ইউরোপের মানচিত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন আসন্ন!

সাইফুল খান | Mar 12, 2022 09:53 pm
ইউরোপের মানচিত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন আসন্ন!

ইউরোপের মানচিত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন আসন্ন! - ছবি : সংগৃহীত

 

বৈশ্বিক রাজনীতিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে ভাঙা-গড়ার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ইউরোপের মানচিত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন এবং বাকি দুনিয়ার বাণিজ্যিক ও সামরিক সম্পর্ক নয়া নির্মাণের চাহিদার উপযুক্ততা সৃষ্টি করছে বলে নানা ধরনের ইঙ্গিত সামনে আসছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কোনো নির্দিষ্ট ছক নেই। অন্তত বিগত শতকের শেষ সিকি ভাগে মতবাদগত এস্টাবলিশমেন্টে সেটা চোখে পড়েনি। যেমন গণতন্ত্রের নির্মাণ, চর্চা, পৃষ্ঠপোষকতার ভিত্তিতে পশ্চিমা সম্পর্কের তাত্ত্বিক চর্চা নানা রকম দেখা গেছে। ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়ার বাথ পার্টির জন্ম পৃষ্ঠপোষকতা তথা একনায়কতন্ত্র, আরবের রাজতন্ত্র, মিসরের স্বৈরাচারের সাথে ওয়েস্ট মিনিস্টার সংসদীয় ব্যবস্থা, প্রেসিডেন্সিয়াল গণতন্ত্রের হাত ধরাধরি করে চলতে অসুবিধা হয়নি। উত্তর কোরিয়ার স্বৈরাচারের চেয়ে সাদ্দামের স্বৈরাচার একটা সময় পর্যন্ত গণতান্ত্রিক বিউটি ছড়িয়েছে!

সৌদি আরবের রাজতন্ত্র আর আমেরিকার গণতন্ত্রের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়েছে। কোল্ড ওয়ারের পর তাত্ত্বিক সম্পর্কের চেয়ে কৌশলগত ও অংশীদারিত্ব সম্পর্ক বৃদ্ধি পেয়েছে। টেবিলের নিচে সন্দেহ আর অবিশ্বাসকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দিয়ে সম্পর্কের নির্মাণ করাকে কৌশল হিসেবে নিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র । এতে শত্রুর চেয়ে বন্ধু বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৫০ সালের পর থেকে আমেরিকার সাথে সম্পর্ক রাখতে গিয়ে অনেক দেশ, দেশের সরকারকে মূল্য দিতে হয়েছে। ইরাক, লিবিয়া, পাকিস্তান উদাহরণ হিসেবে আসতে পারে।

রাষ্ট্র কাঠামো কেমন এ বিষয়টিকে পাশে রেখেও শুধুমাত্র পুঁজিবাদী পদ্ধতি এবং কৌশলগত প্রয়োজনে বন্ধুত্ব হতে পারে।

সম্পর্কের জটিল মারপ্যাঁচের সামনে এখন ভারত, বাংলাদেশ, চীন, পাকিস্তান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, তুরস্কসহ আরো অনেক দেশ। এখন তাদের শ্যাম রাখি না কূল রাখি অবস্থা।

ইউক্রেন ইস্যুতে রাশিয়া ঠোঁট কাটা পজিশনে আছে। হয় বন্ধু, না হয় অবন্ধু (শত্রুর কাছাকাছি)। এশিয়ার উল্লেখিত দেশগুলোর ব্যবসা, বাণিজ্য, রাজনীতি, শিক্ষা, গবেষণা, জীবনযাপন সবটাই পশ্চিমা নির্ভর। এর বাইরের যত প্রয়োজন তার প্রায় সব আসে রাশিয়া-চীনা ব্লক থেকে। এশিয়া বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রুশ অস্ত্রকেন্দ্রিক ব্যবসাবাণিজ্য, গম, ভুট্টা, ভোজ্য তেলসহ নির্দিষ্ট কিছু পণ্য আমদানি করে থাকে। যেখানে ইউরোপ জ্বালানিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক পণ্যের ক্ষেত্রে রাশিয়া ও ইউক্রেনের ওপর নির্ভরশীল। ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণ দীর্ঘদিন রাশিয়ার হাতে থাকলে অথবা ইউক্রেনের সকল ধরনের বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে বন্ধ থাকলে গোটা ইউরোপের নাগরিক জীবনে এর প্রভাব পড়বে। নাগরিক জীবনে যখন সংকট আসে তখন রাষ্ট্র সেটা সামাল দিতে পারে না। বিশেষত ইউরোপের উন্নত জীবনের নাগরিকেরা সংকটের সাথে আপস করতে পারবে না।

স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী বিগত তিন দশক ধরে ঘুমন্ত থাকা ব্লকগুলো ফেব্রুয়ারিতে এসে আগ্নেয়গিরির মতো জেগে ওঠেছে।

এই ইস্যুতে জাতিসঙ্ঘের ভোটাভুটিতে কার্যত বৈশ্বিক বিভাজন নজরে এসেছে। এশিয়ান জায়ান্ট চীনকে থামাতে আমেরিকার দরকার ভারতকে এবং তা অবশ্যই দরকার। আবার ভারতের সামরিক ও কৌশলগত সম্পর্কের জন্য রাশিয়াকে দরকার। অন্যদিকে চীনের সাথে ভারতের যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক অথবা আমেরিকার সাথে চীনের বাণিজ্যিক সম্পর্ককে অস্বীকার করে বা বাতিল করে দিয়ে একেবারে নতুন বা ভিন্ন পথ অবলম্বনের কোনো রাস্তা এখন পর্যন্ত নেই। পাকিস্তান ছাড়া সদ্য মুক্ত-স্বাধীন, স্বাভাবিক আফগানিস্তানকে কৌশলগত নিয়ন্ত্রণ আমেরিকার পক্ষে সম্ভব নয়। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো মার্কিন মিত্র হিসেবে স্বজাতির বিরুদ্ধে বন্দুক নিয়ে দশকের পর দশক যুদ্ধ করলেও রাশিয়া-চীন ইস্যুতে সম্পর্কচ্ছেদ করে শুধুমাত্র মার্কিন বলয়ে যেতে পারবে না।

চীনের বড় দুর্বলতা জ্বালানি গ্যাস, তেল এবং উৎপাদিত পণ্যের বাজার। ইউরোপ-আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য চীনের এলিট মার্কেট। রাশিয়ার সাথে কৌশলগত সম্পর্কের বাইরে এসে সামরিক অংশগ্রহণ চীনকে অর্থনৈতিকভাবে চাপে ফেলবে। দুনিয়াজুড়ে টেকনলোজিকাল বিজনেস, অবকাঠামো নির্মাণের ব্যবসা ঝুঁকির মুখে পড়বে। এরকম পরিস্থিতি তৈরি হলে চীনের পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠবে। চীনের আভ্যন্তরীণ এথনিক মুক্তিকামী সংগ্রাম, বহিঃশত্রুরা এই সুযোগ লুফে নেবে। সুশৃঙ্খল বিশাল চীনের বিশৃঙ্খল হতে সময় লাগবে না।

তুরস্ক হাঁটছে রাজনৈতিক আগুনের ভেতর দিয়ে। রাশিয়ার সাথে সে সম্পর্ক রেখেই রাশিয়াকে ঘায়েল করার স্বপ্ন দেখে। ইউক্রেনের সাথে সম্পর্কের পরীক্ষায় এরদোগানকে পাস করতেই হবে। আন্তর্জাতিক চুক্তিকে সামনে এনে বসফোরাস সবার জন্য বন্ধ করে দিলে রাশিয়ার নৌবাহিনীর ক্ষতি বেশি হবে এটা সবার জানা। একদিকে ন্যাটোর প্রভাবশালী দেশ হয়েও রাশিয়ার বিপক্ষে শক্ত অবস্থান না নেয়া আবার পশ্চিমের আদরের বেড়াল ইসরাইলকে কোলে তুলে নিয়ে পশ্চিমা ব্লকের বিশ্বস্ত থাকার খেলায় এখন পর্যন্ত এরদোগান ঝানু খেলা দেখাচ্ছেন। এরদোগান চরম সংকটকালীন সময়ে সৌদি ও আমিরাতের পক্ষ থেকে বিরোধিতা পেয়েছেন, সে হিসেবে মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে তুরস্ক কার্যত একা পথ চলছে। তুরস্কের রাজনীতি, অর্থনীতি, জীবনব্যবস্থা যুগ যুগ ধরে ইউরোপীয় ধাঁচের হওয়ায় পশ্চিমের বিরাগভাজন হয়ে সে টিকতে পারবে না। এটাই তুরস্কের বাস্তবতা। এছাড়া তুরস্ক সাংবিধানিকভাবে ইসলাম কায়েম করবে এরকম কোনো ইশতেহারও এরদোগানের ছিল না।

ইরানও মুসলিম দেশ হিসেবে একাই পথ চলছে। তারা ইসলামী বিপ্লবের শিক্ষাকে বিশ্বায়নের স্বপ্ন দেখে। বিশ্বব্যাপী ইরানের মতবাদগত এজেন্ডা বাস্তবায়নের লক্ষ্য থাকলেও তুরস্কের বর্তমান শাসকদের নেই। তাদের পথ চলা আর তুরস্কের পথ চলার ভিতরে কৌশলগত পার্থক্য বিশাল। তাই ইরানকে দিয়ে তুরস্ককে বিচার কিংবা তুরস্ক দিয়ে ইরানকে বিচার করা সমীচীন নয়।

তাহলে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরিণতি কোন দিকে যাবে? রাশিয়া যদি কিয়েভ দখল করে শর্ত দিয়ে মীমাংসায় আসতে পারে তাহলে পরিষ্কার দুটি ব্লক তৈরি হবে। আর যদি রাশিয়াকে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধে যুক্ত থাকতে হয় তবে রুশ ফেডারেশনকে আরেক দফা ভাঙনের মুখে পড়তে হতে পারে। তাই যদি ঘটে তাহলে পুতিনের রক্ষা নেই। সেটা যেন না হয় সেজন্য পুতিন তার জায়গা থেকে সম্ভাব্য সব ধরনের সামরিক ও বাণিজ্যিক হুমকি দিয়েই রেখেছেন।

মার্কিন অবরোধের প্রভাবে বিশ্ব একটা কৃত্রিম খাদ্য ও জ্বালানি সংকটে পড়তে যাচ্ছে। রাশিয়া ও ইউক্রেনের উৎপাদিত পণ্য ও খনিজের কোনো দীর্ঘমেয়াদি এবং নিবিড় বিকল্প সরবরাহব্যবস্থা তাদের হাতে নেই। এই সুযোগ অনেক দেশ কাজে লাগাতে পারে। রাশিয়ার ওপর অবরোধ, ইউরোপের ভিতর দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের নেগেটিভ বৈশ্বিক প্রভাবকে আমেরিকা ও তার মিত্ররা যদি সমাধান দিতে না পারে তাহলে অনেক কিছুর নিয়ন্ত্রণই তারা হারাবে। এমনকি জাতিসঙ্ঘ নামক প্রতিষ্ঠানটিও তার জৌলুস আর আবেদন হারাবে, যদিও জন্মের পরে এ পর্যন্ত বহু পক্ষপাতদুষ্ট সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্কিত হয়েই আছে। তখন হয়তো বিকল্প প্রতিষ্ঠানের আবেদনের পক্ষে সমর্থকও খুঁজে পাওয়া যাবে অনেক বেশি। এইসব নানাবিধ সংকট ও প্রেক্ষাপট উগ্র জাতীয়তাবাদের জন্ম দেবে যার কুফল সম্পর্কে ধারণা করাও আপাতত সম্ভব নয়।

রাশিয়া-ইউক্রেন প্রেক্ষাপটে উভয় পক্ষের ছাড় দিয়ে যুদ্ধ বন্ধের কোনো বিকল্প নেই। যদিও এতে বিধ্বস্ত ইউক্রেন সবদিক দিয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কৌশলগতভাবে রাশিয়াকে তখন বিজয়ী মনে হলেও দুনিয়া আরেকটা মহাযুদ্ধ থেকে অন্তত রক্ষা পাবে।

লেখক : আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us