তাইওয়ানও কি দখল করে নেবে চীন!
তাইওয়ানও কি দখল করে নেবে চীন! - ছবি : সংগ্রহ
রাশিয়া যখন থেকে ইউক্রেনে আগ্রাসনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে, তখন থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং অন্যান্য জায়গায় ডানপন্থী ভাষ্যকাররা রাশিয়ার পদক্ষেপের জন্য চীনা সমর্থন, বেইজিং ও মস্কোর মধ্যে সম্ভাব্য সমন্বয় এবং তাইওয়ানের অনুরূপ আগ্রাসনের জন্য চীনা পরিকল্পনা সম্পর্কে ভিত্তিহীন বিবৃতি দিয়েছেন। পুতিন গত মাসের ৪ ফেব্রুয়ারি বেইজিংয়ে শীতকালীন অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে চীনা নেতা শি জিন পিংয়ের সাথে দেখা করার সময় একটি পূর্ণ-স্কেল আক্রমণে তার পরিকল্পনা প্রকাশ করেছিলেন এমন কোনো জোরালো প্রমাণ নেই।
চীনারা যদি পুতিনের পরিকল্পনার কথা জানত, তাহলে নিঃসন্দেহে ইউক্রেনে তাদের কূটনৈতিক কর্মীদের এবং সেখানে কর্মরত ও অধ্যয়নরত হাজার হাজার চীনা নাগরিককে রক্ষা করার পদক্ষেপ নিত। অপর দিকে বাইডেন প্রশাসন আসন্ন আগ্রাসনের স্যাটেলাইট চিত্র ও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তার কূটনৈতিক কর্মীদের সরিয়ে নেয় এবং সমস্ত আমেরিকানদের চলে যাওয়ার আহ্বান জানায়। আজ অবধি অনেক চীনা কিয়েভে আটকা পড়ে আছেন। ২ মার্চ চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গুলিবিদ্ধ এক চীনা নাগরিকের মৃত্যুর খবরও দেয়।
পশ্চিমারা রাশিয়া ও ইউক্রেন নিয়ে ব্যস্ত থাকবে আর চীন তাইওয়ান আক্রমণ করবে। এই সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ধারণাটি যারা প্রচার করছেন তাদের মধ্যে মার্কিন প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও রয়েছেন। ট্রাম্প বিগত ২ মার্চ ফক্স বিজনেসকে বলেন, ‘চীন শিগগিরই আক্রমণ করবে’, ‘অবশ্যই চীন এটি করতে যাচ্ছে।’
ট্রাম্পের মতো অনেক বিশ্ব নেতা বিশ্বাস করেন যে চীন ইউক্রেনের সঙ্কটের সুযোগ নিয়ে তাইওয়ানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারে এবং এক ঝটকায় বিজয় অর্জন করতে পারে। অন্যরা বলছেন, আজকের ইউক্রেন আগামীকালের তাইওয়ান, আর যুদ্ধ শুরু হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানকে পরিত্যাগ করবে কিনা, ন্যাটো যুদ্ধ করতে এগিয়ে আসবে কিনা, এসব বিষয় রয়েছে। তবে সদ্য সমাপ্ত আফগানিস্তান যুদ্ধে পশ্চিমা জোট তালেবানদের যে তাড়া খেয়েছে সেটি থেকে নিঃশ্বাস নিতে আরো কিছু সময় প্রয়োজন, আর্থিক বিষয়তো রয়েছেই। কে দেবে টাকা, জোট না যুক্তরাষ্ট্র? তাই ওয়াশিংটনের জন্য না ইউক্রেন না তাইওয়ান। ইউক্রেন ও তাইওয়ানের মধ্যে পার্থক্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক কৌশল এবং চীনের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বিষয় সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণার কারণে নানা মত ও ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে পড়ছে।
ইউক্রেন ও তাইওয়ানের অবস্থান দু’টি ভিন্ন। মার্কিন-রাশিয়া ও মার্কিন-চীন প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিজ নিজ ফ্রন্টলাইনে দাঁড়িয়ে থাকলেও, তাদের পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ভিন্ন বলেই বিশ্লেষকরা মনে করছেন। তাইওয়ানের নেতা সাই ইং-ওয়েনও মনে করেন যে, তাইওয়ান ও ইউক্রেন ভূকৌশলগত, ভৌগোলিক পরিবেশ এবং বৈশ্বিক সরবরাহ চেইন ও গুরুত্বের দিক থেকে মৌলিকভাবে ভিন্ন। আমরা জানি, রাশিয়া ও ইউক্রেন প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল, সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির পরে দু’টি দেশ সম্পূর্ণ স্বাধীন হয়ে ওঠে, কোনোটি অধীনস্থ হয়ে নয়। জাতিসঙ্ঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও তাদের দু’টি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
তাইওয়ান প্রণালীর দুই পক্ষ ৭০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিভক্ত এবং তাইওয়ান ‘গণতন্ত্রীকরণ’ হয়েছে। মূল ভূখণ্ডে এমন রাজনৈতিক অবস্থা নেই, আবার উভয় পক্ষই তাদের সম্পর্ক ছিন্ন করেনি। তাইওয়ান সার্বভৌম ও স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনে পদক্ষেপ নেয়নি এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দ্বারা স্বীকৃতও হয়নি। রাশিয়া-ইউক্রেন সম্পর্ককে আন্তর্জাতিক স্বাধীন সম্পর্ক হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তবে তাইওয়ান বিধি সম্মতভাবে স্বাধীনতা অর্জন করতে সক্ষম হবে না। তাইওয়ান প্রণালীর উভয় পক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে চীনের সম্ভাব্য গৃহযুদ্ধ দীর্ঘায়িতও হতে পারে।
তাইওয়ানে আগ্রাসনের জন্য পিএলএর পদক্ষেপের মধ্যে আকাশ, স্থল ও সমুদ্র বাহিনীর বড় কৌশলগত সমাবেশ থাকবে এবং সামরিক ও বাণিজ্যিক উপগ্রহ সেন্সরে দৃশ্যমান হবে, ঠিক যেমন ইউক্রেনের চার পাশে রাশিয়ান সামরিক বিল্ডআপ পশ্চিমা মিডিয়াতে ব্যাপকভাবে শুরু থেকে রিপোর্ট করা হয়েছিল।
পুতিন দাবি করেছেন, ইউক্রেন দখল করার কোনো পরিকল্পনা নেই- তার লক্ষ্য হচ্ছে ‘ইউক্রেনের ‘অসামরিকীকরণ ও অবমূল্যায়ন’। কিন্তু পুরো ইউক্রেন বা কিয়েভ দখল না করলে সেটি সম্ভব হচ্ছে না। এখানে দখলের সংজ্ঞাটি ভিন্ন। রাজনৈতিকভাবে পুতিন পশ্চিম-পন্থী ইউক্রেনীয় সরকারকে উৎখাত করবেন এবং একটি নতুন রাশিয়াপন্থী সরকারকে সমর্থন দিবেন যাতে ন্যাটোর পূর্ব দিকের সম্প্রসারণের হুমকি নির্মূল করা যায়। সাংস্কৃতিকভাবে, তিনি রাশিয়ান জনগণকে পুনরায় সম্পর্কিত করতে চান, সোভিয়েত যুগে আঞ্চলিক সমস্যাগুলোর ‘ভুল সংশোধন’ করতে চান। আরো একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ; যুদ্ধ-পরবর্তী ইউরোপীয় নিরাপত্তা কাঠামো পুতিনের আমলে অনেক পরিবর্তিত হবে। তিনি অনেক নতুন শর্ত দিবেন যা পশ্চিমাদের হজম করতে বেশ কষ্টকর হবে।
‘গণতন্ত্র সম্মেলন’ এবং বেইজিং শীতকালীন অলিম্পিকের সময় পশ্চিমাদের ‘অবরোধ’ ও একঘরে রাখার কারণে রাশিয়ার সাথে চীন তাদের জোটকে আপগ্রেড করেছে। ভারতীয় মিডিয়ায় প্রকাশ, ইউক্রেনে হামলার আগে পুতিন ৪০ বারের বেশি চীনের প্রেসিডেন্ট শির সাথে আলাপ করেছিলেন। চীন সর্বদা আঞ্চলিক অখণ্ডতার পক্ষে সমর্থন করে আসছে। পশ্চিমাদের ইউক্রেন যুদ্ধে সরাসরি না জড়ানো চীনের জন্য তেমন সুবিধার নয়। চীন এ বছর সামরিক ব্যয় ও বাজেট বৃদ্ধি করেছে যা গত দুই বছরের চেয়ে বেশি।
ইউক্রেন চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার এবং চীনা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংস্থাগুলোও ইউক্রেনে অনেক বিনিয়োগ করেছে। উপরন্তু, ইউক্রেনের বিরুদ্ধে পুতিনের সামরিক পদক্ষেপ চীনাদের ওপর যে অনন্য মানসিক প্রভাব ফেলতে পারে তা অবমূল্যায়ন করা উচিত নয়। জানা যায়, জাতীয় ঐক্য অর্জনের জন্য পুতিন দ্বিধা নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে রওনা হয়েছিলেন। চীনের মূল ভূখণ্ডে জাতীয়তাবাদের ওপর এর কী ধরনের মানসিক প্রভাব পড়বে তা চীন গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বলয়ের উদ্বিগ্ন দেশগুলো মনে করে, যদি রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ এবং তাইওয়ান প্রণালীতেও এই সময়ে যুদ্ধ শুরু হয়, তাহলে কি যুক্তরাষ্ট্র দুই ফ্রন্টের যুদ্ধ মোকাবেলা করতে সক্ষম হবে? এই উদ্বেগ অপ্রয়োজনীয়, কারণ বাইডেন প্রশাসন এখন পর্যন্ত জোর দিয়ে বলেছে যে, রাশিয়া-ইউক্রেন সঙ্কটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি সামরিকভাবে জড়িত হবে না। এখন বাইডেন ইউক্রেন ইস্যুতে ‘অর্থ দাও, অস্ত্র দাও, অবরোধ দাও’ পদ্ধতি শুরু করেছেন। রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবরোধের ক্রমিক যেন আর শেষ হচ্ছে না। রাশিয়ার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞাগুলো বাণিজ্য, অর্থ এবং শক্তি খাতে সীমাবদ্ধ।
সন্দেহাতীতভাবে, রাশিয়া ও ইউক্রেন এবং তাইওয়ান প্রণালীর মধ্যে একই সময়ে যুদ্ধ শুরু হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয় ফ্রন্টে লড়াই করা থেকে বিরত থাকার সম্ভাবনাও আছে। এটি কেবল এই কারণে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে মার্কিন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু করার জন্য সুরক্ষা ও ঝুঁকি নেয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে না।
চীনকে মার্কিন নিরাপত্তার জন্য বর্তমান ও ভবিষ্যতে মার্কিন সরকার সবচেয়ে বড় হুমকি মনে করে। রাশিয়া ভূকৌশলগত কারণে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে চীনের মতো গুরুত্বপূর্ণ নয়। তা ছাড়া বিভিন্ন ক্ষেত্রে ও স্থানে চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিযোগিতা প্রকটতর হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ইউক্রেনের চাইতে তাইওয়ান বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই তাইওয়ানকে পরিত্যাগ করার সম্ভাবনা কম। চীন-মার্কিন সম্পর্ক এবং তাইওয়ান ক্রস-স্ট্রেইট সম্পর্ক একই সাথে খারাপ হয়েছে। তাইওয়ান প্রণালীতে সঙ্কট সর্বদা থাকবে বলে মনে হয় তবে যুদ্ধ আসন্ন নয়।
বর্তমানে, চীনের প্রধান লক্ষ্য অভ্যন্তরীণ সম্পদ- শক্তি বৃদ্ধি এবং তাড়াহুড়ো করে তাইওয়ানের সাথে একীভূতকরণ নয়। তাইওয়ান প্রণালী নিয়ে চীন সরকারের অবস্থান দীর্ঘদিন ধরে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং রাশিয়া-ইউক্রেন সঙ্ঘাতের কারণে এর কোনো পরিবর্তন হয়নি। একইভাবে চীন তার নিজস্ব উপায়ে ক্রস-স্ট্রেইট সম্পর্ক পরিচালনা করছে। যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে তাইওয়ানের সাথে যুদ্ধ পরিচালনার সুযোগটি চীন গ্রহণ করবে না মর্মে প্রতিভাত হচ্ছে। বেইজিং তাইওয়ানে শান্তিপূর্ণ একীভূতকরণ চায়। বেইজিং মনে করে যে, সময় এবং শক্তি উভয়ই তার পক্ষে রয়েছে তাড়াহুড়া করে একীভূত করার জন্য অভ্যন্তরীণ বা বাহ্যিক কোনো চাপ নেই।
তাইওয়ান প্রণালীতে যুদ্ধ শুরু হলে বা যুদ্ধ শুরু করতে চীন কোনো উসকানিদাতা হবে না মর্মে চীন বার্তা দিয়েছে। মার্কিন কৌশলীরা অনেকে মনে করেন, মার্কিন সরকারের তাইওয়ান প্রণালীতে কোনো ‘কৌশলগত অস্পষ্টতা’ নেই বিধায় ‘কৌশলগত স্বচ্ছতা’র নীতি থাকা উচিত। তাইওয়ান প্রণালীতে যদি যুদ্ধ শুরু হয়, তাহলে পিপলস লিবারেশন আর্মি বা পিএলএ মার্কিন সেনাদের হস্তক্ষেপকে আবশ্যিকভাবে মোকাবেলা করবে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো কৌশলগত অবস্থান দ্বারা প্রভাবিত হবে না। অন্যভাবে বলা যায়, একবার পিএলএ তাইওয়ানকে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিলে, কোনো বাহ্যিক শক্তি এটিকে প্রতিরোধ করতে সক্ষম হবে না। তা সত্ত্বেও, বেশির ভাগ মানুষ তাইওয়ান প্রণালীর উভয় পাশে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশ- তাইওয়ান প্রণালীতে যুদ্ধ চায় না।
পুতিন বলেছেন, ইউক্রেন ও রাশিয়ার লোক ‘একই মানুষ’, কিয়েভ প্রশাসন তাদের ব্রেনওয়াশ করেছে। ৩ মার্চ ভাষণে তিনি এ কথা বলেন। ‘ওয়ান পিপল’ নিয়ে শুধু এখন নয়, গত বছরের জুলাই মাসেই মূলত পুতিন ‘রাশিয়ান ও ইউক্রেনীয়দের ঐতিহাসিক ঐক্য’ শীর্ষক একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন যে, রাশিয়ান ও ইউক্রেনীয়রা ‘এক জাতি’ ও ‘একক সমগ্র’-এর অন্তর্গত। এটি পুতিনের ভেতরের ইচ্ছাকে প্রতিফলিত করেছে। তিনি ইউক্রেনকে একীভূত করার জন্যই আগ্রাসন চালিয়েছেন বলা হচ্ছে। অপর দিকে চীনও মনে করে, তাইওয়ান ও চীন এক। তাইওয়ানের মূল ভূখণ্ডে ফিরে যাওয়া উচিত।’ তাইওয়ানের অনেক লোক যুদ্ধ চায় না। ‘একই মানুষ’ ও ‘এক চীন’ নীতির ফলে উভয়েই মূল জায়গায় ফিরে যাবে। এই ‘এক তত্ত্বের’ বিষয়টি বিশ্বব্যাপী ভূরাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে। ‘বিশ্বসভা’ তাইওয়ানকে স্বাধীন দেশ হিসেবে ঘোষণা দেয়নি। সেদিক দিয়ে তাইওয়ানের অবস্থা আরো বেশি নড়বড়ে। সমালোচকরা বলেছেন, ওয়াশিংটনের গণতন্ত্র সম্মেলনে বিশ্বের সব দেশকে দাওয়াত দেয়া উচিত ছিল, চীন ও রাশিয়াসহ্। সেখানে গণতন্ত্রের বিষয়গুলো, সুযোগ ও সৌন্দর্যগুলো সবার কাছে বিকশিত করা যেত। তা না করে বিশ্বের বড় বড় দু’টি দেশ ও কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ কিছু দেশকে বাদ দিয়ে বিভাজন তৈরি করা হয়েছে এবং তাইওয়ানকে বিশেষভাবে আমন্ত্রণ জানিয়ে চীনের সাথে সম্পর্কের রোষানলকে অহেতুক প্রজ্জ্বলিত করা হয়েছে।
ইউক্রেন সঙ্ঘাত তাইওয়ান ক্রস-স্ট্রেইট সম্পর্কের জন্য একটি সতর্কতা জারি করেছে : শান্তি মূল্যবান এবং যুদ্ধ বিপজ্জনক। তাইওয়ান প্রণালীর উভয় দিকের সরকারগুলোর জন্য, সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটি হলো, কোনো ভুল হিসাব-নিকাশকে এড়ানো, ফেইক নিউজ এড়ানো এবং ভুল কোনো বিষয় শুধরে নিয়ে পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ রাখা। এ কাজের জন্য শুধু যুক্তরাষ্ট্র বা চীন নয়, তাইওয়ানের বর্তমান সরকারকে বেশি আন্তরিক হতে হবে। ব্যক্তিগত স্বার্থ বা দলগত স্বার্থকে বাদ দিয়ে বৃহত্তর কল্যাণের মাঝে ফিরে যেতে হবে। তাইওয়ান প্রণালীর উভয় পক্ষের জনগণ প্রজ্ঞার সাথে তাদের মতপার্থক্যের সমাধান করবে এবং যুদ্ধ থেকে অনেক দূরে থাকবে এটাই সবার কাম্য।
এমনো সম্ভাবনা নেই যে চীন, পরে তাইওয়ানে আক্রমণ শুরু করবে, যখন ইউক্রেনের সঙ্কট কোনোভাবে সমাধান হয়ে যায় বা কোনোভাবে ‘হিমায়িত’ হয়। চীনা নেতারা ভালোভাবেই জানেন যে, তাইওয়ানে আগ্রাসন ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের চেয়ে অনেক বেশি কঠিন হবে। কারণ তাইওয়ানকে মূল ভূখণ্ড থেকে শত শত মাইল জলরাশি আলাদা করে রেখেছে। যদি চীনা বাহিনী কোনোভাবে তাইওয়ানের ওপর উভচর আক্রমণ পরিচালনা করে তবে তারা সম্ভবত ইউক্রেনে রাশিয়ান বাহিনীর তুলনায় আরো তীব্র প্রতিরোধের মুখোমুখি হবে, আন্তর্জাতিক ক্ষোভের সৃষ্টি করবে, কঠোর নিষেধাজ্ঞা পড়বে এবং মার্কিন হস্তক্ষেপের বড় সম্ভাবনাতো রয়েছেই, তার ওপর কোয়াড জোট ও অকাস জোট এগিয়ে আসবে।
যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমারা পুতিনের ‘বিশেষ সামরিক অভিযানের’ তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ন্যাটো কেউই এই পরিস্থিতিকে রাশিয়ার মুখোমুখি সঙ্ঘাতে পরিণত করতে চায় না, তবে পশ্চিমাদের কঠোর নিষেধাজ্ঞাগুলো রাশিয়াকে নানাভাবে দুর্ভোগ পোহাবে। এই নিষেধাজ্ঞায় ইউরোপও ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করেছে খুব তাড়াতাড়ি। রাশিয়া-ইউক্রেন সঙ্কট যদি আরো বেড়ে যায়, তাহলে রাশিয়াকে মূল্য দিতে হবে। রুশ পর্যবেক্ষকরা বলছেন, গত জুলাই মাসে যখন প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল, তখন তা মূলত অস্ত্রের আহ্বান ছিল। পুতিনকে ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হবে, ইউক্রেন সঙ্কটকে আশাব্যঞ্জক বলে মনে হচ্ছে না এবং এটি এমন একটি যুদ্ধ যা সবেমাত্র শুরু হয়েছে।
এই সপ্তাহের মধ্যে ইউক্রেন পরিস্থিতি আরো বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে পুতিনের পিয়ানো বাজানোর একটি ভিডিও ক্লিপ উইচ্যাট মোমেন্টেসে প্রকাশিত হয়, পুতিন শক্ত ও নরম বোঝানোর জন্য ভিডিওটি ছড়ানো হয়েছে। পুতিন জুডো, তাইকোয়ান্ডো, স্কিইং, সাঁতার ও আইস হকির মতো খেলাধুলায় পারদর্শী এবং রাশিয়ার সুদর্শন ব্যক্তি হিসেবেও একাধিকবার ভোট পেয়েছেন। তিনি একজন প্রেমিকও, সবই চমকপ্রদ! এই প্রথম বিশ্ব পুতিনের নৃতাত্ত্বিকতার শক্তি এবং তীব্রতা খুব কাছ থেকে দেখতে পেয়েছে। তিনি যখন বাইডেনকে ইউক্রেন যুদ্ধ সম্পর্কে বলেন, ‘এই যুদ্ধের বিভীষিকা সম্পর্কে আপনার ধারণা নেই।’ তখন বুঝতে হবে পুতিন কী চান।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব ও গ্রন্থকার