ঘটনা যখন তাইওয়ান প্রণালীতে
তাইওয়ান প্রণালী - ছবি : সংগ্রহ
তাইওয়ান প্রণালীতে যুদ্ধ শুরু হলে বা যুদ্ধ শুরু করতে চীন কোনো উসকানিদাতা হবে না মর্মে চীন বার্তা দিয়েছে। মার্কিন কৌশলীরা অনেকে মনে করেন, মার্কিন সরকারের তাইওয়ান প্রণালীতে কোনো ‘কৌশলগত অস্পষ্টতা’ নেই বিধায় ‘কৌশলগত স্বচ্ছতা’র নীতি থাকা উচিত। তাইওয়ান প্রণালীতে যদি যুদ্ধ শুরু হয়, তাহলে পিপলস লিবারেশন আর্মি বা পিএলএ মার্কিন সেনাদের হস্তক্ষেপকে আবশ্যিকভাবে মোকাবেলা করবে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো কৌশলগত অবস্থান দ্বারা প্রভাবিত হবে না। অন্যভাবে বলা যায়, একবার পিএলএ তাইওয়ানকে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিলে, কোনো বাহ্যিক শক্তি এটিকে প্রতিরোধ করতে সক্ষম হবে না। তা সত্ত্বেও, বেশির ভাগ মানুষ তাইওয়ান প্রণালীর উভয় পাশে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশ- তাইওয়ান প্রণালীতে যুদ্ধ চায় না।
পুতিন বলেছেন, ইউক্রেন ও রাশিয়ার লোক ‘একই মানুষ’, কিয়েভ প্রশাসন তাদের ব্রেনওয়াশ করেছে। ৩ মার্চ ভাষণে তিনি এ কথা বলেন। ‘ওয়ান পিপল’ নিয়ে শুধু এখন নয়, গত বছরের জুলাই মাসেই মূলত পুতিন ‘রাশিয়ান ও ইউক্রেনীয়দের ঐতিহাসিক ঐক্য’ শীর্ষক একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন যে, রাশিয়ান ও ইউক্রেনীয়রা ‘এক জাতি’ ও ‘একক সমগ্র’-এর অন্তর্গত। এটি পুতিনের ভেতরের ইচ্ছাকে প্রতিফলিত করেছে। তিনি ইউক্রেনকে একীভূত করার জন্যই আগ্রাসন চালিয়েছেন বলা হচ্ছে। অপর দিকে চীনও মনে করে, তাইওয়ান ও চীন এক। তাইওয়ানের মূল ভূখণ্ডে ফিরে যাওয়া উচিত।’ তাইওয়ানের অনেক লোক যুদ্ধ চায় না। ‘একই মানুষ’ ও ‘এক চীন’ নীতির ফলে উভয়েই মূল জায়গায় ফিরে যাবে। এই ‘এক তত্ত্বের’ বিষয়টি বিশ্বব্যাপী ভূরাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে। ‘বিশ্বসভা’ তাইওয়ানকে স্বাধীন দেশ হিসেবে ঘোষণা দেয়নি। সেদিক দিয়ে তাইওয়ানের অবস্থা আরো বেশি নড়বড়ে। সমালোচকরা বলেছেন, ওয়াশিংটনের গণতন্ত্র সম্মেলনে বিশ্বের সব দেশকে দাওয়াত দেয়া উচিত ছিল, চীন ও রাশিয়াসহ্। সেখানে গণতন্ত্রের বিষয়গুলো, সুযোগ ও সৌন্দর্যগুলো সবার কাছে বিকশিত করা যেত। তা না করে বিশ্বের বড় বড় দু’টি দেশ ও কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ কিছু দেশকে বাদ দিয়ে বিভাজন তৈরি করা হয়েছে এবং তাইওয়ানকে বিশেষভাবে আমন্ত্রণ জানিয়ে চীনের সাথে সম্পর্কের রোষানলকে অহেতুক প্রজ্জ্বলিত করা হয়েছে।
ইউক্রেন সঙ্ঘাত তাইওয়ান ক্রস-স্ট্রেইট সম্পর্কের জন্য একটি সতর্কতা জারি করেছে : শান্তি মূল্যবান এবং যুদ্ধ বিপজ্জনক। তাইওয়ান প্রণালীর উভয় দিকের সরকারগুলোর জন্য, সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটি হলো, কোনো ভুল হিসাব-নিকাশকে এড়ানো, ফেইক নিউজ এড়ানো এবং ভুল কোনো বিষয় শুধরে নিয়ে পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ রাখা। এ কাজের জন্য শুধু যুক্তরাষ্ট্র বা চীন নয়, তাইওয়ানের বর্তমান সরকারকে বেশি আন্তরিক হতে হবে। ব্যক্তিগত স্বার্থ বা দলগত স্বার্থকে বাদ দিয়ে বৃহত্তর কল্যাণের মাঝে ফিরে যেতে হবে। তাইওয়ান প্রণালীর উভয় পক্ষের জনগণ প্রজ্ঞার সাথে তাদের মতপার্থক্যের সমাধান করবে এবং যুদ্ধ থেকে অনেক দূরে থাকবে এটাই সবার কাম্য।
এমনো সম্ভাবনা নেই যে চীন, পরে তাইওয়ানে আক্রমণ শুরু করবে, যখন ইউক্রেনের সঙ্কট কোনোভাবে সমাধান হয়ে যায় বা কোনোভাবে ‘হিমায়িত’ হয়। চীনা নেতারা ভালোভাবেই জানেন যে, তাইওয়ানে আগ্রাসন ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের চেয়ে অনেক বেশি কঠিন হবে। কারণ তাইওয়ানকে মূল ভূখণ্ড থেকে শত শত মাইল জলরাশি আলাদা করে রেখেছে। যদি চীনা বাহিনী কোনোভাবে তাইওয়ানের ওপর উভচর আক্রমণ পরিচালনা করে তবে তারা সম্ভবত ইউক্রেনে রাশিয়ান বাহিনীর তুলনায় আরো তীব্র প্রতিরোধের মুখোমুখি হবে, আন্তর্জাতিক ক্ষোভের সৃষ্টি করবে, কঠোর নিষেধাজ্ঞা পড়বে এবং মার্কিন হস্তক্ষেপের বড় সম্ভাবনাতো রয়েছেই, তার ওপর কোয়াড জোট ও অকাস জোট এগিয়ে আসবে।
যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমারা পুতিনের ‘বিশেষ সামরিক অভিযানের’ তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ন্যাটো কেউই এই পরিস্থিতিকে রাশিয়ার মুখোমুখি সঙ্ঘাতে পরিণত করতে চায় না, তবে পশ্চিমাদের কঠোর নিষেধাজ্ঞাগুলো রাশিয়াকে নানাভাবে দুর্ভোগ পোহাবে। এই নিষেধাজ্ঞায় ইউরোপও ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করেছে খুব তাড়াতাড়ি। রাশিয়া-ইউক্রেন সঙ্কট যদি আরো বেড়ে যায়, তাহলে রাশিয়াকে মূল্য দিতে হবে। রুশ পর্যবেক্ষকরা বলছেন, গত জুলাই মাসে যখন প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল, তখন তা মূলত অস্ত্রের আহ্বান ছিল। পুতিনকে ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হবে, ইউক্রেন সঙ্কটকে আশাব্যঞ্জক বলে মনে হচ্ছে না এবং এটি এমন একটি যুদ্ধ যা সবেমাত্র শুরু হয়েছে।
এই সপ্তাহের মধ্যে ইউক্রেন পরিস্থিতি আরো বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে পুতিনের পিয়ানো বাজানোর একটি ভিডিও ক্লিপ উইচ্যাট মোমেন্টেসে প্রকাশিত হয়, পুতিন শক্ত ও নরম বোঝানোর জন্য ভিডিওটি ছড়ানো হয়েছে। পুতিন জুডো, তাইকোয়ান্ডো, স্কিইং, সাঁতার ও আইস হকির মতো খেলাধুলায় পারদর্শী এবং রাশিয়ার সুদর্শন ব্যক্তি হিসেবেও একাধিকবার ভোট পেয়েছেন। তিনি একজন প্রেমিকও, সবই চমকপ্রদ! এই প্রথম বিশ্ব পুতিনের নৃতাত্ত্বিকতার শক্তি এবং তীব্রতা খুব কাছ থেকে দেখতে পেয়েছে। তিনি যখন বাইডেনকে ইউক্রেন যুদ্ধ সম্পর্কে বলেন, ‘এই যুদ্ধের বিভীষিকা সম্পর্কে আপনার ধারণা নেই।’ তখন বুঝতে হবে পুতিন কী চান।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব ও গ্রন্থকার