ভিসা ও মাস্টার কার্ড বন্ধ, কী করবে রাশিয়া
ভিসা ও মাস্টার কার্ড বন্ধ, কী করবে রাশিয়া - ছবি : সংগ্রহ
প্রায় দু'সপ্তাহ হতে চলল। তবুও রোখা যাচ্ছে না মহাশক্তিধর রাশিয়াকে। কোনো কিছুকে আমল না দিয়ে ইউক্রেনে তাদের আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে রাশিয়া। রাশিয়ার আগ্রাসনের মাত্রা এতটাই তীব্র যে, সাময়িক যুদ্ধ বিরতি ঘোষণার মধ্যেও তাদের সামরিক আক্রমণ ইউক্রেনের প্রতি জারি রেখেছে রাশিয়ান সামরিক বাহিনী। আর তাতেই স্তম্ভিত গোটা বিশ্ব। রাশিয়ান সেনাবাহিনীর ক্রমাগত আক্রমণে দিশেহারা ইউক্রেন। তবুও নিজেদের দেশকে রক্ষা করতে শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী থেকে শুরু করে সে দেশের সাধারণ মানুষ। তবে ইতিমধ্যেই রাশিয়ান সেনার মুহুর্মুহু গুলি আর বোমা বর্ষণে নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে কয়েক লক্ষ ইউক্রেনবাসী আশ্রয় নিয়েছেন ইউক্রেনের পার্শ্ববর্তী দেশগুলিতে। এমনকী রাশিয়ার বিরুদ্ধে সমবেত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে গোটা বিশ্বের বাকি শক্তিধর দেশগুলির কাছে আবেদন জানিয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনেস্কি। কিন্তু সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে রাশিয়া কোণঠাসা করতে ইউক্রেনের ডাকে এখন পর্যন্ত কোনো দেশই সাড়া দেয়নি। তবে সামরিক শক্তি দিয়ে সাহায্য না করলেও ইতিমধ্যেই রাশিয়ার প্রতি অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে গোটা বিশ্বের প্রথম নম্বরে থাকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তাদের লক্ষ্য একটাই হাতে নয়, পাতে মারতে হবে রাশিয়কে। তাই সরাসরি যুদ্ধের বদলে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে তাদের সবক শেখাতে উদ্যোগী হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে বিশ্বের একাধিক দেশ। এরই মধ্যে আরও একধাপ এগিয়ে রাশিয়ায় ভিসা এবং মাস্টার কার্ডের লেনদেন প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ রূপে বন্ধ করল আমেরিকা ব্রিটেনসহ ইউরোপের একাধিক দেশ।
এর আগেও নেয়া হয়েছে এই পদক্ষেপ
তবে এই প্রথমবার নয়, এশিয়ার মহাশক্তিধর দেশ রাশিয়াকে উচিৎ শিক্ষা দিতে এর আগে অর্থাৎ ২০১৫ সালে ভিসা এবং মাস্টার কার্ডের পরিষেবা রাশিয়ানদের জন্য বন্ধ করে দেয় আমেরিকা। কারণ ২০১৪ সালে রাশিয়ার দ্বারা ক্রিমিয়ার প্রতি আগ্রাসনের জন্য সেবার ক্ষুব্ধ হয়েছিল আমেরিকাসহ বিশ্বের একাধিক দেশ। তবে ভিসা কিংবা মাস্টার কার্ড বন্ধের পর নিজস্ব ভাবে দেশের মানুষের আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন করতে এবং আর্থিক চাহিদা মেটাতে সেই বছর থেক ভিসা ও মাস্টার কার্ডের ওপর ভরসা না করে নিজের দেশে রাশিয়া তাদের নিজস্ব মির ব্যাংক ব্যবস্থা চালু করে । পাশাপাশি রাশিয়ার অন্যতম সহযোগী এশিয়ার আরও এক মহাশক্তিধর দেশ চিনের সহায়তা নিয়ে দেশের মানুষের আর্থিক লেনদেন প্রক্রিয়া জারি রাখতে ইউনিয়ন পে পদ্ধতি বিকল্প হিসাবে বেছে নেয় রাশিয়া সরকার। তাতে কিছুটা হলেও দেশের মানুষের আর্থিক চাহিদা মেটাতে সক্ষম হয় রাশিয়ান সরকার। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, গোটা পৃথিবীতে চিন -ই একমাত্র দেশ যে কি না তাদের নিজস্ব ইউনিয়ন পে কার্ডের মাধ্যমে সারা পৃথিবীতে ৯০ শতাংশ আর্থিক লেনদেন করতে সক্ষম। তবে আমেরিকার ও ব্রিটেনসহ ইউরোপের একাধিক দেশ রাশিয়ার দ্বারা ইউক্রেন আক্রমণের বিরোধিতায় অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি ভিসা এবং মাস্টার কার্ড পরিষেবা বন্ধ করলেও এখনও পর্যন্তই চীন তাদের ইউনিয়ন পে সিস্টেমে লেনদেন প্রক্রিয়া সম্পূর্ণরূপে জারি রেখেছে রাশিয়ায়।
গত সপ্তাহের শনিবার থেকে রাশিয়ান নাগরিকদের জন্য রাশিয়ার মধ্যে এবং এবং বাইরের দেশগুলোতে সম্পূর্ণ রূপে ভিসা এবং মাস্টার কার্ড পরিষেবা বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে আমেরিকা, ব্রিটেন সহ ইউরোপের একাধিক দেশ। তাতে অবশ্য আমল না দিয়ে রাশিয়ার নিজস্ব ব্যাঙ্কিং সিস্টেম মির- এর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ভিসা এবং মাস্টার কার্ড বন্ধ হলেও তাদের নিজস্ব কার্ড ব্যবহার করে দেশের নাগরিকরা তাদের লেনদেন যেমন, টাকা তোলা, জমা দেয়া, টাকা স্থানান্তর প্রক্রিয়া চালিয়ে যেতে পারবেন।
কিন্তু মজার ঘটনা এটাই, রাশিয়ান সরকার যতই তাদের নাগরিকদের আশ্বাস দিক না কেন গত শনিবার ভিসা এবং মাস্টার কার্ড সিস্টেম রাশিয়ানদের জন্য নিষিদ্ধ করার পরই রাশিয়ার অলিতে-গলিতে এটিএম কাউন্টারগুলোতে লম্বা ভিড় জমান সে দেশের নাগরিকরা। কারণ ওই নাগরিকদের আশঙ্কা একটাই ভিসা এবং মাস্টার বন্ধ হলে ব্যাংকে গচ্ছিত টাকার লেনদেন নিয়ে অসুবিধার সম্মুখীন হতে হবে তাদের। তবে শুধুমাত্র ভিসা এবং মাস্টার কার্ডই নয়, এয়ারলাইন্স এবং বিশ্বের একাধিক আর্থিক সংস্থা ইতিমধ্যেই তাদের আর্থিক লেনদেন প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ ছিন্ন করেছে রাশিয়ার সঙ্গে। এমনকী শুধুমাত্র আর্থিক সম্পর্কই ছিন্ন নয়, ইতিমধ্যেই কানাডাসহ ইউরোপের একাধিক দেশ তাদের দেশের আকাশ সীমার পথ বন্ধ করে দিয়েছে রাশিয়ার বিমানগুলির জন্য। এই অবস্থায় এত কিছুর পর কিছুটা হলেও নমনীয় হওয়া তো দূর অস্ত, উল্টে ইউক্রেনের প্রতি পুরনো অবস্থান জারি রেখে নিজেদের আগ্রাসনের মাত্রা আরো দ্বিগুণ করেছে রাশিয়া। এমনকী তাদের এই আক্রমণকে ইতিমধ্যেই বিশেষ 'অভিযান রূপে' আখ্যা দিয়েছে রাশিয়া সরকার।
তবে এরই মধ্যে মাস্টার কার্ডের তরফ থেকে জানানো হয়েছে ইউক্রেনের প্রতি রাশিয়ার আগ্রাসন প্রতিহত করতেই এই সিস্টেম বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা। তাদের দাবি বিগত ২০২১ সালে রাশিয়ার দ্বারা তাদের আয়ের পরিমাণ মোট আয়ের চার শতাংশও। এবং ইউক্রেন থেকে তারা বিগত বছরে আয় করেছে মাত্র দুই শতাংশ। তথাপি শুধু আয়ের লক্ষ্য মাত্রার ওপর নজর না দিয়ে বাস্তব পরিস্থিতিকে গুরুত্ব দিয়ে এমন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন তারা। তবে এসব কিছুকে হেলায় উড়িয়ে রাশিয়ান ব্যাংক মির-এর পক্ষ থেকে পাল্টা যুক্তি দিয়ে দেশের মানুষকে আশ্বস্ত করে জানা হয়েছে, ভিসা এবং মাস্টার কার্ড বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই মুহূর্তে তাদের ব্যবসা বেড়ে গিয়েছে। এবং বৃদ্ধি আরও তরান্বিত হবে বলেই জানা হয়েছে। প্রসঙ্গত শুধুমাত্র মির ব্যাংক সিস্টেম রাশিয়ায় নয়, রাশিয়ার পার্শ্ববর্তী দেশ যেমন তুরস্ক, ভিয়েতনাম, আর্মেনিয়া, বেলারুশ, কাজাখস্তান এবং কিরগিজস্তানসহ কয়েকটি দেশে চালু করেছে রাশিয়া সরকার। এই মুহূর্তে ওই দেশগুলোতেও ব্যবসার গতি উর্ধ্বমুখী বলেও জানানো হয়েছে সংস্থার পক্ষ থেকে।
কিন্তু এত কিছুর পর লাখ টাকার প্রশ্ন একটাই- সরাসরি যুদ্ধে অর্থাৎ হাতে নয় অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা পাশাপাশি ভিসা, মাস্টার কার্ড এবং আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্যাংকের পরিষেবা বন্ধ করে কি রোখা যাবে রাশিয়াকে। এই সমস্ত সিস্টেম গুলির সুবিধা এবং তা বন্ধের প্রভাব কতখানি পড়তে পারে?
এবার প্রশ্নও হলো রাশিয়ান নাগরিক বাদে রাশিয়ার মাটিতে ভিসা বা মাস্টারকার্ড ব্যবহার করা যাবে কি না?
এ বিষয়ে ভিসা এবং মাস্টার কার্ডের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, রাশিয়ার এটিএম কাউন্টারগুলোতে কাজ করবে না ভিসা এবং মাস্টার কার্ডে। পাশাপাশি সাসপেনশন অর্থাৎ সাময়িক বন্ধের জন্য রাশিয়ান কোনো নাগরিক বিশ্বের কোনো দেশেই তাদের লেনদেন প্রক্রিয়া ভিসা এবং মাস্টার কার্ড দ্বারা করতে পারবেন না। একমাত্র সাসপেনশন অর্থাৎ সাময়িক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হলে তবেই রাশিয়ান নাগরিকরা ভিসা এবং মাস্টার কার্ডের সুবিধা পেতে পারেন।
রাশিয়ায় কি এর বিকল্প কোনো ব্যবস্থা আছে?
এক কথায় এর উত্তর হবে হ্যাঁ। কারণ ২০১৫ সাল থেকেই রাশিয়ায় চালু রয়েছে তাদের দেশের নিজস্ব ব্যাংক সিস্টেম মির যার সুবিধা বর্তমানে সে দেশের ৩২ শতাংশও মানুষ নেন। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়াকে আক্রমণ করে রাশিয়া। ওই সময় রাশিয়ার আগ্রাসন রুখে দিতে ভিসা এবং মাস্টার কার্ড বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় সংস্থার পক্ষ থেকে। ওই সুযোগে দেশের মানুষকে আর্থিক স্বাচ্ছন্দ দিতে রাশিয়ান সরকার তৈরি করে মির ব্যাংক ব্যবস্থা। যা ইতিমধ্যেই শুধুমাত্র রাশিয়ায় নয় এশিয়ার বহু দেশেই এই সিস্টেম জারি রয়েছে বহাল তবিয়তে। পাশাপাশি রাশিয়াসহ গোটা প্রায় ২০০ দেশে চালু রয়েছে চীনের ইউনিয়ন পে' সিস্টেম।
ভিসা এবং মাস্টার কার্ড বন্ধের ফলে কী প্রভাব পড়তে পারে?
ভিসা এবং মাস্টার কার্ড বন্ধের প্রভাব সে দেশে খুব একটা পড়বে না বলেই দেশের জনগণকে আশ্বস্ত করেছে রাশিয়া সরকার। যদিও এর প্রভাব হ্রাস করার প্রক্রিয়া জারি রেখেছে সে দেশের সরকার। পাশাপাশি রাশিয়ান সরকার জানিয়েছে, ভিসা বা মাস্টারকার্ড দ্বারা জারি করা কার্ডগুলো মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত গ্রাহকরা তা ব্যবহার করতে পারবেন। তা ছাড়াও রাশিয়ান ব্যাংকগুলোর থেকে ঘোষণা করা হয়েছে বিদেশ থেকে দেয়া কোনো কার্ড রাশিয়ায় ব্যবহার করা যাবে না। এমনকী রাশিয়ার মাটিতে বিদেশি কার্ডগুলো কাজ করবে না বলেই জানানো হয়েছে।
সূত্র : নিউজ ১৮