের কাছে বলা আর ঘরের বউ বা স্বামী পরের কাছে যাওয়া একই কথা। পার্থক্য শুধু একটি দৈহিক এবং অপরটি মানসিক। সুতরাং আমাদের অঙ্গীকার হোক, নিজে কাউকে শোষণ করবো না, কারো অধিকার হরণ করবো না, বৈষম্য সৃষ্টি করবো না, দুর্নীতি করবো না, অন্য কেউ এগুলো করলে তা মেনেও নেব না।
আমরা অবশ্যই পারবো এবং আমাদেরকে পারতেই হবে।
পৃথিবীর সর্বত্র সৃজনশীল সমাজে ফ্যাসিলিটেটর রয়েছে। এরা পরিবার বা সমাজে সুন্দর পরিবেশ এবং ভালো সম্পর্ক তৈরি করতে সাহায্য করে। বাংলাদেশের মতো বেশির ভাগ দেশে ফ্যাসিলিটেটরের কাজ নেগেটিভ হয়ে থাকে। কারণ যে সমাজে সুশিক্ষার চেয়ে কুশিক্ষা বেশি, সেখানে ফ্যাসিলিটেটরদের চরিত্র জঘন্য হওয়াই স্বাভাবিক। পুঁথিগত বিদ্যা থাকলেই সুশিক্ষার অধিকারী হওয়া যায় না। বিবেকের অনুপস্থিতির কারণেই মানুষ দানবে পরিণত হয়। আমাদের সৃষ্টি হয়েছে মানুষ হিসেবে।
কু-কর্মের মাধ্যমে আমরা যদি মনুষ্যত্বের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলি তখন ফ্যাসিলিটেটর চোকলখোর, বেঈমান, অকৃতজ্ঞ, নেমকহারাম, দানব ইত্যাদি হয়ে যায়। তাহলে সুন্দর চরিত্র কিভাবে পাওয়া সম্ভব? আমি বিশ্বাস করি স্রষ্টাকে, তাই বিশ্বাস করি বিবেককে। আমরা বিবেককে যদি কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি তবে আমার বিশ্বাস -at least we will and should make mistakes, just make sure we learn from them!
লেখক : সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন থেকে rahman.mridha@gmail.com