বিদেশীদের জন্য ইউক্রেনের পক্ষে যুদ্ধ করা কি আইনত বৈধ?

অন্য এক দিগন্ত | Mar 16, 2022 03:48 pm
বিদেশীদের জন্য ইউক্রেনের পক্ষে যুদ্ধ করা কি আইনত বৈধ?

বিদেশীদের জন্য ইউক্রেনের পক্ষে যুদ্ধ করা কি আইনত বৈধ? - ছবি : সংগ্রহ

 

রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়ার জন্য কয়েক হাজার বিদেশী স্বেচ্ছাসেবক যোদ্ধা হিসেবে ইউক্রেনকে সাহায্য করছে। রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য দেশের সশস্ত্র বাহিনীতে বিদেশী স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করার ঘোষণা করেছে ইউক্রেন। কিয়েভ বলেছে যে প্রায় ২০ হাজার বিদেশি ইতিমধ্যে ইউক্রেনের টেরিটোরিয়াল ডিফেন্সের জন্য তথাকথিত ইন্টারন্যাশনাল লিজিওনে যোগদান করেছে, তাদের বেশিরভাগই পশ্চিমা দেশগুলো থেকে এসেছে। তবে, স্বেচ্ছাসেবক যোদ্ধাদের মধ্যে কেউ কেউ তাদের নিজ দেশে আইনি পদক্ষেপের সম্মুখীন হতে পারে। রয়টার্স এবং অন্য মিডিয়া সংস্থাগুলি জানিয়েছে, ইউক্রেনের হয়ে কানাডা, জর্জিয়া, ভারত, জাপান, ব্রিটেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা স্বেচ্ছাসেবক যোদ্ধা হিসেবে লড়াই করছে।

পাল্টা রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও শুক্রবার মধ্যপ্রাচ্য থেকে, বিশেষ করে সিরিয়া থেকে স্বেচ্ছাসেবক যোদ্ধাদের আনার জন্য অনুমোদন দিয়েছেন। সিরিয়ায় স্পষ্টতই বিপুলসংখ্যক যোদ্ধা রয়েছে যাদের রাশিয়া কাজে লাগাতে পারে। শুক্রবার রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রী সের্গেই শোইগু জানিয়েছেন যে মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইতমধ্যেই ১৬ হাজারের বেশি যোদ্ধা রাশিয়ার হয়ে লড়ার জন্য আবেদন করেছে। যদিও তিনি কোনও নির্দিষ্ট দেশের নাম বলেননি।

আমেরিকানদের জন্য স্বেচ্ছাসেবক হওয়া কি বৈধ?

স্টেট ডিপার্টমেন্টের ওয়েবসাইট বলছে, মার্কিন নাগরিকদের অন্য দেশের সামরিক বাহিনীতে কাজ করতে বাধা দেওয়া হয় না। একজন অফিসার হিসাবে কাজ করা বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক থাকা একটি দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা স্বেচ্ছায় নাগরিকত্ব ছেড়ে দেওয়ার কারণ হতে পারে। তবে সুপ্রিম কোর্টের রায় বলে যে নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার জন্য একমাত্র বিদেশী সামরিক বাহিনীতে যোগ দেওয়ার কারণটি ইস্যু করা যাবে না।

১৭৯৪ সালের একটি পৃথক মার্কিন আইন নাগরিকদের ওয়াশিংটনের সঙ্গে শান্তিতে বিদেশি সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে নিষেধ করে। আইন অমান্য করলে তিন বছর পর্যন্ত জেলের সাজা হতে পারে। আইনটি রাশিয়ার বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাসেবক সামরিক পদক্ষেপের জন্য প্রযোজ্য হতে পারে। ২০১৪ সালে গাম্বিয়ায় একটি অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টায় জড়িত আমেরিকানদের বিচারের জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল এই আইন। না হলে আধুনিক ইতিহাসে খুব কমই প্রয়োগ করা হয়েছে এই আইন। ওয়াশিংটনের আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেভিড ম্যালেটের মতে,"অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে যোগ না থাকলে, ইউক্রেনে যাওয়ার জন্য আমেরিকানদের কী বিচার করা হচ্ছে, তা কল্পনা করাই আমার পক্ষে কঠিন।"

অস্ট্রেলিয়ান, ব্রিটিশ এবং ভারতীয় স্বেচ্ছাসেবকদের ক্ষেত্রে কী করা হবে?

যুদ্ধের জন্য ইউক্রেনে যাওয়া ব্রিটিশরা ফিরে আসার পরে বিচারের মুখোমুখি হতে পারে। ব্রিটেনের স্বেচ্ছাসেবকদের জন্য কী চার্জ প্রযোজ্য হবে? এই প্রশ্নের এড়িয়ে গিয়েছেন ব্রিটেনের পররাষ্ট্র দফতরের একজন মুখপাত্র। ইউনাইটেড কিংডমের বিদেশি তালিকাভুক্তি আইন ১৮৭০ সালে শেষবার আপডেট করা হয়েছে। এই আইন ব্রিটেনের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক থাকা অন্য দেশের সামরিক বাহিনীতে যোগদান থেকে নাগরিকদের বাধা দেয়। কিন্তু এটি আধুনিক সংঘাতের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়নি। ব্রিটেনের পররাষ্ট্র সচিব প্রথমে ইউক্রেনের হয়ে স্বেচ্ছাসেবকদের লড়াইয়ের জন্য নাগরিকদের সমর্থন জানিয়েছিলেন, কিন্তু পরে ইউক্রেনে যাওয়ার বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন।

অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট ম্যারিসন তার দেশের নাগরিকদের ইউক্রেনের সামরিক লড়াইয়ে যোগ না দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

ভারতের তামিলনাড়ুর কোয়েম্বাতোর জেলার সৈনিকেশ রবিচন্দ্রন নামে এক ২১ বছরের যুবক রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে ইউক্রেনের আধাসামরিক বাহিনীতে যোগ দিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে বলে খবর। ২০১৮ সালে ইউক্রেনের খারকিভে পাড়ি দেন রবি। খারকিভে ন্যাশনাল অ্যারোস্পেস ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা শুরু করেন। যদিও কোনও ভারতীয় নাগরিকের ইউক্রেনের বাহিনীতে যোগদানের বৈধতা সম্পর্কে কোনও জবাব দেয়নি ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ২০১৫ সালে ভারতীয়দের ইরাক ভ্রমণের সঙ্গে জড়িত একটি মামলায় মন্ত্রণালয় দিল্লি হাই কোর্টকে বলেছিল যে ভারতীয়দের অন্য দেশের সংঘাতে অংশ নেয়ার অনুমতি দিলে ভারত সরকার অন্য দেশে সন্ত্রাসবাদকে প্রচার করছে, এমন অভিযোগ তোলা হবে।

কোন দেশে ছাড় আছে?

জার্মানি বলেছে যে তারা যুদ্ধে যোগদানকারী স্বেচ্ছাসেবকদের বিচার করবে না। ড্যানিশ ও লাটভিয়ান নেতারাও বলেছেন যে তারা তাদের নাগরিকদের স্বেচ্ছাসেবক যোদ্ধা হওয়ার অনুমতি দেবে। কানাডার প্রতিরক্ষামন্ত্রী অনিতা আনন্দ বলেছেন, কোনো কানাডিয়ান স্বেচ্ছাসেবক হবেন কি না সেটা ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত।

যদি ইউক্রেনে বিদেশী যোদ্ধাদের বন্দী করা হয়, তাহলে কী হবে?

ইসরাইলের লডার স্কুল অফ গভর্নমেন্ট-র ডিপ্লোম্যাসি অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজির অধ্যাপক ড্যাফনি রিচেমন্ড-বারাক বলেছেন, "আন্তর্জাতিক আইনে বিদেশি যোদ্ধাদের যুদ্ধবন্দী হিসাবে বিবেচনা করতে হবে রাশিয়াকে। সেটা দেশ নির্বিশেষে। তার মানে রুশ সেনাদের অবশ্যই স্বেচ্ছাসেবক যোদ্ধাদের খাবার, পানি এবং চিকিৎসা পরিষেবা দিতে হবে। তবে, রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র গত সপ্তাহে বলেছিলেন যে ইউক্রেনের পক্ষে লড়াই করা পশ্চিমা ভাড়াটে সেনাদের আইনি যোদ্ধা হিসাবে গণ্য করা হবে না এবং তারা ফৌজদারি বিচার বা আরও খারাপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে।

রাশিয়ান বাহিনীতে যোগ দেয়া বিদেশী নাগরিকদের সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছে ইউক্রেনও। ইতিমধ্যেই ইউক্রেন আন্তর্জাতিক আদালতে এই বিষয়ে মামলা দায়ের করেছে। শনিবার ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্র কুলেবা এক ট্যুইট বার্তায় লিখেছেন, "রাশিয়া ইউক্রেনের বিরুদ্ধে আগ্রাসন চালাচ্ছে। আমি বিদেশী নাগরিকদের সতর্ক করে দিচ্ছি যারা রাশিয়ার আগ্রাসন বাহিনীতে যোগ দিয়ে থাকতে পারেন বা ইচ্ছা রয়েছে। আপনারা এমনটা করবেন না। আমরা ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা দায়ের করেছি। বেঁচে গেলেও আপনারা যুদ্ধাপরাধী হবেন। সেক্ষেত্রে অর্থ বা অন্য কিছুরই মূল্য থাকবে না।"

স্বেচ্ছাসেবকদের বিচার করা যেতে পারে?

যেহেতু স্বেচ্ছাসেবকরা ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর সদস্য হিসাবে যুদ্ধ করবে,তাই বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুদ্ধাপরাধ বা অনুরূপ আচরণের জন্য বিচার ব্যতীত নিজ দেশে অভিযোগের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

যোদ্ধাদের অভাব নেই : সিরিয়ার দীর্ঘ, বীভৎস যুদ্ধ সব পক্ষেরই অনেক সশস্ত্র দল, মিলিশিয়া এবং ভাড়াটে সেনাদের জন্ম দিয়েছে। সিরিয়ায় সরকারপন্থী আধাসামরিক গোষ্ঠীগুলির মধ্যে রয়েছে হাজার হাজার তথাকথিত জাতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী, খ্রিস্টান মিলিশিয়া যোদ্ধা এবং শহুরে-গেরিলা যুদ্ধে দক্ষ সেনা সদস্য। অন্যান্য রাশিয়ান-সমর্থিত সহায়ক ইউনিট এবং মিলিশিয়ারাও এই তালিকায় রয়েছে। সিরিয়া বিশ্লেষক ড্যানি মাক্কির মতে, "যদি প্রয়োজন হয়, রাশিয়া দ্রুত ইউক্রেনে যুদ্ধ করার জন্য এই গোষ্ঠীর সদস্যদের নিয়োগ করতে পারে।" নিকটবর্তী ইরাক, লেবানন এবং অন্য অঞ্চলের ইরান-সমর্থিত যোদ্ধারা কেবল সিরিয়ার বিদ্রোহীদের সঙ্গেই যুদ্ধ করেনি, তারা ২০১৪ সালে ইরাক ও সিরিয়ার বড় অংশ দখল করার পরে ইসলামিক স্টেট গ্রুপের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সহায়তা করেছিল। রাশিয়ার বেসরকারি ঠিকাদার ওয়াগনার গ্রুপের হাজার হাজার ভাড়াটে সেনাও সিরিয়ায় মোতায়েন করেছে। মাক্কি বলেছেন, "সিরিয়ার অর্থনীতির দুর্দশার পরিপ্রেক্ষিতে যুদ্ধে যেতে চাওয়া পুরুষদের অভাব হবে না। যারা সামান্য কিছু বস্তুগত লাভের জন্য তাদের জীবন বাজি রাখতে ইচ্ছুক।"

তবে এটাই প্রথমবারের মতো সিরিয়ার যোদ্ধাদের বিদেশে কোনো যুদ্ধে নিয়োগ করা হবে না। তুরস্ক এর আগে তার যোদ্ধাদের উৎসাহিত করার জন্য সিরিয়ার ভাড়াটে সেনাদের নিয়োগ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে আজারবাইজান এবং লিবিয়া যুদ্ধ। যেখানে সিরিয়া, সুদান এবং তুরস্কসহ হাজার হাজার বিদেশী যোদ্ধার উপস্থিতি শান্তির পথে একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সিরিয় যোদ্ধাদের মধ্যে বিশেষ করে সরকার-নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে নিয়োগের প্রমাণ মাত্র পাওয়া যাচ্ছে। ইরাকের সীমান্তের কাছে পূর্ব প্রদেশ দেইর এল-জোরে কয়েক দিন ধরে চলছে নিয়োগ করছে ওয়াগনার গ্রুপ। ইউক্রেনে নিরাপত্তা রক্ষী হিসেবে ৬ মাস কাজ করার জন্য স্বেচ্ছাসেবকদের মাসে ২০০-৩০০ মার্কিন ডলার অফার করছে রাশিয়া।

শুক্রবার, স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগের একটি বিজ্ঞাপন সিরিয়ার সেনাবাহিনীর অন্যতম বৃহত্তম চতুর্থ আর্মড ডিভিশনের ফেসবুক গ্রুপে পোস্ট করা হয়েছিল। সেখানে দক্ষতার উপর নির্ভর করে জন প্রতি ৩ হাজার ডলার পর্যন্ত দেয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় পরিচালিত টিভি চ্যানেল সিরিয়া থেকে ফুটেজ সম্প্রচার করেছে, যেখানে ইউনিফর্ম পরিহিত সশস্ত্র ব্যক্তিদের স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। পুরুষরা রাশিয়ান এবং সিরিয়ার পতাকা নাড়ছিল এবং 'জেড' অক্ষর সম্বলিত একটি চিহ্ন ধরেছিল।

উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ার একজন বিরোধী কর্মী আহমেদ আল-আহমাদ বলেছেন যে সরকার নিয়ন্ত্রিত উত্তরাঞ্চলীয় শহর ইথ্রায়ায় সিরিয়ান সেনাবাহিনীর পঞ্চম কর্পসের সিনিয়র অফিসারদেরকে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন যুবকদের নিয়োগ করতে বলেছে রাশিয়া। ব্রিটিশ সংবাদপত্র টাইমস শুক্রবার জানিয়েছে যে মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রের একদল যোদ্ধা একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে যেখানে তারা বলেছে যে তারা ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণে যোগ দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

সূত : নিউজ ১৮


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us