হাঁটার সময়ে শ্বাসকষ্ট? কখন উদ্বেগের কারণ
হাঁটার সময়ে শ্বাসকষ্ট? কখন উদ্বেগের কারণ - ছবি : সংগ্রহ
কয়েক ধাপ হাঁটার পরে যখন শ্বাসকষ্ট হয় তখন আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। অনেকেই হার্ট বা ফুসফুসের সমস্যার সঙ্গে সংযুক্ত করে ফেলেন শ্বাসকষ্টকে। এমনকী চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই ঘরোয়া প্রতিকার শুরু করেন অনেকে। অনেকেই আবার শ্বাসকষ্ট লক্ষ্য করার পর হার্টে পর্যাপ্ত পরিমাণে রক্ত পাম্প করা এবং হার্টকে সঠিকভাবে কাজ করানোর চেষ্টা করেন। এছাড়াও হার্টের উপরে নানান রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। স্তব্ধ হার্টকে চালু করার জন্য যা করা হয়, তা সম্পূর্ণ ভুল। শ্বাসকষ্ট বিভিন্ন কারণে হতে পারে।
শ্বাসকষ্ট কী?
শ্বাসকষ্ট শুরু হয় যখন শরীর শ্বাস নেয়ার জন্য পর্যাপ্ত বাতাস পায় না। এই ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি আরো শক্তিশালী হয়ে এবং দ্রুত শ্বাস নিতে থাকে কিন্তু ভিতরে পর্যাপ্ত বাতাস সরবরাহ করতে অক্ষম হয়। আক্ষরিক অর্থেই মানুষ বাতাসের জন্য হাঁফাতে থাকে। তখনই হয় শ্বাসকষ্ট। শ্বাসকষ্টের মেডিকেল পরিভাষা হল ডিসপনিয়া। পরিস্থিতি সবচেয়ে ভালোভাবে বর্ণনা করা যেতে পারে যখন একজন নন-রানার কিছু সময়ের জন্য দৌড়ায় এবং তারপরে বাতাসের জন্য হাঁফাতে থাকে।
ছোটখাটো শারীরিক কাজ করার পরও আমরা শ্বাসকষ্ট অনুভব করতে পারি। যেমন সিঁড়ি বেয়ে ওঠা বা সমান্তরাল জায়গায় হাঁটার পরও শ্বাসকষ্ট অনুভব হয়। এর ফলে একজন ব্যক্তির স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হয়।
সম্ভাব্য কারণ কী কী হতে পারে?
শ্বাসকষ্টের পিছনে বেশ কয়েকটি মেডিকেল এবং নন-মেডিকেল কারণ রয়েছে। উচ্চতায় থাকাকালীন তা হতে পারে বা বাতাসের গুণমান যখন বিপজ্জনক স্তরে থাকে বা তাপমাত্রা খুব বেশি হয় বা ভারী ব্যায়াম করার পরেও কেউ শ্বাসকষ্ট অনুভব করতে পারে।
বেশ কিছু চিকিৎসাগত শর্ত রয়েছে যা একজন ব্যক্তির শ্বাসকষ্টের কারণ হয়। অ্যালার্জি, হাঁপানি, হার্টের সমস্যা, ফুসফুসের রোগ, নিউমোনিয়া, স্থূলতা, যক্ষ্মা রোগের মতো সমস্যাগুলোও শ্বাসকষ্টের কারণ হয়।
সম্প্রতি করোনাভাইরাসও কোভিড রোগীদের শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্ষমতাকেও প্রভাবিত করছে বলে জানা গেছে। অনেক লোক যাদের সাধারণ কোভিড উপসর্গ রয়েছে, যেমন গলা ব্যথা, নাক দিয়ে পানি পড়া, তারাও সংক্রমণের সময়ে শ্বাসকষ্টের সম্মুখীন হয়েছেন।
অন্তর্নিহিত চিকিৎসা জটিলতা কী কী?
উপরে উল্লিখিত কারণগুলো ছাড়াও আরওনানা বিষয় রয়েছে যা একজন ব্যক্তির শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্ষমতাকে প্রভাবিত করতে পারে। আহমেদাবাদের অ্যাপোলো হাসপাতালের পালমোনোলজিস্ট ডা. কাশ্মীরা ঝালা জানিয়েছেন, “চিকিৎসাও শ্বাসকষ্টের একটি কারণ হতে পারে, অনেক সময়ে এর উপর নির্ভর করে শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা হতে পারে, কারণ এটি ফুসফুস, হার্ট, কিডনি বা পেশির সমস্যা থেকেও দেখা দেয়। তাই যদি সুরাহা না করা হয় তবে এটি ফুসফুস, কিডনি, হার্ট বা পেশিতন্ত্রের বড় রোগের কারণ হতে পারে। প্রধানত ফুসফুসে অপরিবর্তনীয় পরিবর্তন হতে পারে যদি রোগের প্রাথমিক সময়ে অবহেলা করা হয় বা নির্ণয় না করা হয়”।
শ্বাসকষ্ট শুরু হলেই গবেষকরা জানাচ্ছেন সমস্যা দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া প্রয়োজন।
সিওপিডি
সিওপিডিকে ক্রনিক অবসট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ বলা হয়। এটা দীর্ঘমেয়াদী শ্বাসতন্ত্রের একটি রোগ। ধূমপানের কারণে এই শ্বাসকষ্টটা বেশি হয়ে থাকে। যারা ধূমপান করে, সাধারণত ৪০ বছরের পরে বয়স যাদের তাদের এই শ্বাসকষ্টটা শুরু হয়। রোগীর কাশির সঙ্গে সঙ্গে শ্বাসকষ্ট থাকে এবং শ্বাসকষ্টের ধরনটা যখন সে কাজ করতে থাকে, পরিশ্রমের কাজ করতে থাকে, সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকে বা কোনও ব্যায়াম করছে, এ কম পরিশ্রমের কাজ করতে গেলে তার শ্বাসকষ্টটা শুরু হয়। ধীরে ধীরে এই শ্বাসকষ্টটা ক্রমাগত বাড়তে থাকে। একটি সময় আসে যখন তার বসে থেকেও শ্বাসকষ্ট হয়। এই শ্বাসকষ্টটা ক্রমাগত বাড়তেই থাকে। এটি সেরে যায় না বা একেবারে কমে যায় না। ক্রমাগত এটা বাড়তে থাকে।
শ্বাসকষ্ট কখন স্বাভাবিক এবং মানুষের এটি সম্পর্কে অতিরিক্ত চিন্তা করা উচিত নয়?
ঘুমহীন রাত্রিযাপন বা উচ্চ তাপমাত্রার কারণে বা কোনও ঘটনার ফলে যদি শ্বাসকষ্ট হয়ে থাকে তাহলে চিন্তার কিছু নেই। যদি পরিস্থিতির স্বাভাবিক কারণে শ্বাসকষ্ট হতে থাকে তাহলে চিন্তার কিছু নেই। কারণ অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় স্বাভাবিক কারণেই শ্বাসকষ্ট হয় এবং কিছুক্ষণ পরে তা নিরসনও হয়ে যায়।
বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, ফুসফুসের ক্ষমতা এবং অন্তর্নিহিত সমস্যা জানতে ফুসফুসের কার্যকারিতা পরীক্ষা করা উচিত। এটি শ্বাসকষ্টের জন্য একটি স্ক্রিনিং পরীক্ষার মতো। যদি এটি স্বাভাবিক হয় এবং শরীরের অন্যান্য ক্রিয়াকলাপও স্বাভাবিক থাকে, তবে নিয়মিত বিরতিতে ফুসফুসের কার্যকারিতা পরীক্ষার সময় ব্যক্তিকে পর্যবেক্ষণে রাখা যেতে পারে, এতে স্পষ্ট হয়ে যায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির শ্বাসকষ্ট স্বাভাবিক না শরীরের কোনো সমস্যার জন্য তৈরি হচ্ছে শ্বাসকষ্ট। শ্বাসকষ্টের কারণ অনেকগুলো হতে পারে। এর মধ্যে আশঙ্কা থাকে যে শ্বাসযন্ত্রের বা শ্বাসতন্ত্রের কারণে সমস্যা হয়। যেমন ব্রঙ্কিয়াল অ্যাজমা রয়েছে, সিওপিডি রয়েছে, পালমোনারি ডিমাউথ; অ্যাজমা তো রয়েছেই। কার্ডিওভাসকুলারও একটি কারণ। হার্টের কারণে যেটা হচ্ছে, ধরা যাক কারও যদি হার্ট ফেলিওর হয়, সে ক্ষেত্রেও কিন্তু শ্বাসকষ্ট হয়। এ ছাড়া ডায়াবেটিক রোগী যারা, তাদের যখন জটিলতা হয় বা মেটাবলিক এসিডোসিস— তখনও কিন্তু শ্বাসকষ্ট হয়। রোগীর চিকিৎসা করার সময় অবশ্যই এগুলো মাথায় রাখতে হয় চিকিৎসকদের।
কখন শ্বাসকষ্ট হলে তা উদ্বেগের কারণ হয়ে ওঠে?
শ্বাসকষ্ট দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকলে অবশ্যই একজন ডাক্তার দেখাতে হবে। যদি উপসর্গটি ক্রমাগত হতে থাকে এবং অন্যান্য উপসর্গের সঙ্গে যুক্ত হয়, তবে এটিকে অবহেলা করা উচিত নয়। প্রাথমিক বেসলাইন ফুসফুসের ফাংশন টেস্ট-পালমোনারি ফাংশন টেস্ট স্বাভাবিক না হলে অবশ্যই একজন পালমোনোলজিস্টের কাছে যাওয়া উচিত। তার পরামর্শ নিয়ে চিকিৎসা শুরু করা বাধ্যতামূলক। কোভিডের পরে, এখন সবাই পিএফটি সম্পর্কে সচেতন। সুতরাং, ফুসফুসের ক্ষমতা জানার জন্য এটি নিয়মিত পরীক্ষা করা উচিত বলে মনে করেন ডা. ঝালা। তার ব্যাখ্যা, শ্বাসতন্ত্রের বা রেসপিরেটরি পদ্ধতির জন্য যে শ্বাসকষ্টটি সেখানে দেখা যায় সেটি শুধু শ্বাসকষ্ট থাকে না, শ্বাসকষ্টের সঙ্গে কাশিও হয়। অনেক দিন ধরে কাশি থাকতে পারে। পুরোনো কাশি বেড়ে যাচ্ছে বা হঠাৎ করে কাশি থাকতে পারে। সঙ্গে কফ বের হয়, কখনও কখনও কফের সঙ্গে রক্তও বেরোতে পারে। অনেক সময় দেখা যায় ভোর রাতে ঘুমিয়ে আছে, রোগীর হঠাৎ করে শ্বাসে কষ্ট হচ্ছে, বুকের মধ্যে শাঁ-শাঁ করছে। এর পর দেখা যায় যে সিওপিডির রোগীদের হাঁটাচলা করতে গেলে, সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গেলে, কোনো কাজ করতে গেলে বা ব্যায়াম করতে গেলে, তখন শ্বাসকষ্টটা বেড়ে যায়। তখন চিকিৎসকরা বুঝতে পারেন তার রেসপিরেটরি পদ্ধতির কারণে শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।
ব্রঙ্কিয়াল অ্যাজমা বা হাঁপানি রোগ যাদের তাদেরও শ্বাসকষ্ট হয়, কিন্তু সেই ক্ষেত্রে একটু ভিন্নতা থাকে। যেমন রোগীর শ্বাসকষ্টের সঙ্গে কাশি থাকে, বুকের ভেতর একটা শাঁ- শাঁ করে শব্দ হয়- যেটি সিওপিডিতে সাধারণত হয় না।
আর অ্যাজমা রোগীদের ক্ষেত্রে দেখা যায় তাদের একটি পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড থাকে— অ্যালার্জি এক্ষেত্রে অন্যতম। যেসব কারণে রোগীর শ্বাসকষ্টটা হঠাৎ করে বেড়ে যায়। সেটা দেখা যায় অ্যালার্জির কারণে। আবার পারিবারিকভাবেও আসতে পারে। একে এটোপিক বলা হয়। সাধারণত দেখা যায় রোগীর অ্যাজমা বা শ্বাসকষ্টের সঙ্গে সঙ্গে তার অ্যালার্জিক রাইনাইটিস, অর্থাৎ নাক দিয়ে পানি ঝরে, কনট্রাক্ট ডার্মাটাইটিস বা চামড়ার রোগ থাকে, একজিমা— এগুলোর সঙ্গে একটার পর একটা হতে থাকে। পরে তার অ্যাজমা তৈরি হয়।
অন্যান্য উপসর্গ কী হতে পারে যার জন্য সতর্ক হতে হবে?
অন্যান্য উপসর্গ যেমন বুকে ব্যথা, বুক ভারী হওয়া, শ্বাসকষ্ট, কাশি, অনিদ্রা, নাক ডাকা, উভয় পায়ে যন্ত্রণা এবং ক্লান্তি শ্বাসকষ্ট অনুভব হচ্ছে কিনা তাও পরীক্ষা করা উচিত ডাক্তারদের বলেছেন গবেষকরা।
কোভিড-১৯ মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউ সহায়ক অক্সিজেনের চাহিদা বাড়িয়ে দিয়েছে। দ্বিতীয় ঢেউয়ে শ্বাসকষ্ট একটি সাধারণ লক্ষণ। এর মাধ্যমে অক্সিজেনের চাহিদার প্রয়োজন বোঝা গিয়েছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন ৯০ শতাংশ কোভিড রোগীর ফুসফুস সংক্রান্ত সমস্যা হয়েই থাকে। ১০-১২ শতাংশ সংক্রমিতের নিউমোনিয়া হয়। অ্যালভেউলির লক্ষণ দেখা যায় খুব কম সংক্রমিতের। এদের মধ্যে কম সংখ্যক রোগীরই অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়। রোগীর সহায়ক অক্সিজেনের প্রয়োজন কমাতে শ্বাস আটকে রেখে ব্যায়াম করার চর্চা করা যেতে পারে।
কীভাবে শ্বাস আটকে রাখার ব্যায়াম সাহায্য করতে পারে?
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন যেসব রোগীর হাল্কা উপসর্গ দেখা দেয় তাদের ক্ষেত্রে এই ব্যায়াম সহায়ক হতে পারে। এইসব সংক্রমিতরা যদি এই ব্যায়ামটি করেন তাহলে তাদের সহায়ক অক্সিজেনের প্রয়োজন হয় না। তবে যদি দেখা যায় কেউ দীর্ঘক্ষণ শ্বাস আটকে রাখতে পারছেন না তাহলে তাদের চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত। অন্য দিকে যদি কোনো রোগী শ্বাস আটকে রাখার সময় বাড়াতে পারেন তাহলে সেটি সুস্বাস্থ্যের নিদর্শন। যারা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন এবং এখন বাড়ি ফিরেছেন তারা চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে এই ব্যায়ামটি করতে পারেন।
সূত্র : নিউজ ১৮