প্রিয়ঙ্কার ‘হাত’ প্রায় খালি : বিপর্যয়ের নেপথ্যে
প্রিয়ঙ্কা ও রাহুল - ছবি : সংগ্রহ
ভারতের উত্তরপ্রদেশ রাজ্যে ভোট শুরুর মাস খানেক আগে এক সাংবাদিক সম্ভবত কিছুটা ব্যঙ্গ করেই একটি প্রশ্ন করেছিলেন প্রিয়ঙ্কা গান্ধি ভদ্রকে। দেশের এক প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর নাতনি তথা দেশের অপর সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কন্যার কাছে তিনি জানতে চেয়েছিলেন, উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে মুখ্যমন্ত্রী কে হবেন?
প্রশ্নটি কূট। কারণ, কংগ্রেসের অতিবড় সমর্থকও মনে করেননি, উত্তরপ্রদেশ দখল করবে কংগ্রেস। বিশেষত সেই কংগ্রেস, যাদের গত ৩০ বছর ধরে ছুঁয়েও দেখেনি উত্তরপ্রদেশের ৩১৫টি বিধানসভা কেন্দ্রের জনতা। গত ৪০ বছরে যে রাজনৈতিক দলের জেতা আসনের সংখ্যা ৩৫-এর ঘরও পেরোয়নি। তবে প্রিয়ঙ্কা প্রশ্ন শুনে অপ্রস্তুত হননি। বরং কিছুটা ডাঁটের সঙ্গেই বলেছিলেন, ‘‘কংগ্রেসের পোস্টারে আর কোনো নেতার ছবি দেখতে পাচ্ছেন কি? উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রীর মুখ আমিই!’’
যা নিয়ে পরে বিস্তর পানিঘোলা হয়েছিল। প্রিয়ঙ্কা তার মতো করে ব্যাখ্যাও দিয়েছিলেন। কারণ, প্রিয়ঙ্কা-সহ কংগ্রেসের সকলেই জানতেন, ভোটের ফলপ্রকাশের পর ওই প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক থাকবে না। থাকেওনি।
২০১৯ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে সক্রিয় কংগ্রেস রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিলেন প্রিয়ঙ্কা। তবে উত্তরপ্রদেশের রাজনীতিতে তিনি নেপথ্য কারিগরের ভূমিকা পালন করে আসছেন তার অনেক আগে থেকেই। ২০১৭ সালে উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা ভোটের আগে কংগ্রেস আর সমাজবাদী পার্টি (সপা) যে জোট বেঁধে লড়তে রাজি হয়েছিল এবং কংগ্রেসকে ১৪৪টি আসন ছেড়ে দিয়েছিল, তার কৃতিত্ব প্রিয়ঙ্কারই। অসমর্থিত সূত্রের খবর, তখন সপা প্রধান অখিলেশ যাদবের স্ত্রী ডিম্পলের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কথা বলেছিলেন প্রিয়ঙ্কা। পরে অখিলেশের সঙ্গেও কথা হয়েছিল তার। তবে গোটাটাই ছিল আড়ালে।
২০১৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনে রাহুল গান্ধিকে সামনে রেখেই লড়েছিল কংগ্রেস। পেয়েছিল সাতটি আসন। প্রিয়ঙ্কাও পরে স্বীকার করে নিয়েছিলেন, জোট বাঁধা ভুল হয়েছে। সেই ভুলের পাঁচ বছর পর এ বার তাকে সামনে রেখে উত্তরপ্রদেশে একা লড়েছিল কংগ্রেস। গত ৩০ বছরে এই প্রথম উত্তরপ্রদেশের ৪০৩টি বিধানসভা কেন্দ্রেই প্রার্থী দিয়েছিল দল। কিন্তু তাতে কি কিছু বদলাল?
বদলাল। গতবারের চেয়েও উত্তরপ্রদেশে আসন কমে গেল কংগ্রেসের। অন্তত প্রাথমিক গণনার ছবি তেমনই বলছে। বেলা ১২টার পর দেখা যাচ্ছে কংগ্রেস তিন বা চারটি আসনে এগিয়ে রয়েছে। অর্থাৎ, উত্তরপ্রদেশের রাজনীতিতে কংগ্রেস আরও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে।
যদিও এ বার প্রচারে খামতি রাখেননি প্রিয়ঙ্কা। আংশিক দায়িত্ব ছেড়ে ২০২০ সালে উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেসের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। গত দু’ বছরে তাকে বহুবার দেখা গিয়েছে উত্তরপ্রদেশে। বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে ওঠা একটি ক্ষীণ আওয়াজকেও অবহেলা করেননি। প্রত্যেকবার সশরীরে পৌঁছে গিয়েছেন অশান্তির কেন্দ্রভূমিতে। প্রতিটি ঘটনায় ধারাবাহিক টুইট করেছেন। যোগী আদিত্যনাথের সরকারের বিরুদ্ধে প্রিয়ঙ্কার কংগ্রেস ক্রমশ নতুন রণকৌশল তৈরি করেছে। যোগীর রাজ্যে যখন একে একে উন্নাও, হাথরস, গোরক্ষপুরে ধর্ষণের মতো অপরাধের ঘটনা ঘটছে, তখন মহিলাদের নিরাপত্তাকেই নিজের ‘রাজনৈতিক হাতিয়ার’ বানিয়েছিলেন প্রিয়ঙ্কা। তার ‘ম্যায় লড়কি হুঁ, লড় সকতি হুঁ’ স্লোগানও নাকি সাড়া ফেলেছিল উত্তরপ্রদেশের মহিলামহলে। তখন প্রিয়ঙ্কার প্রচারে উদ্বুদ্ধ হয়ে অনেক মহিলা কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিলেন। যাঁরা উত্তরপ্রদেশের ভোটে কংগ্রেসের টিকিটও পেয়েছেন।
প্রিয়ঙ্কা অবশ্য আগেই বলে দিয়েছিলেন, ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসা তার লক্ষ্য নয়। তার উদ্দেশ্য, মানুষের সমস্যার কথা বলা। যা তিনি করবেন। তার দল করবে। দরকার হলে যারা তার লড়াইয়ে একমত হবেন, তাদের সমর্থনও করবেন। প্রিয়ঙ্কার কথায় তখনই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, জয়ের কথা ভাবছে না কংগ্রেস। বস্তুত, এককালে নেহরু-গান্ধির অনুগত বলে পরিচিত উত্তরপ্রদেশে যেখানে ৪০ বছর ধরে কোনও ছাপ ফেলতে পারেনি কংগ্রেস, সেখানে ২০২২ সালে তারা রাতারাতি ২০২টি আসন পেয়ে যাবে, এমন ভাবেনওনি প্রিয়ঙ্কা। কিন্তু জয়ই যদি লক্ষ্য না হয়, তবে কংগ্রেসের সামনে এই মুহূর্তে সম্ভাবনাময়ী নেত্রী বলে যে প্রিয়ঙ্কার নাম উঠে আসছে, তাঁকে উত্তরপ্রদেশের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল কেন? কীসের আশায়!
জবাব হলো, ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে নজর রেখে যে উত্তরপ্রদেশের ভোটের ফলকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছিল, সেখানে প্রিয়ঙ্কাকে সামনে রেখে আসন কিছুটা বাড়িয়ে নেয়াই লক্ষ্য ছিল কংগ্রেসের। সেদিক দিয়ে উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা ভোট প্রিয়ঙ্কার কাছে ‘লিটমাস টেস্ট’ও ছিল বটে। সেই পরীক্ষায় ‘ব্যর্থ’ই ইন্দিরা গান্ধির নাতনি এবং রাজীব গান্ধির কন্যা।
এখন দেখার, উত্তরপ্রদেশ-উত্তর সময়ে কংগ্রেসের অন্দরে ‘বিক্ষুব্ধ’ নেতারা আবার মুখ খুলতে শুরু করেন কি না। দেখার এ-ও যে, ভোটের এই শোচনীয় ফলাফলের পর প্রিয়ঙ্কা নিজে কী বলেন। আদৌ কিছু বলেন কি না।
সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা