রাশিয়ার ওপর থেকে অবরোধ তুলে নেবেন বাইডেন?
পুতিন ও বাইডেন - ছবি : সংগ্রহ
এটা এখন পরিষ্কার যে, বাইডেন-জেলেনস্কির হার লুকানোর প্রক্রিয়ায় রাশিয়ার সাথেও তাদের কথা হয়ে গেছে। এর সবচেয়ে ভালো প্রমাণ এ পর্যন্ত দুটো পাওয়া যাচ্ছে। এক হলো, রাশিয়া যুদ্ধ থামাবে কি শর্তে, সে কথাটা আবার এক রাশিয়ান মুখপাত্রকে দিয়ে স্পষ্ট করে বলানো। মুখপাত্র স্পষ্ট করে তিন শর্তের কথা বলেছেন, যেটা আগেও রাশিয়া-ফ্রান্স আলোচনায় পুতিন স্পষ্ট করে বলেছিলেন। তবে এবার বাড়তি হলো যে, শর্ত মানলে রাশিয়া যুদ্ধ থামাবে তো? এর নিশ্চয়তাই নিশ্চিত করেন মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ। এ নিয়ে রয়টার্সের রিপোর্টের শিরোনামই স্পষ্ট। শিরোনাম হলো, “ইউক্রেনকে দেয়া শর্ত পূরণ হলেই ‘মুহূর্তের মধ্যে’ রাশিয়া থেমে যাবে- ক্রেমলিন।”
এ নিয়ে বাইডেন-জেলেনস্কির যে কথা হয়েছে এর প্রমাণ হলো, জেলেনস্কি সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট করে বলছেন, এক. তিনি আলোচনায় আপস করতে প্রস্তুত। দুই. রাশিয়া প্রভাবিত ইউক্রেনের দুই প্রদেশের স্বাধীনতা নিয়ে আপসে তিনি প্রস্তুত। তিনি এদের নিরাপত্তার গ্যারান্টি দিতে চেয়ে কথা বলেছেন। কিন্তু এত সহজে কেন জেলেনস্কির এই উদারতা? উত্তর আসলে খুব সোজা। কারণ ওদিকে পুতিনও আগেই জানিয়ে দিয়েছেন, ঠিক জেলেনস্কিকে ক্ষমতাচ্যুত করা বা কোনো রেজিম চেঞ্জ রাশিয়ার আক্রমণের লক্ষ্য নয়। কেবল ওই তিন দফাই তার যুদ্ধবন্ধের মূল শর্ত। তাই ‘ক্ষমতায় থাকছেন’ এ কথা শোনার পরে জেলেনস্কি জান হাতে ফিরে পেয়ে রাশিয়ার সাথে আপসে রাজি হয়েছেন।
আর পুতিনের শর্ত তিনটা হলো,
১. ‘ইউক্রেন নিরেপেক্ষ হয়ে যাবে’। এজন্য তার কনস্টিটিউশন সংশোধন করে এ কথাগুলো সেখানে ঢুকাবে। অন্য ভাষায় রাশিয়ার নিরাপত্তাবোধে অভাব সৃষ্টি করবে না, ন্যাটোর সদস্য হতেও আর চেষ্টা করবে না।
২। রাশিয়া ইউক্রেনকে অসামরিকীকরণের কাজ শেষ করবে।
৩। বিচ্ছিন্ন দুই প্রদেশ যার বাসিন্দারা এথনিক রাশিয়ান, সে দুই আবাসভূমিকে স্বাধীন দেশ বলে মানবে, ক্রিমিয়ার বিচ্ছিন্ন হয়ে রাশিয়ার সাথে যুক্ত হওয়াকেও মেনে নেবে।
এক কথায় তাহলে, এবিসির সাক্ষাৎকারটা হলো, রাশিয়া-ইউক্রেন কী কী ব্যাপারে আপস করবে এরই আগাম প্রতিশ্রুতি বিনিময়ের সাক্ষাৎকার। এসব বক্তব্যের ভিত্তিতে এখন রাশিয়া-ইউক্রেন বসে ফাইনাল খুঁটিনাটি চুক্তিপত্র ঠিক করে নেবে। অতএব কেস ফরফিট এবং যুদ্ধ থামার পথে।
তাহলে কী বাইডেনের অবরোধ এখন উঠে যাবে?
সরাসরি বললে, বাইডেন আশা করে আছেন এটাই সেই জায়গা। কিন্তু তাতে এখন ইউক্রেন রাশিয়ার সাথে কি আরো খারাপ কোনো চুক্তি করে রাশিয়ার ভিতর ঢুকে গেল কিনা সেদিকে বাইডেনের কোনো আগ্রহ নেই। তিনি চেয়েছিলেন রাশিয়ার ওপর অবরোধ জারি করতে- এখন তাই তিনি সেখানেই মনোযোগ দিতে চান। কিন্তু অন্তত এখানে কি বাইডেনের আশা পূরণ হবে?
সকালকে দেখলেই বুঝা যায় যে, দিনের বেলায় বাকি সময়ে আর কী হবে। এই তত্ত্ব-অনুসারে এইবার ইউরোপ একেবারে পিছটান দিয়েছে। তারা বাইডেনের হাত ছেড়ে দিয়েছে ইতোমধ্যে। কিভাবে?
ইইউ-এর প্রভাবশালী নীতিনির্ধারক ধরা হয় ফ্রান্স ও জার্মানিকে। মানে এদের প্রভাবকে। ইতোমধ্যে জার্মানি, ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডস পরিষ্কার করে জানিয়ে দিয়েছে, রাশিয়ান তেল ও গ্যাস ছাড়া তারা চলতে পারবে না। জার্মান ডয়েচ ভেলের বরাতে ঢাকার এক বাংলা পত্রিকা রিপোর্টের শিরোনাম, ‘রাশিয়ার তেল-গ্যাসে নিষেধাজ্ঞা চায় যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপের অসম্মতি’। রাশিয়ান তেল-গ্যাসে এমনিতেই জার্মানির নির্ভরশীলতা প্রায় ৪৫ ভাগ। অন্য সবাইও কমবেশি নির্ভরশীল। এদিকে ডাচ ও ফরাসি সরকারপ্রধানদ্বয় যৌথ সংবাদ সম্মেলনে পরিষ্কার করে বলে দিলেন, রাশিয়ার জ্বালানি ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্য তা ‘আনসাসটেইনেবল’, মানে টেকা অসম্ভব।
সোজা ভাষায়, রাশিয়ান জ্বালানি ইস্যুতে আমেরিকা-ইইউ আলাদা আলাদা রাস্তা ধরে ফেলেছে ইতোমধ্যে। অর্থাৎ পুতিনের হুমকিটাই যেন কার্যকর যে, তিনি বলেছিলেন, আমাদের তেল না নিলে ‘ব্যারেল তিনশ ডলারে কিনতে প্রস্তুত হও’।
বাইডেন কি পোলাপান?
বাইডেন ধরে নিয়েছিলেন রাশিয়া তেল বেচতে না পারলে আর ট্রিলিয়ন ডলার সম্পদ আটকে থেকে গেলে রাশিয়ার কিছুই করার থাকবে না- সব স্তব্দ হয়ে যাবে!! অথচ, আমেরিকার একজন প্রেসিডেন্ট এসব মনগড়া অনুমানে কি চলতে পারেন? বাইডেনের অনুমান অবশ্য সত্য, সন্দেহ নাই। কিন্তু এটা ঘটনার একটা সাইড; যার অন্য সাইডের খবর নেয়া হয়নি। দুনিয়ার সব বেচাবিক্রি মানেই তা একপক্ষীয়ভাবে দেখা। কারণ যেটা বেচা সেটাই আরেক দিক থেকে কেনা। কাজেই রাশিয়া বেচতে না পারলে যেমন বিপদ প্রায় তেমনিই বিপদ জ্বালানি ক্রেতারও। বাইডেন এদিকটা দেখতেই চাননি। ফলে বাস্তবতা হলো, ক্রেতা ইইউ-এর সব সদস্যের জন্যই এটা রাশিয়ার মতোই সমান সংকটের। কথা আরো আছে। যদি ইউরোপ রাশিয়ান তেল-গ্যাস না কিনে কাতার বা অন্য কোথাও থেকে কিনতে চায় তাহলে সেই বিকল্প জ্বালানি যদি পাওয়াও যায় তবু সেটা বিপদেরই হবে। কারণ অবকাঠামো কোথায়? এটা তো পাড়ার বাজার ফেলে কারওয়ান বাজারে বাজার করতে যাওয়া নয়। গ্যাস-তেলের জন্য এখন নতুন করে বিকল্প পাইপলাইন বসাতেও তো কমপক্ষে তিন বছর লাগবে। এ ছাড়া বিনিয়োগের খরচ তোলার ব্যাপার আছে। যে তেলের দাম এতদিন আশি ডলারে আটকে রাখার কসরত চলছিল এর মাঝেই এই যুদ্ধ এটাকে ইতোমধ্যে ১১২ ডলারে নিয়ে গেছে। আর, অনুমান হলো এটা এমন চলতে থাকলে ১৫০ ডলার পর্যন্ত উঠে যেতে পারে। বাইডেনের খায়েশ পূরণ করতে চাইলে তেলের দাম পুরোনো ৮০ ডলারে ফিরে যাওয়া দূরে থাক এটা কি সত্যিই ৩০০ ডলারের দিকে যাত্রা শুরু করবে? করোনার ধাক্কা সামলাতে যেখানে সারা দুনিয়া মন্দা আর মুদ্রাস্ফীতির কবলে, সেখানে এই নতুন তেলের দামের বোঝা কয়টা দেশ সামলাতে পারবে? বাছবিচারহীন বাইডেনের এমন পদক্ষেপকেই সম্ভবত আক্কেলের অভাব বলে!
তাহলে এখন একা কে? পুতিন না বাইডেন?
আনপপুলার সিটিং প্রেসিডেন্টের উদাহরণ হবেন বাইডেন!
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com