পুতিন কেন এভাবে আটকে গেলেন?
পুতিন - ছবি : সংগ্রহ
রাশিয়া কেন ইউক্রেন দখলের জন্য এই আক্রমণ করল আর সেই লক্ষ্য পুতিন কতটা অর্জন করতে পেরেছেন? ইউক্রেন আক্রমণের পূর্ববর্তী পুতিনের ঘণ্টাব্যাপী তাৎপর্যপূর্ণ ভাষণটি অনুধাবনের চেষ্টা করলে কয়েকটি বিষয় সহজ হবে। প্রথমত, পুতিন রাশিয়াকে বৈশ্বিক নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষমতাধর হিসেবে বিলুপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের অবস্থানে নিয়ে যেতে চান। এ জন্য সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ১৪টি প্রজাতন্ত্রকে রাশিয়ার একীভূত করা হয়তো সম্ভব হবে না, তবে এসব প্রজাতন্ত্রকে রুশ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার লক্ষ্য রয়েছে পুতিনের সামনে। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্যই তিনি জর্জিয়া ও বেলারুশে হস্তক্ষেপ করেছেন। মধ্য এশিয়ার আজারবাইজান ও সর্বশেষ কাজাখস্তানে হস্তক্ষেপ করেছেন। এসব হস্তক্ষেপে তিনি যা অর্জন করতে চেয়েছিলেন তাতে তিনি সফল বলেই মনে হয়। রাশিয়ার জন্য সবচেয়ে সংবেদনশীল ও গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতন্ত্র ছিল ইউক্রেন। ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ উপদ্বীপ ক্রিমিয়া দখল করে সেটিকে রাশিয়ার সাথে অঙ্গীভূত করেছেন পুতিন। সেই সাথে ডনবাসের রুশভাষী অধ্যুষিত অঞ্চলকে প্রক্সি দিয়ে দখলে নিয়েছেন।
কিন্তু এত কিছুর পরও রুশপন্থী সরকারের পতনের পর পুতিন ইউক্রেনকে হুমকি হিসাবে দেখে আসছিলেন কয়েকটি কারণে। প্রথমত, ইউক্রেন ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হবার জন্য আবেদন জানিয়েছে। ন্যাটোর সদস্য হলে এই সংস্থার নিরাপত্তা ব্যবস্থা ইউক্রেন পর্যন্ত বিস্তৃত হবে আর সে ক্ষেত্রে ক্রেমলিন চাইলেই ইউক্রেনে হামলা করতে পারবে না। সেটি করার অর্থ হবে পুতিন যে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা বারবার বলছেন সেটি বাস্তবে ঘটে যাওয়া। এ জন্য তিনি ট্রিগারের সামনে ইউক্রেনে অবস্থান পরিবর্তন অথবা মস্কোর দাবি পূরণে বাধ্য করার অবস্থা তৈরি করতে চেয়েছিলেন। মৌলিকভাবে পুতিন দুটি বা তিনটি দাবি ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য শর্ত করে দিয়েছেন। সেগুলো সামনে আনা হলে এর কিছুটা তাৎপর্য অনুধাবন করা যাবে। যুদ্ধ শুরু করার আগে পুতিনের দাবি ছিল ন্যাটো ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি, যার মধ্যে ছিল ইউক্রেনে বা পূর্বমুখী ন্যাটো সম্প্রসারণ না করার গ্যারান্টি দেয়া। দ্বিতীয়ত, ১৯৯৭ সালের পর ন্যাটোর যে সম্প্রসারণ হয়েছে সেটিকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নেয়া অর্থাৎ সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র ও পূর্ব ইউরোপের যেসব দেশকে ন্যাটো সদস্য করা হয়েছে তাদের পরিত্যাগ করা। তৃতীয়ত ইউরোপীয় ইউনিয়নে ইউক্রেনকে সদস্য না করা। ন্যাটো বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেউই রাশিয়ান দাবির প্রতি নমনীয়তা দেখায়নি। বরং তা সরাসরি নাকচ করে দিয়েছে।
তবে একই সাথে ইউক্রেনকে ন্যাটো বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ দেয়াও হয়নি। পশ্চিমা নেতারা ইউক্রেনে সামরিকভাবে যুক্ত না হওয়ার ঘোষণাও বারবার দিয়েছেন। যদিও ইউক্রেনকে সব ধরনের সামরিক সহায়তা দেয়া ও আগ্রাসনের প্রতিবাদে সামরিক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি দিয়ে এসেছে পশ্চিমা দেশগুলো। যুদ্ধ বন্ধের সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে সেই হুমকি পশ্চিমারা বাস্তবায়নও করেছেন। আর এটি এমনভাবে হয়েছে যে এই মাত্রার অবরোধ নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নের প্রত্যাশা রাশিয়া করেনি। এক দিকে ধারণার চেয়ে অনেক ব্যাপক মাত্রায় ইউক্রেনীয় প্রতিরোধ, অন্য দিকে অনেক গভীর আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা রাশিয়াকে অপ্রস্তুত অবস্থায় ঠেলে দিয়েছে।
কেন বা কিভাবে এটি হলো তা বুঝতে হলে রাশিয়ান ক্ষমতার উৎস ও রহস্যটা জানতে হবে। এর মধ্যে এক দিকে রয়েছে এই অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা আর অন্য দিকে রয়েছে অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষা স্বার্থ। তুরস্ক থেকে শুরু করে আমেরিকার আলাস্কা পর্যন্ত বিস্তৃত বৃহত্তম ভৌগোলিক সীমানা নিয়ে রাশিয়া গঠিত হলেও এর জনসংখ্যা ১৭ কোটির নিচে। এর অর্থনীতি প্রধানত জ্বালানি ও প্রতিরক্ষা শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। রাশিয়ার রফতানি আয়ের ৬০ ভাগ, বাজেটের ৪০ ভাগ এবং স্থূল দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির ২০ ভাগ আসে জ্বালানি খাত থেকে। বাকি আয়ের বড় অংশ প্রতিরক্ষা শিল্প এবং কিছু আয় গম, ভুট্টার মতো কৃষি খাতের পণ্য থেকে আসে।
আয়ের এই ক্ষেত্রগুলো হলো রুশ ক্ষমতার প্রধান ভিত্তি। জ্বালানি আয়ের টেকসই অবস্থার জন্য প্রয়োজন বাজার, আর প্রতিরক্ষা আয়ের অব্যাহত রাখার জন্য প্রয়োজন বৈশ্বিক প্রভাব। আর এ দুটির সমন্বিত প্রয়োজনে নিরাপত্তা চাহিদা পূরণ করার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন পুতিন। রাশিয়ান জ্বালানির গতানুগতিক বাজার হলো ইউরোপ। ইউরোপে গ্যাস রফতানির প্রধান রুট বা পাইপলাইনগুলো গেছে ইউক্রেনের ওপর দিয়ে। ইউক্রেনের ক্রিমিয়া ও ডনবাস এলাকা দখলের ক্রদ্ধতার জন্য রুশ অবান্ধব সরকার যেকোনো সময় মস্কোর জন্য বৈরী পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। যার কারণে ইউক্রেনে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে অনেকটা বেপরোয়া ও মূল্যদায়ক পদক্ষেপ নিতে পিছপা হননি ভ্লাদিমির পুতিন। এমনকি তিনি লক্ষ্য অর্জনের জন্য পারমাণবিক যুদ্ধের হুমকিও দিয়েছেন। বলেছেন, যে গ্রহে রাশিয়ার গুরুত্ব থাকবে না সেই পৃথিবীর থাকার দরকার কী? আর ইউক্রেনের রাষ্ট্রীয় অস্তিত্ব বজায় রাখার অধিকারের বিষয়টিই তিনি অস্বীকার করেছেন।