কেন ইউক্রেনে থমকে গেল রাশিয়ার বিশাল বহর
কেন ইউক্রেনে থমকে গেল রাশিয়ার বিশাল বহর - ছবি : সংগ্রহ
ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ প্রায় দু সপ্তাহ হতে চলল। কয়েকদিন ধরেই রাশিয়ান সামরিক বাহিনীর একটি বিশাল কনভয় ইউক্রেনের রাজধানী কিভের বাইরে মোতায়েন রয়েছে। সেটি প্রায় কিভ থেকে ১৫ মাইল (২৫ কিলোমিটার) দূরে। যেকোনো উপায়ে কিভ দখল করা রাশিয়ার টার্গেট বলেই মনে হচ্ছে।
কনভয়ে ট্যাঙ্ক, সেলফ প্রপেলড আর্টিলারি, ইনফ্যান্ট্রি ফাইটিং ভেহিকলস রয়েছে। তবে, যুদ্ধ যতই এগিয়েছে ততই রুশ বাহিনী কয়েকটি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। জ্বালানিসহ সেনাদের খাদ্যের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। রুশ সেনা কনভয়ের ফ্রন্টলাইনে থাকা একটি অংশের উপর ইউক্রেনীয় সেনারা হামলা চালাতে সক্ষম হয়েছে।
এরপরই বাকি কনভয়টি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে গিয়েছে বা গতি স্লথ হয়ে গিয়েছে। পশ্চিমা বিশ্লেষকদের মতে, রাশিয়ানরা মূলত বিমান হামলা থেকে কনভয়কে রক্ষা করেছে। বিশেষজ্ঞরা অনেকেই রাশিয়ার যুদ্ধ পরিকল্পনা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন।
ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অফ ওয়ার-র রাশিয়ার বিশ্লেষক ম্যাসন ক্লার্ক বলেছেন, "কনভয়ের এই ঘটনাটি রাশিয়ান সেনাবাহিনীর ত্রুটিগুলোর প্রতীক হতে পারে।
এটা বোঝা যাচ্ছে যে বিমান, স্থল এবং নৌবাহিনীকে একত্রিত করে বৃহৎ আকারের অপারেশন চালানোর ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে অনভিজ্ঞ এরা। তবে এটাও ঠিক যে রুশ বাহিনীকে বেশিদিন আটকে রাখার মতো ক্ষমতা ইউক্রেনের সেনার নেই। রাশিয়ানরা খুব সহজভাবে ইউক্রেনের বাহিনীকে পরাস্ত করতে সক্ষম হবে এবং কিয়েভ দখল করবে।"
কনভয় কোথায় এবং সমস্যা কী হয়েছে?
উত্তরে প্রিবিস্ক থেকে আন্তোনভ বিমানবন্দরের কাছে দক্ষিণ প্রান্ত পর্যন্ত ৬৫ কিলোমিটার (৪০ মাইল) পর্যন্ত প্রসারিত এই কনভয়টি যুদ্ধের শুরুতে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। কিন্তু এই সপ্তাহে কনভয়টির যাত্রা থেমে গিয়েছে।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনগুলিতে বলা হয়েছে, জ্বালানি এবং খাদ্যের ঘাটতির কারণেই এটা হয়েছে। একজন উর্ধ্বতন মার্কিন প্রতিরক্ষা কর্তা বলেছেন যে ইউক্রেনীয় সেনারা জ্যাভলিন অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক ক্ষেপণাস্ত্রসহ মর্টার হামলা চালাচ্ছে কনভয় লক্ষ্য করে। কনভয়ের সামনে থাকা যানবাহনগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার কারণে গোটা কনভয়টি অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। এছাড়াও, কাদামাটি রাশিয়ানদের জন্য রাস্তার বাইরে যাওয়া কঠিন করে তুলেছে, চাইলেও তারা অন্যদিকে যেতে পারছে না।
পেন্টাগনের প্রেস সেক্রেটারি জন কিরবি বলেছেন, কনভয়ের পাশাপাশি উত্তর থেকে কিভের দিকে অগ্রসর হওয়া রাশিয়ান সেনারা অনেকাংশে স্থবির হয়ে পড়েছে। রাশিয়ার সেনারা সম্ভবত এই জাতীয় সমস্যা বা ইউক্রেনীয় সেনাদের প্রতিরোধের পরিমাণ অনুমান করেনি।
ইউক্রেনের সেনারা কী করছে?
এই প্রশ্ন উঠছে যে হাইওয়েতে দাঁড়িয়ে থাকা রাশিয়ার সেনা কনভয়কে কেন ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী ধ্বংস করেনি। তুলনামূলকভাবে উন্মুক্ত ভূখণ্ডে সামরিক যানের এত দীর্ঘ সময় ধরে থাকলে বিমান হামলার ঝুঁকি থাকে।
তবে কনভয়ের উপর যেকোনো ইউক্রেনীয় হামলা সীমিত হতে পারে, কারণ কনভয়ে বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে। ইউক্রেনের ক্ষেপণাস্ত্র কনভয়ের সামনের দিকে এবং অন্যান্য বিক্ষিপ্ত স্থানে যানবাহনকে আঘাত করেছে। তবে কনভয়ের উপরে বিমান হামলা চালানো কঠিন। আর সেই কারণেই হয় তো ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী আপাতত ঝুঁকিতে থাকা প্রধান শহরগুলোকে রক্ষা করার দিকে মনোনিবেশ করেছে।
এটা কি রাশিয়ার জন্য গুরুতর সমস্যা?
মার্কিন কর্মকর্তারা যেকোনো সুস্পষ্ট সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সতর্ক করেছেন যে কনভয় সমস্যা রাশিয়ানদের জন্য একটি ধাক্কার ইঙ্গিত দেয়। এটা স্পষ্টতই কিভের উপর রাশিয়ার আক্রমণকে আপাতত স্থগিত করেছে।
মার্কিন কর্তারা বিশ্বাস করেন যে রাশিয়ার এই ধরনের বিপত্তিগুলো কাটিয়ে উঠবে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন যে রাশিয়া স্পষ্টতই ক্রমাগত লজিস্টিক এবং সরবরাহ সমস্যার কারণে হতাশ হয়েছে, সেনাদের খাদ্য ও যানবাহনের জ্বালানি ফুরিয়ে গেছে। তবে এটাও হতে পারে যে কিয়েভ দখলের পরিকল্পনায় বদল ঘটিয়ে, সবকিছু গুছিয়ে নিতে রুশ সেনারা ইচ্ছাকৃতভাবে সময় কিনছে। কিয়েভ দখলে নামার আগে রণকৌশল বদলাতে পারে রাশিয়া।
পর্যবেক্ষকরা আরো লক্ষ্য করেছেন মূলত ইউক্রেনের দক্ষিণে রাশিয়ান সেনারা বেশি সাফল্য পাচ্ছে। তারা ইতিমধ্যেই গুরুত্বপূর্ণ কৃষ্ণ সাগর বন্দর, দক্ষিণের শহর খারসন দখলের দাবি করেছে।
স্থানীয় ইউক্রেনীয় কর্তারাও সরকারি সদর দফতর দখলের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। রাশিয়ার সেনারা এখন আজভ সাগরের কৌশলগত বন্দর মারিউপোল দখলের পথে তারা। ইতিমধ্যেই বাইরে থেকে এই বন্দর শহরটিকে অবরুদ্ধ করে দিয়েছে রুশ বাহিনী। কয়েকদিন ধরেই সেখানে আক্রমণ চালাচ্ছে রুশ বাহিনী। নির্বিচারে বোমাবর্ষণ করছে তারা, আটকে দেয়া হয়েছে শহর থেকে বেরনোর সমস্ত পথও।
তবুও, কনভয়ের সমস্যাগুলোর ব্যাপ্তি রাশিয়ানরা আক্রমণের জন্য পর্যাপ্তভাবে প্রস্তুত ছিল কি না তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। যেকোনো স্থল অভিযানের মূলনীতি হলো সেনা, অস্ত্র, খাদ্য, জল এবং জ্বালানির মতো মৌলিক জিনিসগুলোর অবিরাম সরবরাহ নিশ্চিত করা।
বৃহস্পতিবার, ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমমানুয়েল ম্যাক্রোঁ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে প্রায় দেড় ঘণ্টা কথা বলেছেন। ইউক্রেনে সামরিক অভিযান পরিকল্পনা অনুসারেই চলছে বলে ম্যাক্রোঁকে জানিয়ে দিয়েছেন পুতিন।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে কী কী অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে?
যুদ্ধবিমান এবং মিসাইল : রাশিয়ান সামরিক বাহিনী যুদ্ধবিমান এবং কালিব্র ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে ইউক্রেনের সামরিক স্থাপনাগুলিতে আঘাত হানার জন্য। কালিব্র একটি নির্ভুল অস্ত্র, তাই ইউক্রেনীয় সামরিক স্থাপনা এবং সরকারি ভবনগুলি আবাসিক এলাকার কাছাকাছি অবস্থিত হওয়াতে অসামরিক নাগরিকদের মৃত্যু হচ্ছে। একই কথা প্রযোজ্য রাশিয়ান যুদ্ধবিমান থেকে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রের ক্ষেত্রেও।
মূল লক্ষ্যগুলিকে আঘাত করার জন্য রাশিয়ান সামরিক বাহিনী ইস্কান্দার ক্ষেপণাস্ত্রও ব্যবহার করেছে, যার রেঞ্জ ৫০০ কিলোমিটার পর্যন্ত এবং অনেক বেশি শক্তিশালী ওয়ারহেড বহন করতে পারে এই ক্ষেপণাস্ত্র। বড় ভবন এবং কিছু সুরক্ষিত স্থাপনা ধ্বংস করতে পারে এটি। কয়েকটি ইস্কান্দার ক্ষেপণাস্ত্র রাশিয়ার মিত্র বেলারুশের অঞ্চল থেকে ছোড়া হয়েছিল বলে জানা গিয়েছে। ইউক্রেনে হামলা চালানোর জন্য বেলারুশের মাটি ব্যবহার করছে মস্কো।
রকেট এবং আর্টিলারি : ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি ভলোদিমির জেলেনস্কি এবং অন্য কর্মকর্তারা রাশিয়ান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আবাসিক ভবন, স্কুল এবং হাসপাতালে নির্বিচারে গোলাবর্ষণের জন্য অভিযোগ করেছেন।
ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিভের ছবিগুলো দেখলেই বোঝা যাবে যে রকেট হামলায় আবাসিক ভবনগুলি কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ও যার কারণে সাধারণ নাগরিকদের মৃত্যু হয়েছে। বহু মানুষ আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে।
সোভিয়েত জমানার গ্র্যাড (হাইল), স্মারচ (টর্নেডো) এবং উরাগান (হারিকেন) একাধিক রকেট লঞ্চারগুলি সেনাবাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করতে বা সামরিক সরঞ্জামের ধ্বংস করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। রকেট লঞ্চারগুলো দিয়ে জনবহুল এলাকা হামলা হলে বহু মানুষের হতাহতের আশঙ্কা থাকে।
রাশিয়ান সামরিক বাহিনীতে শক্তিশালী আর্টিলারি ইউনিটের বিস্তৃত পরিসরও রয়েছে, যেগুলো ফুলের নামে অদ্ভুতভাবে নামকরণ করা হয়েছিল, যেমন স্ব-চালিত ২০৩-মিমি পিওনি এবং ১৫২-মিমি হাইসিন্থ এবং অ্যাকাসিয়া স্ব-চালিত হাউৎজার।
মস্কো দাবি করেছে যে তারা শুধুমাত্র সামরিক ঘাঁটি এবং অবকাঠামোকে লক্ষ্য করছে। কিন্তু কিয়েভ, খারকিভ এবং ইউক্রেনজুড়ে অসংখ্য অন্যান্য শহরে অসামরিক অবকাঠামো এবং আবাসিক এলাকায় ব্যাপক ক্ষতির খবর পাওয়া গিয়েছে। রাশিয়ান কর্তারা অভিযোগ করেছেন যে ইউক্রেনীয় বাহিনী অসামরিক নাগরিকদের ঢাল হিসাবে ব্যবহার করার জন্য আবাসিক এলাকায় ভারী অস্ত্র মোতায়েন করেছে। যদিও এই দাবির পক্ষে এখন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
ইউক্রেনের অস্ত্র : ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী সোভিয়েত জমানায় নির্মিত একাধিক রকেট লঞ্চার এবং হাউইৎজারের উপর নির্ভর করেছে, এই সরঞ্জাম রাশিয়ান সামরিক বাহিনীতেও রয়েছে।
রাশিয়ার ইস্কান্দার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং কালিব্র ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের মতো অত্যাধুনিক দূরপাল্লার নির্ভুল অস্ত্র ইউক্রেনের হাতে নেই। ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীতে সোভিয়েত যুগের তোচকা-ইউ স্বল্প-পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে, যার শক্তিশালী ওয়ারহেড আছে। কিন্তু রাশিয়ান অস্ত্রের তুলনায় তা দূর্বল।
পুরনো সোভিয়েত-নির্মিত অস্ত্র ছাড়াও ইউক্রেন পশ্চিমা অস্ত্রের বড় চালান পেয়েছে, যেমন মার্কিন জ্যাভলিন অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক মিসাইল এবং স্টিংগার অ্যান্টি-এয়ারক্রাফ্ট মিসাইল।
ইউক্রেনের কর্তারা বলেছেন যে দেশটির সামরিক বাহিনী এগুলো ব্যবহার করে আক্রমণকারী রুশ বাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করেছে। যুদ্ধের আগে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী তুরস্ক থেকে কেনা বায়রাক্টার ড্রোনও ব্যবহার করেছে। কিভ একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে যাতে রাশিয়ান সামরিক কনভয়ের বিরুদ্ধে বায়রাক্টারের আক্রমণ দেখা যাচ্ছে।
সূত্র : নিউজ ১৮