রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে যেভাবে বলাতে পারে ইউরোপের মানচিত্র
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে যেভাবে বলাতে পারে ইউরোপের মানচিত্র - ছবি : সংগ্রহ
১৯৮৯ সালে সোভিয়েত সাম্রাজ্যের পতনের পর থেকে রাশিয়া তার প্রভাব এবং বন্ধু হারিয়েছে। যদিও পারমাণবিক পরাশক্তি এখনো ইউরোপে তার বেশ কয়েকটি প্রতিবেশী দেশের উপর আধিপত্য বিস্তার করে এবং অন্যদের চাপের মধ্যে মধ্যে রাখে। প্রতিবেশী ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন এবং গত দুই সপ্তাহ ধরে যে যুদ্ধ চলছে তা রাশিয়ার প্রতি পশ্চিমি দেশগুলির আক্রোশ বাড়িয়েছে। এই যুদ্ধ ভবিষ্যতে ইউরোপের ভূ-রাজনৈতিক মানচিত্রে বড় পরিবর্তন আনতে পারে।
মস্কোর ইচ্ছার বিরুদ্ধে ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ ইউক্রেনকে কাছে টানা ব্যাপক সমস্যার সৃষ্টি করেছে। এক সপ্তাহ আগেই ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলেদিমির জেলেনস্কি ইউরাপীয় ইউনিয়নে যোগ দেওয়ার জন্য আনুষ্ঠানিক অনুরোধে স্বাক্ষর করেছেন। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের কাছে ভার্সাই প্রাসাদে বৈঠকে বসা ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতারা ওই আবেদন গ্রহণ করেছেন। এছাড়াও তারা ইউক্রেনকে সদস্যপদ দিতে রাজি হয়েছেন বলেও খবর। যদিও এই সদস্যপদ দ্রুত দেয়া হবে না বলেই আরো খবর। বৈঠকে ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের ফলাফল নিয়ে আলোচনা করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলো।
জেলেনস্কি মঙ্গলবার ইউরোপীয় সংসদে ভাষণে বলেছিলেন, 'ইউরোপীয় ইউনিয়ন আমাদের সঙ্গে নিয়ে আরো শক্তিশালী হতে চলেছে। সুতরাং এটি নিশ্চিত।' যদিও চাপের মুখে তিনি বলেন, 'ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতারা প্রমাণ করুন যে আপনারা আমাদের সঙ্গে আছেন। প্রমাণ করুন যে আপনারা আমাদের যেতে দেবেন না। প্রমাণ করুন যে আপনারা সত্যিই ইউরোপীয়।'
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সমস্যাকে আরো জটিল করেছে মলদোভা ও জর্জিয়া। রাশিয়ার আগ্রাসনের আশঙ্কায় থাকা এই দুটি ছোট দেশ ইউক্রেনের রাস্তায় হেঁটেছে। তারাও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ চেয়েছে। রুশ আগ্রাসন ও সহিংসতা সুইডেন এবং ফিনল্যান্ডের মতো ঐতিহাসিকভাবে নিরপেক্ষ দেশগুলোকেও আতঙ্কিত করেছিল। এই দেশগুলোতে ন্যাটো-তে যোগ দেয়ার আওয়াজ উঠেছে। মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে মহাদেশের ভূ-রাজনৈতিক মানচিত্র নড়ে গেছে। সুযোগের রোমাঞ্চ সত্ত্বেও অগ্রগতি ধীর হতে পারেই বলেই মনে করা হচ্ছে।
অনেক দেশই আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বৃদ্ধি মহাদেশটিকে একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের দিকে আরও ঠেলে দেবে। ইউক্রেন যোগ দিলেই ইউরোপে ব্লকের ভারসাম্যকে খানিকটা কাত হয়ে যেতে পারে। ইউরোপীয় কাউন্সিলের সভাপতি চার্লস মিশেল ভার্সাই সম্মেলনে তার আমন্ত্রণ পত্রে লিখেছিলেন, 'ইউক্রেনের সঙ্গে আমরা স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের পক্ষে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছি। ইউক্রেন আমাদের ইউরোপীয় পরিবারের অংশ।' অর্থাৎ, তিনি কোথাও সদস্য সংখ্যা বাড়ানোর কথা আমন্ত্রণপত্রে উল্লেখ করেননি। এমনকি যদি ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন দিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলো ঐক্যমত্য হয়, তবে সদস্যপদ দেয়া এই পর্যায়ে স্বয়ংক্রিয় বা এমনকি ইচ্ছাপূরণ ছাড়া কিছুই নয়।
আটটি পূর্ব সদস্য দেশের নেতারা আনুষ্ঠানিকভাবে ইউক্রেনকে সমর্থন করেছেন। তাদের মধ্যে একজন হলেন এস্তোনিয়ান প্রধানমন্ত্রী কাজা ক্যালাস। বুধবার তিনি স্ট্রাসবার্গে ইউরোপীয় সংসদে ভাষণ দিয়েছেন। ক্যালাস জোরের সঙ্গে বলেছেন, 'ইউক্রেনকে সদস্যপদ দেয়ার দৃষ্টিভঙ্গি দেয়া কেবল আমাদের স্বার্থেই নয়, এটি করা আমাদের নৈতিক দায়িত্বও। ইউক্রেন তাদের জন্য যুদ্ধ করছে না। তারা ইউরোপের জন্যও লড়াই করছে। যদি এখন না হয় তো কখন হবে?'
কিন্তু একই সময়ে ডাচ প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুট স্পষ্ট করেছেন যে ইউক্রেনকে এখনই সদস্যপদ দেওয়া যাবে না। গত সপ্তাহে জেলেনস্কির আবেগপূর্ণ বক্তব্যের পরে রুট মঙ্গলবার ফোনে তার সঙ্গে কথা বলেছিলেন। সেই বিষয়টি তুলে ধরে রুট বলেন, 'আমি তাকে বলেছিলাম যে আপনার উচ্চাকাঙ্ক্ষা জানি, তবে এটি স্বল্পমেয়াদে ঘটবে না কারণ এটি একটি সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া, যা অনেক বছর সময় নেয়। সুতরাং দেখা যাক আমরা এখন এবং আগামীকাল এবং পরের সপ্তাহে বা পরের মাসে কী করতে পারি।' তিনি জোর দিয়েছিলেন যে মলদোভা এবং জর্জিয়ার সদস্যপদ পেতে আরো সময় লাগবে। কারণ তারা ইউক্রেনের মতো হুমকির মুখোমুখি নয়।
ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস থিঙ্ক ট্যাঙ্কের পাওয়েল জেরকা বলেন, 'ইউক্রেনের ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানের বিষয়ে আলোচনা সহজেই উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে।' অতীতে, সদস্যপদ আবেদনের জন্য কয়েক বছর, কখনও কখনও কয়েক দশক লেগেছে। তুরস্ক ১৯৮৭ সালে যোগদানের জন্য আবেদন করেছিল এবং তারাও এখনও সদস্য পদ পায়নি। চারটি দেশের আবেদন এখনো ঝুলে রয়েছে। তবে ইইউ আরো পূর্ব দিকে প্রসারিত করতে চরম অনিচ্ছা দেখিয়েছে। ইউক্রেনের সদস্যপদ মেনে নিলে অন্যরা সেটা ভাল চোখে নেবে না। এছাড়াও সম্ভাব্য নতুন সদস্যদের আইনের শাসনের নীতি থেকে শুরু করে বাণিজ্য এবং সারের মানসহ প্রায় ৮০ হাজার পাতার নিয়মগুলি মেনে নিতে হবে। বিগত বছরগুলিতে ইইউ প্রায়শই উল্লেখ করেছে যে ইউক্রেনের দুর্নীতি বিরোধী পদক্ষেপগুলো সেইভাবে কার্যকর নয়। সদস্যপদ পেতে গেলে বর্তমান সদস্যদের সর্বসম্মত অনুমোদনের প্রয়োজন। এখানে একটি দেশও তাদের আপত্তি জানাতে পারে।
তুলনামূলকভাবে, ন্যাটো সদস্য পাওয়ার দিকে অগ্রসর হওয়া সহজ, বিশেষ করে সুইডেন এবং ফিনল্যান্ডের মতো দেশগুলোর জন্য। যেহেতু ইতিমধ্যেই সামরিক জোটের সঙ্গে উভয় দেশেরই খুব ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা রয়েছে। যদিও একটি আনুষ্ঠানিক পদক্ষেপ অবশ্যই মস্কোর ক্রোধ বাড়িয়ে দেবে এবং একটি ভূ-রাজনৈতিক শক্তির খেলা হিসাবে দেখা হবে। রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা বলেছেন, 'এটি স্পষ্ট যে ফিনল্যান্ড এবং সুইডেন যদি ন্যাটোতে যোগ দেয়, যা সর্বপ্রথম একটি সামরিক সংস্থা, তাহলে এটি গুরুতর সামরিক-রাজনৈতিক পরিণতি ঘটাবে, যার জন্য রাশিয়ান ফেডারেশনের দ্বারা প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপের প্রয়োজন হবে।' কিন্তু, একরকম, যে নর্ডিক নিরপেক্ষতা ইতিমধ্যে স্খলন হতে পারে।
রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের এড আর্নল্ড বলেছেন, 'সুইডেন এবং ফিনল্যান্ড কার্যকরভাবে ইউক্রেনে সামরিক সহায়তা পাঠিয়ে তাদের নিরপেক্ষতা প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে। সুইডেনের ক্ষেত্রে ইউক্রেনে সামরিক সহায়তা পাঠানো প্রাণঘাতী পদক্ষেপ।'
সূত্র : নিউজ ১৮