রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বৈশ্বিক নেতৃত্ব পরিবর্তন!
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বৈশ্বিক নেতৃত্ব পরিবর্তন! - ছবি : সংগৃহীত
সারা দুনিয়াই এখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ইস্যুতে, একভাবে না একভাবে সংশ্লিষ্ট হয়ে গেছে। এবং বলাবাহুল্য তা পক্ষে অথবা বিপক্ষে। এই যে কথাটা বললাম তা নতুন কথা নয়। কেবল ফারাক হয়তো এতটুকুই যে, অন্যরা আমার মতো করে নয় কিন্তু তারা তাদের মতো করে অন্যভাবে বুঝে বলেছে।
তা হলে নতুন যে কথাটা এখন বলতে যাচ্ছি সেটি হলো, গ্লোবাল নেতৃত্বে বদল আসন্ন। এ কথা আমি ২০১৪ সাল থেকে নিশ্চিত করে বলে আসছি; যেটা এখন অনেকেই স্বীকার করে বা মেনে নিচ্ছেন। আসন্ন সেই গ্লোবাল নেতৃত্বে বদলের দিকে একটা গ্রেট লিপ বা বড় পদক্ষেপে এগিয়ে যাওয়ার নতুন ঘটনাটাই হলো ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ’ অর্থাৎ বড় পদক্ষেপে বদলের বাইরে দিকটাই মানুষ দেখছে ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ’ হিসেবে। আসলে গ্লোবাল নেতৃত্বে নেতাদেশ বদল মানে, আমেরিকা নেতৃত্ব হারানো আর চীনের উত্থান ঘটা, এটিই ধেয়ে আসছে। আর আমেরিকা নেতৃত্ব হারাচ্ছে- এ ঘটনাটা মুখে বলাটা মোটেই ব্যক্তির ইচ্ছা না। এমনকি সে চীনকে বেশি পছন্দ করে কি না তাতেও কিছু এসে যায় না, তাই এই ভিত্তিতে সে বলে বেড়াবে। এটি ব্যক্তি-ইচ্ছা-নিরপেক্ষ বাস্তবতা- এমন এক অবজেকটিভিটি যে, আমেরিকা নেতৃত্ব হারাচ্ছে, চীনা উত্থান ঘটছে।
সাম্রাজ্যের ইতিবাচক ভূমিকা
এম্পায়ার বা বাংলায় ‘সাম্রাজ্য’ শব্দটি অনুসরণ করা যাক। বহু পুরনো এই শব্দ, দুনিয়া যখন শাসন বলতে কেবল রাজার শাসন বা রাজতন্ত্র বুঝত, সে আমলের। তখনকারই আরেক প্রায় সমান্তরাল শব্দ হলো সম্রাট বা সম্রাটের সাম্রাজ্য। ইউরোপে, অন্যের দেশ দখলদার- এটিই যেসব দেশের প্রধান পেশা ও ব্যবসা, পরিচয়, এমন সবচেয়ে বড় পাঁচ রাষ্ট্র হলো ব্রিটেন, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, পর্তুগাল ও স্পেন যারা সবাই ‘সাম্রাজ্য’ (যেমন ব্রিটিশ সাম্রাজ্য) বলেই পরিচিত ছিল। কিন্তু মূল কথা, রাজ্য আর সাম্রাজ্য বলে ডাকার ক্ষেত্রে একটি বড় ফারাক হলো, ছোট হলে রাজ্য আর বড় হলে সাম্রাজ্য এমন একটি চিন্তা কাজ করত অবশ্যই যদিও এদের মূল ফারাকটা আরো গভীরে। রাজা আর সম্রাট উভয়ে খাজনা তুলে খায় এটি কমন। কিন্তু দুটোর ফারাক হলো, রাজার খাজনা নেয়ার বিনিময়ে প্রজা কিছু দিতে বাধ্য নয়। যেমন দুনিয়ার যত রাজা ছিল তাদের এসব অর্থ আদায় যা এখানে কমন নাম আকারে, সব কিছুকেই ‘খাজনা বলছি’। আমাদের পাহাড়ি এলাকায় রাজতন্ত্র অকেজো হয়ে গেলেও এখনো খাজনা আদায়ের ‘পুণ্যাহ’ অনুষ্ঠান চালু আছে। এখনো পাহাড়ি প্রজাদের থেকে তাদের রাজা অর্থ আদায় করতে পারুক আর না পারুক, সেই ‘পুণ্যাহ’ কালেকশন ও অনুষ্ঠানের স্মৃতি অন্তত রাজারা জারি রাখতে চান। রাজ-প্রশাসন বলে কিছু না থাকলেও সাংস্কৃতিক পরিসরে রাজার অনুভূতি থাকুক, এই চাওয়াকে কার্যকর রাখা হয় এ ঘটনায়। এখন শব্দটা লক্ষ করা যাক; এটি এক ধর্মতাত্তি¡ক ইঙ্গিতমূলক শব্দ যেন বলতে চায় ‘খাজনা দেয়া পুণ্যের কাজ’। আর সারকথায় বলা যে, বস্তুগত লাভালাভের দিক থেকে খাজনা দিলে প্রজারা বিনিময়ে কিছু পাবে না।
এমনই আরেকটি শব্দে খাজনা তোলার রেওয়াজ ছিল ইংরেজিতে ‘ট্রিবিউট’ শব্দে, যার একটা বাংলা হয় ‘শ্রদ্ধা’ জানানো। মানে হলো রাজাকে ভিজিট করতে গেছেন অথবা বুঝবে কী করে যে তাকে আপনি শ্রদ্ধা-সালাম জানাতে গেছেন? সে জন্য আপনাকে নগদ অর্থ দিতে হবে। দিলে পরে সেটি আপনার সালাম জানানোর ইচ্ছা প্রকাশিত হয়েছে, ধরা হবে। না, আমাদের বাংলা ভাষা বা সমাজেও দেখেন। সেখানে এটি এখনো আছে। মার্কেটে দোকান ভাড়া নিতে গেছেন। মার্কেট মালিক বলছে ভাড়া মাসে তিন হাজার কিন্তু সাথে ‘সালামি’ দিতে হবে পাঁচ লাখ। মানে হলো এ সালামিটাই ইংরেজিতে ট্রিবিউট। সারকথায় রাজা মানে যে সালামি, ট্রিবিউট পুণ্যাহ খায়। তবে বিনিময়ে প্রজাকে কিছু দেয় না।
আর ঠিক এ জায়গাটা হলো রাজা-সম্রাটের ফারাক। সারকথায় সম্রাটও সালামি, ট্রিবিউট, পুণ্যাহ ইত্যাদি যা আছে সব নেয়। কিন্তু একই সাথে প্রজাদের জন্য অনেক সামাজিক দায়-কর্তব্য সে নেয়। কেমন সেটি? গঞ্জ-হাট-বাজার অনেক পুরনো জিনিস। সেকালে যে সম্রাট সে এমন বাজারটা পাকা করার দায় নেবে। বণিকদের হাটে আসা-যাওয়া চলাচলের নিরাপত্তা দেবে; সে জন্য পাইক-পেয়াদা নিয়োগ দেবে। এক কথায় কমন গুড মানে সবার কাজে লাগে, এমন কাজকর্মে সম্রাট মনোযোগ দেবে। সম্রাট জানে, ব্যবসাটা ভালো জমলে খাজনা-আয় ভালো হবে। এসব মিউনিসিপাল বা সিভিক সার্ভিস বাড়িয়ে দিয়ে যদি এবার খাজনা একটু বেশি চাই হাটের মানুষ তাও দেবে। এই হলো সাম্রাজ্য ব্যবস্থা শুরুর গুরুত্বপূর্ণ দিক। এটিই ‘সাম্রাজ্য’ ধারণা ও শব্দটার বড় কিছু ইতিবাচক দিক।
আমাদের সাবধান হতে হবে ১৯৪৫ সালের আগের সাড়ে তিন শ’ বছরের ইউরোপ নিয়ে; এ সময়ের সাম্রাজ্য শব্দটার অর্থ আমাদের মতো এশিয়ান দেশের অভিজ্ঞতায় পুরাটাই নেতিবাচক ছিল; কারণ সাম্রাজ্য তৎপরতা বলতে তখন এর একটাই অর্থ, কলোনি দখল ও শাসন।
তবে ১৯৪৫ সালের পরে আমরা প্রথম দেখলাম এক নতুন ধরনের আমেরিকা। না এটি কোনো রাজতন্ত্র ছিল, নাগরিকের ক্ষমতায় নির্বাচিত এক আমেরিকান রিপাবলিক। ফলে সেই অর্থে এখানে কোনো আমেরিকান সম্রাট নেই। কিন্তু এই আমেরিকার হাতেই তবু ১৯৪৫ সালের পরে- সেই প্রথম দুনিয়াতে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তার নেতৃত্বে এক গ্লোবাল পলিটিক্যাল ও ইকোনমিক ব্যবস্থা ও শৃঙ্খলা তৈরি করা বলে বুঝতে হবে। এর খারাপ-ভালো সব দিকসহ-ই। কমিউনিস্টরা এই আমেরিকান কর্তৃত্বকে বিশেষ করে ১৯৫৩ সালের পরের আমেরিকাকে ‘আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ’ বলে থাকে এবং তা বলার পক্ষে এমন আমেরিকান ভূমিকাও আছে; যেমন সিআইএ পাঠিয়ে কোনো দেশে ক্ষমতা দখল ও সরকার বদল এবং তা বিশেষত প্রাকৃতিক সম্পদ দখলের উদ্দেশ্যে। কিন্তু একই সাথে এই আমেরিকার এম্পায়ার রোলও আছে। যেটাকে আগে সাম্রাজ্যের ব্যতিক্রমী ইতি ভূমিকা বলেছি, সেটিও সে পালন করেছে। কিভাবে?
সেকালে সম্রাট যেমন রাজার চেয়ে এগিয়ে গিয়ে বসে বসে চাঁদা-খাজনা খাওয়া নয়- প্রজাদের সার্ভিস দেয়া, এই বিনিময়ের মাধ্যমে একটি রাজ্য-প্রশাসন বা সাম্রাজ্য খাড়া করে ফেলা যার মুখ্য অবদান; ঠিক তেমনি ১৯৪৫ সালের পরে, আমেরিকা এক ইতি-এম্পায়ার ভূমিকাও নিয়েছিল। কারণ এক নয়া গ্লোবাল সিস্টেম সে গড়ে তুলতে চেয়েছিল।
মূল কারণ গ্লোবাল সিস্টেমের নেতা হতে গেলে পজিটিভ এম্পায়ারের দায়-ভূমিকা যা থাকে সেটিও পালন করতে হয় এবং তা করে বলেই তো সে গ্লোবাল নেতা। যেমন চলতি শতকের শুরু থেকেই আমেরিকা রাষ্ট্র চালাতে গিয়ে বেকায়দায় পড়ে সভরেন-লোন নিয়ে চলেছে। সভরেন মানে খোদ রাষ্ট্রকেই বন্ধক রেখে গ্লোবাল পুঁজিবাজার থেকে ঋণ করে নিয়ে চলা একটা দেশ। আর সে জন্য প্রায়ই নিজ সংসদ থেকে নতুন লোন নেবার অনুমতি নিতে হয়। আর এ নিয়ে প্রতিবারেই এক-দুই সপ্তাহের নাকানি-চুবানি খায় আমেরিকান প্রেসিডেন্টের। একবার ওবামা আমলে প্রেসিডেন্টের এমন নাকানি-চুবানি চলছিল কিন্তু এরই ভিতর ওবামা ডবিøউএফপি (জাতিসঙ্ঘের খাদ্য সহায়তা-বিতরণ প্রতিষ্ঠান) কে তার রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি পূরণের জন্য ওবামা এক শ’ মিলিয়ন ফান্ড রিলিজ করছেন। অথচ তখন অর্থ বরাদ্দ নেই বলে যারা বিভিন্ন সেক্টরে দিন-ভিত্তিতে স্যালারি পান এমন সরকারি কর্মচারীদের ‘কাজ নাই’ বলে দেয়া হয়েছিল।
নিজের অবস্থা যাই হোক, ডবিøউএফপিকে প্রতিশ্রুত অনুদানের ফান্ড আগে রিলিজ করতে হবে- এই হলো গ্লোবাল রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক এক ব্যবস্থায় গ্লোবাল নেতার ইতিবাচক দায়-ভূমিকা যা পুরনো স্টাইলে বললে ‘এম্পায়ারের ইতি-দায়’ বলা যায়। আমি অনেকবার লিখেছি, কোনো রাষ্ট্র গ্লোবাল নেতা হতে হলে ১ নম্বর শর্ত হলো তার অর্থনীতি অবশ্যই উদ্বৃত্ত অর্থনীতি হতে হবে, এমন পরিমাণ সারপ্লাস বা উদ্বৃত্তের সম্পদ থাকতে হবে, যাতে দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিতে নয়া অবকাঠামোগত খাতে স্বল্পসুদে বিনিয়োগের যে চাহিদা আছে তা পূরণের যোগ্যতা সামর্থ্য থাকতেই হবে। এ যোগ্যতার জন্যই সে পজিটিভ এম্পায়ার, ফলে সে গ্লোবাল নেতা।
গ্লোবাল ইকোনমিতে একটি উদাহরণে যাওয়া যাক; ইকোনমি ও করোনা প্রসঙ্গে। গ্লোবাল ইকোনমি ফেল করলে, খারাপ অবস্থায় পতিত হলে এটা কোনো খুশির খবর নয়। ‘সারপ্লাস ভ্যালু চোরেরা’ এবার ‘ধরা খাইবে’ যুক্তিতেও এটা খুশি হওয়ার বিষয় নয়। দুর্ভিক্ষ বা জীবনের ন্যূনতম চাহিদা পূরণ না হওয়ায় তা-জনিত মৃত্যু কোনো কাম্য বিষয় নয়। তাই গ্লোবাল ইকোনমিকে পতিত বা ফেল করে যাওয়া থেকে বাঁচানোর ক্ষেত্রে গ্লোবাল নেতার এক বিরাট দায়-ভূমিকা আছে থাকে, মানুষ ও বিশ্ব তা আশাও করে।
গ্লোবাল নেতার কী করার আছে এখানে?
করোনার টিকার পূর্ণ ডোজ নিলে আর করোনা হবে না বা শতভাগ করোনামুক্তি মিলবে, টিকা উৎপাদকেরাও তা কখনো দাবি করে না। তাহলে টিকার কী কাজ? কোনো অর্থনৈতিক তৎপরতা বন্ধ বা লকডাউনের বিরুদ্ধে আবার যদি মানুষ উঠে দাঁড়াতে চায়, ন্যূনতম অর্থনৈতিক তৎপরতা যদি চালু করতে চায় তা হলে মানুষের হাতের নাগালে আছে আর কিছু পরিমাণ প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যা কিছুটা কাজ করে এমন একমাত্র উপায় হলো পাবলিককে টিকা দেয়া। যত দ্রæত দেশের বেশির ভাগ যোগ্য নাগরিককে তা দেয়া যায়। তা হলে এর অর্থ দাঁড়াল যে, গ্লোবাল অর্থনীতিকে যদি ফিরে দাঁড়াতে হয়- যতটা সম্ভব ফিরে উঠে দাঁড়ানোর ব্যাপারটা সে ক্ষেত্রে নির্ভর করে টিকার প্রাপ্যতা, টিকা কিনবার ফান্ড আর ম্যানেজমেন্ট যাতে সুষ্ঠুভাবে টিকা দেয়ার কাজটি সুচারুভাবে করে গেছে কি না এর ওপর। আর এখানে গ্লোবাল নেতার বিরাট ভূমিকাটা হলো, এখানেই এই তিন কাজে বিনিয়োগ। কারণ টিকা উৎপাদন বা ক্রয়ে সামর্থ্যহীন অথবা লাইসেন্স দিলেও যে উৎপাদন করতে পারবে না; এমনকি টিকা শুধু পৌঁছে দিলেও হবে না; তা ঠিকমতো পুশ করার ম্যানেজমেন্টেও সহায়তা লাগবে এমন গরিব দেশ কম নয়, বরং এরাই সংখ্যায় বেশি। এ ছাড়া বড়লোক দেশগুলো নিজে টিকা নেয়ার পরও আরো দ্বিগুণ টিকা মজুদ করে রেখেছিল তাতেও নয়া করোনার বিস্তার ঠেকেনি। রাখলেও তারাও নয়া করোনার হাত থেকে বাঁচবে না। কারণ আফ্রিকায় টিকা না দিলে সেখান থেকেই এই ভাইরাস আরো ভয়ঙ্করভাবে নতুন ভ্যারিয়েন্ট বা নতুন রূপ নিয়ে আবার সারা দুনিয়াতে ছেয়ে যাবে।
তা হলে এখন বিচার করা যাক আমেরিকা বা চীন কতটা এ জায়গাটায় গ্লোবাল ভূমিকা দেখিয়েছে; বিনিয়োগ করেছে? আফ্রিকার সব বয়সের মিলিয়ে মোট জনসংখ্যা ১.২ বিলিয়নের মতো। চীন একাই আফ্রিকাতে এক বিলিয়ন টিকা দেয়ার প্রতিশ্রুতি পূরণের চেষ্টায় রত হয়েছে। আর আমেরিকার একা নিজ প্রোগ্রামের কোনো প্রতিশ্রুতি ছিল না। বড়লোক দেশের জোট জি-৭ হিসেবে- ডব্লিউএইচও বা (হু)-এর কাছে এদের সম্মিলিত প্রতিশ্রুতি ছিল এক বিলিয়ন ডোজের যা তারা এখনো টার্গেটের ধারে কাছে নেই। তবে ওই মজুদ থেকেই আমেরিকার অনুরোধে হু আমাদের যত যা মডার্না ফাইজার টিকা সরবরাহকারী। আর ঢাকার একাংশসহ সারা দেশের জন্য এখনকার টিকার একমাত্র সরবরাহকারী চীন। আর আমার জানা মতে, চীনের এখনকার টিকাগুলো একেবারে বিনাপয়সায় আমাদের দেয়া। এ ছাড়াও অল্প কিছু টিকা জাপান থেকে এসেছে, আমেরিকা-ভারতের মুখরক্ষা করতে।
অর্থাৎ টিকা প্রশ্নে এরই মধ্যে গ্লোবাল ভূমিকা দেখাতে এগিয়ে আসার ক্ষেত্রে, আমেরিকার চেয়ে চীন অনেক বেশি গ্লোবাল নেতার ভূমিকা নিয়ে নিয়েছে। করোনা গত ২০১৯ সালের শেষের দিক থেকে বিশ্ব ছেয়ে ফেলা শুরু করেছিল। আর ২০২০ সালে ছিল ওর প্রথম ভয়ঙ্কর প্রকোপ। অথচ আমেরিকার মতো দেশের প্রেসিডেন্ট এটি আদৌ কোনো সিরিয়াস ভাইরাস নাকি সাধারণ সর্দি-কাশি এসব নিয়ে মশকরায় দিন কাটিয়েছেন। মজার কথা হলো, যড়যন্ত্র তত্ত¡বাদী কমিউনিস্টরা বলে থাকেন, করোনার আবির্ভাব নাকি বিল গেটসের ‘জীবাণুযুদ্ধের ষড়যন্ত্র’। খোদ ট্রাম্পের অবস্থানও এর কাছাকাছিই ছিল, যেটা আবার এখন পুরোই উদাম। সর্বশেষ কানাডায় ট্রাক ড্রাইভারদের ভ্যাকসিনবিরোধী আন্দোলনে এসে দেখা গেল ইউরোপের যড়যন্ত্র তত্ত্বাবাদী কমিউনিস্ট আর আমেরিকা-কানাডার কনজারভেটিভ বা হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট এরা দু’পক্ষই ভ্যাকসিনবিরোধিতার প্রশ্নে একাকার। দুনিয়াতে এমন ঐক্য সম্ভবত এই প্রথম; সত্যিই বিরল! সবশেষে কানাডার আদালত তাদের এই কথিত আন্দোলনকারীদের ইজ্জত-সম্মান বাঁছিয়েছেন, আদালত একে অবৈধ ঘোষণা করে সবাইকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে।
এই হলো, আমেরিকার গ্লোবাল নেতাগিরির দিন যে ফুরিয়ে যাচ্ছে তা নিয়ে বাইডেনের পূর্বসূরি ট্রাম্প বা তার দল-গোষ্ঠীর অবস্থান। ট্রাম্প বলতে চাচ্ছিলেন যে, আমেরিকার জন্য গ্লোবাল দায়-দায়িত্ব নেয়া বিশাল ভারী হয়ে উঠেছে। অতএব ভানুর কৌতুকের মতো, তা হলে যুদ্ধেই যাবো না; অর্থাৎ আমেরিকা আর ইকোনমিক গ্লোবালাইজেশন এবং আমেরিকান গ্লোবাল রোল এর কোনোটাতেই আর আমেরিকা থাকবে না। তাই সম্ভবত টিকা নিয়ে ফাজলামোর রাস্তায় তিনি। এ ছাড়া আরো যেমন- ট্রাম্প ন্যাটো ভেঙে দিতে চান। ১৯৪৫ সাল থেকে জার্মানি-জাপানে মার্কিন সেনাব্যারাক আছে আর এ কালের আফগানিস্তান থেকেও সব সেনা ফিরিয়ে আনতে চান। আর সবশেষে ৬ জানুয়ারি ২০২১ ট্রাম্প প্রকাশ্যেই ‘হোয়াইট সুপ্রিমিস্টদের’ হাতে সংসদ ভবন আক্রমণ করান ও এর বিল্ডিংয়ের মাথায় উঠে নৃত্য করান। তা হলে হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট কারা, কী তাদের পরিচয় ও চাওয়া, আর কেন ট্রাম্প তাদের সমর্থন করেন বা নেন?
সব প্রশ্নের জবাবের মাথা একখানে- চীনের কাছে আমেরিকার গ্লোবাল নেতৃত্ব, অভ্যন্তরীণ বাজার ও অর্থনীতি সব কিছু হারানোতে আমেরিকান সাধারণ মানুষের মনে ক্ষোভ থেকে ওঠা বিভিন্ন প্রতিক্রিয়ার একটি হলো হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট হয়ে যাওয়া বা সমর্থক হয়ে যাওয়া। এরা বলতে চায় আমেরিকা অর্থনীতির পিছিয়ে পড়া, ডুবে যাওয়া, কাজ-ব্যবসা হারানো, সচ্ছলতা কমে যাওয়া- এসব কিছুর কারণ হচ্ছে, আমেরিকা হলো সাদা ককেশীয় নীল-চোখের মানুষের দেশ। কিন্তু সেখানে আজ কালো আর বাদামি মানুষে ভরে গেছে। আর এরা ঢোকাতেই কাজ না পাওয়া বা সম্পদ ভাগাভাগিতে সঙ্কট এসেছে। আমরা সাদারাই শ্রেষ্ঠ ছিলাম; এখন সেই জমানাটাই ফেরত আনতে হবে- আমাদের গ্লোবাল দায়-দায়িত্ব আমাদের নিতে হবে কেন? এসবের অর্থে এরা বুঝুক না বুঝুক, যা তারা দাবি করছে এর বাস্তবায়ন-যোগ্যতা দুনিয়ায় থাকুক না থাকুক এরা এক অ্যান্টি-গ্লোবালাইজেশন অবস্থানে ঢুকে পড়েছে। আর এখানেই কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্রবাদীদের সাথে অজান্তেই তাদের অবস্থানগত মিল হয়ে গেছে। অথচ এরা খবর নেয় নাই যে, তাদের আমেরিকাই গত পঁচাত্তর বছর ধরে সারা দুনিয়াকে গ্লোবাল বাণিজ্যের গ্লোবালাইজেশনে টেনে নিয়ে গেছে। এখন খিচুড়ি একবার রান্না হয়ে গেলে কি আর চাল-ডাল আলাদা করা যায়? তেমনি এক বেচারা অবস্থায় এরা? এ ছাড়া আবার গত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এক প্রধান সমর্থক এরাই। মাঠের বিচারে এরাই মূল ফাইটার।
তা হলে গ্লোবাল কর্তৃত্ব হারাতে থাকা আমেরিকার অর্থনৈতিক এলোমেলো দুর্দশা দেখে একটি প্রতিক্রিয়া যদি হয় ট্রাম্প, তা হলে আর একই আমেরিকান দুর্দশায় আরেক প্রতিক্রিয়া হলো বাইডেন। বাইডেন বলতে চাইলেন তিনি অনেক বোঝেন- কাজেই তাদের আমেরিকা হারতে, হারাতে পারে না। তার হাতে চীন-রাশিয়াসহ যে কেউ-এর বিরুদ্ধে ব্যবহার করার মতো দুই মারাত্মক অস্ত্র আছে, যেটি অন্যরা বোঝেইনি। এটি হলো, অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ আর মানবাধিকার। এ দুটো ব্যবহার করলেই আমেরিকা আর কারো কাছে নেতৃত্ব হারাতে পারে না। আর এ কাজটিরই ব্যবহারিক রূপ-পদ্ধতি হলো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। রাশিয়া যখন এ সিদ্ধান্ত জানিয়েছে অ্যাকশনে যায়নি তখনই আমেরিকান প্রতিক্রিয়া হলো, এ স্যাংশন আরোপ। বাইডেন যে অনুমানের উপরে চলতে চাইছেন তা হলো, আমেরিকা রাশিয়ার সাথে কোনো যুদ্ধে যাবে না; তিনি বলেছেন ন্যাটো কোনো নো ফ্লাই জোন আরোপ করবে না। মানে ন্যাটোও যুদ্ধে জড়াবে না। কেবল অবরোধ আরোপ করেই নাকি বাইডেন সব দিকে জিতে আসবেন। মনে হচ্ছে বাইডেন সোনার ডিম দেয়া হাঁসের পেট কেটে সব ডিম বের করার পথে রওনা দিয়েছেন! তাই এ নিয়ে নিচে এক প্রফেসরের বক্তব্য শুনে শেষ করব।
সব কিছুতেই একই অবরোধ-নির্ভরতার অর্থ কী?
এটিকে প্রসঙ্গ করে প্রধান এক রিপোর্ট করেছে হংকংয়ের এক পুঁজিবাজার অভিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গের পত্রিকা এশিয়া টাইমস। আর এখানে এক্সপার্ট হিসেবে কথা বলেছেন আইএমএফের এক সাবেক চিফ ইকোনমিস্ট কেনেথ রগঅফ (কবহহবঃয জড়মড়ভভ), যিনি বর্তমানে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরও। তার শেষ কথাটাই আগে বলে শেষ করি :
এমনিতেই আমেরিকা যেকোনো স্যাংশন আরোপ বলে যা করছে এর পেছনে আইএমএফের কোনোই অনুমোদন নেই।’ এ ছাড়া এমন এই অতিমাত্রায় আমেরিকার স্যাংশন বা অবরোধের ব্যবহার কিন্তু এর পরিণতিতে কী হবে তা নিয়েই প্রফেসর বলছেন : স্যাংশন অস্ত্রের ব্যবহারের ফলে ডলার-মুক্ত (ডি-ডলারেজাইড) এক বিশ্ব হওয়ার এক প্রক্রিয়ার দিকে যাওয়া ব্যাপক গতি লাভ করবে। আর সেটিই ডলার আধিপত্যের কবর খোঁড়ার মতো সমতুল্য এক ঘটনা হবে।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com