পুতিনের প্রস্তাব ও বাস্তবতা
পুতিন ও জেলেনস্কি - ছবি : সংগ্রহ
ইউক্রেনের বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যে শর্তগুলো দিচ্ছেন তা খুবই কর্কশ শোনায়। তিনি বলেছেন, ইউক্রেনকে অস্ত্র সমর্পণ করে সামরিকবিহীন হতে হবে। কোনো জোটে অংশ না হবার অঙ্গীকার করতে হবে। ক্রিমিয়া ও ডনবাস অঞ্চলকে রুশ অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। ইউক্রেনের ‘নাৎসি সরকার’কে ক্ষমতা ছাড়তে হবে। পুতিনের এসব শর্ত দৃশ্যত কোনোভাবেই সমঝোতার আসার মতো নয়।
অবশ্য পুতিন যে ধরনের শর্তের কথা মুখে বলুন না কেন ইউক্রেনকে সামরিকভাবে পুরো জয় করতে না পারলে এসব শর্ত কোনোভাবেই তিনি আদায় করতে পারবেন বলে আশা করা যায় না। আর রাশিয়া দু’সপ্তাহের যুদ্ধ সময়ে যে অবস্থায় এসে উপনীত হয়েছে তাতে এমন কিছু দিক হাজির হয়েছে যা রাশিয়ার জন্য সুখকর নয়। ইউক্রেনের দাবি অনুসারে ১২ দিনের যুদ্ধে প্রতিদিন গড়ে ১০০০ রুশ সেনা নিহত হয়েছে যাদের মধ্যে কয়েকজন শীর্ষ স্থানীয় কমান্ডারও রয়েছেন। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জঙ্গিবিমান ও হেলিকপ্টার আর ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান ধ্বংস করেছে ইউক্রেনীয় বাহিনী। ইউক্রেনের দাবি অনুসারে রাশিয়ার ক্ষয়ক্ষতি অতোটা না হলেও রাশিয়া যে বড় ধরনের সামরিক ক্ষতির মুখে পড়েছে সেটি উপলব্ধি করা যায়।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণের আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দুই শীর্ষ দেশ জার্মানি ও ফ্রান্স ভিন্ন অবস্থান গ্রহণের প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে আসছিলেন। দুই সরকারপ্রধান আলাদা আলাদাভাবে রাশিয়া সফর করে পুতিনের সাথে দীর্ঘ বৈঠক করেছিলেন। তারা প্রথম দিকে ইউক্রেনে সামরিক সহায়তা না পাঠানোর কথাও বলেছিলেন। কিন্তু ইউক্রেনে রাশিয়ার বাস্তব সামরিক আক্রমণের পর পুরো দৃশ্যটা পাল্টে গেছে। ন্যাটোর বা পশ্চিমা বলয়ের মধ্যে অকাস ও অন্যান্য ইস্যু নিয়ে যে বিভাজন সৃষ্টি হয়েছিল সেই ফাটল যুদ্ধের পর আর থাকেনি। রুশ-জার্মান সম্পর্কের ভবিষ্যৎ লাইফ লাইন হিসেবে পরিচিত নর্থ স্টিম-২ পাইপলাইন প্রকল্পের অনুমোদন জার্মানি স্থগিত করেছে এবং ইউক্রেনে বার্লিন সামরিক সহায়তা পাঠাতে শুরু করেছে। একই ধরনের পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে ফ্রান্সের ক্ষেত্রেও। ইউরোপের সব দেশই রুশ আক্রমণে নিরাপত্তা শঙ্কা বিরাজ করতে শুরু করেছে। সুইডেন ও ফিনল্যান্ড ন্যাটোতে যোগদানের আলোচনা শুরু করেছে। অবরোধে যোগ দিয়েছে সুইজারল্যান্ডের মতো দেশও। জার্মানি প্রতিরক্ষা বাজেট দ্বিগুণ করেছে। ইউরোপের ছোট বড় প্রতিটি দেশ নিরাপত্তা উদ্যোগ ও বাজেট বাড়িয়েছে। রাশিয়ার জন্য শঙ্কার বিষয় হলো ইউরোপ রাশিয়ার বিকল্প জ্বালানি উৎসের জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ শুরু করেছে।
রাশিয়ার ইউক্রেন অভিযান যত দীর্ঘস্থায়ী হবে পরিস্থিতির মেরুকরণ তত বেশি ধারালো হবে। আর ন্যাটো ইউক্রেন যুদ্ধে সরাসরি না জড়ালেও দেশটির প্রতিরোধে যে তাদের সক্রিয় সমর্থন রয়েছে তা এখন আর অস্পষ্ট নয়। ফলে দ্রুত ইউক্রেনের পতন ঘটবে বলে মনে হয় না।
আর পুতিনের অব্যাহতভাবে পারমাণবিক ও তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের হুমকি উচ্চারণ তার যুদ্ধবাজ ও দায়িত্বজ্ঞানহীন নেতার ইমেজ তৈরি করছে। এই ইমেজ আর্কটিক অঞ্চলে জ্বালানি সম্পদ আহরণ ও তা বিক্রি করে রাশিয়ার সামনে যে অর্থনৈতিক শক্তি হবার সম্ভাবনা তৈরি করেছিল সেটিও নষ্ট করতে পারে। একই সাথে রাশিয়ার অভ্যন্তরে এবং বেলারুশের মতো মিত্র দেশগুলোতে বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটাতে পারে। পশ্চিমারা এজন্য তাদের তৎপরতা বৃদ্ধি করেছে বলে নানা ঘটনায় মনে হচ্ছে।
সার্বিকভাবে জর্জিয়া, বেলারুশ, ক্রিমিয়া, আজারবাইজান, কাজাখস্তান, চেচনিয়া এবং দেশের বাইরে সিরিয়া, লিবিয়ার রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সামরিক হস্তক্ষেপ যে অর্জন করেছে সেটি নবপর্যায়ে ইউক্রেন অভিযানে অর্জন করতে পারছে বলে মনে হয় না। অধিকন্তু সার্বিক লাভ ক্ষতিকে গাণিতিকভাবে টেবিলে সাজানো হলে পুতিন বা রাশিয়ার ভবিষ্যতের জন্য আশাবাদী কোনো দৃশ্যপট তৈরি হচ্ছে বলে মনে হয় না। সম্ভবত এ কারণে অনমনীয় পুতিনকে এখন কিছুটা নমনীয় মনে হচ্ছে বেলারুশকেন্দ্রিক ইউক্রেন-রাশিয়া আলোচনায়। এতে কিছুটা অগ্রগতি হতে পারে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। তুরস্কের আহ্বানে সাড়া দিয়ে আনাতোলিয়ায় ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে হাজির হচ্ছে মস্কো-কিয়েভ। চীন সমঝোতার উদ্যোগ নেয়ার ইঙ্গিত দিতে শুরু করেছে।
এসব উদ্যোগে এখনই ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান ঘটা অথবা সঙ্কট উত্তরণ হবে কিনা তা সুনির্দিষ্ট করে বলা যাবে না। তবে দুই সপ্তাহের যুদ্ধে বিশ্বব্যবস্থায় যে ঝাঁকুনি সৃষ্টি হয়েছে তাতে আমরা আগামীতে নতুন এক পৃথিবী বা বিশ্বব্যবস্থা দেখতে পাবো বলে মনে হয়। চীন-রাশিয়ার নেতৃত্বে বিকল্প আন্তর্জাতিক লেনদেন ও আর্থিক ব্যবস্থা তৈরির জন্য যে কাজ শুরু হয়েছিল সেটি পরিপক্ব হওয়ার আগেই পশ্চিমা বলয় থেকে ইউক্রেন যুদ্ধের জের ধরে পাল্টা আঘাত এসেছে রুশ অক্ষের ওপর। এই আঘাতের ফলে হয়তোবা বিকল্প অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তৈরির উদ্যোগ দ্রুততা পেতে পারে। অথবা এই উদ্যোগ বেশ কিছু সময়ের জন্য স্থবির হয়ে পড়তে পারে। যুদ্ধে জয়ের চেয়েও চলমান লড়াইটিকে ‘গণতন্ত্র ও কর্তৃত্ববাদের লড়াই’ হিসেবে চিহ্নিত করে যে প্রচার বাইডেন শুরু করেছিলেন তাতে পশ্চিমারা মোটা দাগে একই বিন্দুতে চলে এসেছে। এসময়ে এটিকে বাইডেনের সাফল্য আর পুতিনের দাপটি চলার পথে ব্যত্যয় হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে।
mrkmmb@gmail.com