ইউক্রেনের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধ শুরু করেছেন পুতিন?

অন্য এক দিগন্ত | Mar 06, 2022 01:46 pm
ইউক্রেনের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধ শুরু করেছেন পুতিন?

ইউক্রেনের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধ শুরু করেছেন পুতিন? - ছবি : সংগ্রহ

 

ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করেছে রাশিয়া। প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন কেন প্রতিবেশী দেশে আগ্রাসন চালানোর সিদ্ধান্ত নিলেন? তার কারণ হিসেবে অনেকগুলো বিষয় উঠে আসছে। রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের জটিল রাজনৈতিক ইতিহাসের ধর্মীয় প্রতিরূপ রয়েছে, ইউক্রেনের সংখ্যাগরিষ্ঠ অর্থোডক্স খ্রিস্টান জনসংখ্যা কিয়েভে থাকে। তাদের মধ্যে একটি গোষ্ঠী স্বাধীন-মনোভাবাপন্ন এবং অন্যটি মস্কোর প্রতি অনুগত। কিন্তু ইউক্রেনের স্বাধীন হয়ে বেঁচে থাকার লড়াইয়ের মধ্যে ধর্মীয় আনুগত্য রাজনৈতিক আনুগত্যকে প্রতিফলিত করে না। যদিও রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন হামলার যুক্তির অনেকগুলি বিষয় হিসেবে মস্কো-ভিত্তিক অর্থোডক্স চার্চের প্রতিরক্ষার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। তবে, ইউক্রেনীয় অর্থোডক্স উপদলের নেতারা রাশিয়ান আক্রমণের তীব্র নিন্দা করছেন, যেমন ইউক্রেনের উল্লেখযোগ্য ক্যাথলিক সংখ্যালঘুরা।

কিয়েভের অর্থোডক্স চার্চের প্রধান মেট্রোপলিটান এপিফানি বলেছেন, 'আমরা ইউক্রেনের জন্য প্রার্থনা করছি, ঈশ্বরের প্রতি ভালোবাসা রয়েছে। আমরা মন্দের বিরুদ্ধে লড়াই করি এবং আমরা বিজয় দেখতে পাব।' ইউক্রেনীয় অর্থোডক্স চার্চের প্রধান মেট্রোপলিটান ওনফ্রি বলেছেন, 'পারস্পরিক ঝগড়া এবং ভুল বোঝাবুঝি ভুলে যান এবং ঈশ্বর এবং আমাদের মাতৃভূমির প্রতি ভালবাসার সঙ্গে একত্রিত হোন।'

আপাতদৃষ্টিতে এটা ঐক্যের বার্তা মনে হলেও এর ভিতরে ফাঁক রয়েছে প্রচুর। বৃহস্পতিবার ওনফ্রি তার বার্তা দেয়ার একদিন পর তার চার্চের ওয়েবসাইট প্রতিবেদন প্রকাশ করতে শুরু করে যে চার্চ এবং লোকজনকে আক্রমণ করা হচ্ছে। প্রতিদ্বন্দ্বী চার্চের প্রতিনিধিদের আক্রমণের জন্য দায়ী করা হয়। ইউক্রেনের অর্থোডক্স সংস্থাগুলোর মধ্যে বিভাজন সাম্প্রতিক বছরগুলিতে বিশ্বব্যাপী প্রতিফলিত হয়েছে কারণ অর্থোডক্স চার্চগুলো কিভাবে এবং কার পক্ষ নেবে তা নিয়ে লড়াই করেছে। কয়েকটি মার্কিন অর্থোডক্স আশা করে যে তারা এই ধরনের দ্বন্দ্বগুলোকে একপাশে রেখে যুদ্ধ শেষ করার জন্য একত্রিত হতে পারে। আবার অনেকে মনে করে যুদ্ধ বিভাজন আরো বাড়িয়ে তুলতে পারে।

ইউক্রেনের ধর্মীয় চিত্রটা ঠিক কী? ইউক্রেনীয় জনসংখ্যার একটি বড় গরিষ্ঠ অংশ অর্থোডক্স, ইউক্রেনীয় ক্যাথলিকরা উল্লেখযোগ্য ভাবে সংখ্যালঘু। যারা অর্থোডক্সের মতো বাইজেন্টাইন আচারে উপাসনা করে কিন্তু পোপের প্রতি অনুগত। মোট জনসংখ্যার কিছু অংশ প্রোটেস্ট্যান্ট, ইহুদি এবং মুসলমান। ইউক্রেন এবং রাশিয়া ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক উভয় ক্ষেত্রেই একটি সাধারণ ইতিহাস বহন করছে। রুশরা পূর্ব স্লাভীয় উপজাতি থেকে গঠিত হয়েছিল এবং তাদের সাংস্কৃতিক পূর্বপুরুষদের ভিত্তি কিভান রুশে অবস্থিত। দশম শতকের প্রিন্স ভ্লাদিমির পৌত্তলিকতা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, ক্রিমিয়াতে গিয়ে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা নিয়েছিলেন এবং অর্থোডক্সি-কে সরকারি ধর্ম হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। ২০১৪ সালে পুতিন ক্রিমিয়া দখলের ন্যায্যতা প্রমাণ করার জন্য সেই ইতিহাস উদ্ধৃত করেছিলেন। ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার কাছে 'পবিত্র' ভূমি হিসেবে তিনি দাবি করেন। যদিও পুতিন বলেছেন যে রাশিয়াই রুশ সাম্রাজ্যের প্রকৃত উত্তরাধিকারী।

ইউক্রেনীয়রা বলে যে, তাদের আধুনিক রাষ্ট্রের একটি স্বতন্ত্র বংশধারা রয়েছে। মস্কো শতাব্দীর পর শতাব্দী এমন ক্ষমতাধর ছিল না। অর্থোডক্স সম্পর্কের মধ্যে সেই উত্তেজনা বজায় রয়েছে। অর্থোডক্স চার্চগুলোর ঐতিহাসিক ভাবে তাদের অঞ্চলে স্বায়ত্তশাসন বজায় রেখেছে। কনস্টান্টিনোপলের একুমেনিকাল প্যাট্রিয়ার্ককে সর্বোচ্চ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু ক্যাথলিক পোপের বিপরীতে তার সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা নেই।

ইউক্রেনের অর্থোডক্স চার্চগুলিকে আজ কে শাসন করে?

এর পিছনে রয়েছে ৩০০ বছরেরও বেশি আগের ইতিহাস। রাশিয়ার শক্তি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এবং উসমানিয়া শাসনের অধীনে কনস্টান্টিনোপল চার্চ দুর্বল হয়ে পড়ার পর, ১৬৮৬ সালে ইকুমেনিকাল প্যাট্রিয়ার্ক মস্কোর প্যাট্রিয়ার্ককে কিয়েভের মেট্রোপলিটান (শীর্ষ বিশপ) নিয়োগ করার ক্ষমতা অর্পণ করেন। রাশিয়ান অর্থোডক্স চার্চ বলে যে এটি একটি স্থায়ী স্থানান্তর ছিল। যদিও, দ্য ইকুমেনিকাল প্যাট্রিয়ার্ক বলেছেন যে এটি ছিল অস্থায়ী।

গত এক শতাব্দী ধরে স্বতন্ত্র-মনোভাবাপন্ন ইউক্রেনীয় অর্থোডক্সরা পৃথক গির্জা গঠন করেছে। অথচ, ২০১৯ সাল পর্যন্ত সেগুলির আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির অভাব ছিল। বর্তমান ইকুমেনিকাল প্যাট্রিয়ার্ক বার্থোলোমিউ ইউক্রেনের অর্থোডক্স চার্চকে মস্কোর প্যাট্রিয়ার্কের অধীনতা থেকে মুক্ত বলে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন ওই বছর। কিন্তু সকলে এই পদক্ষেপ মেনে নিতে পারেননি। ইউক্রেনের পরিস্থিতি তখন আরো ঘোলাটে ছিল। অনেক মঠ এবং প্যারিশগুলো মস্কোর প্যাট্রিয়ার্কের অধীনে রয়ে গিয়েছে, যদিও এর সঠিক পরিসংখ্যান খুঁজে পাওয়া কঠিন।

এই বিভেদ কি দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক বিভাজনকে প্রতিফলিত করে?

হ্যাঁ, তেমনটাই হচ্ছে। তবে এর মধ্যে বিস্তর জটিলতা রয়েছে। ইউক্রেনের সাবেক প্রেসিডেন্ট পেট্রো পোরোশেঙ্কো ২০১৮ সালে বলেছিলেন, "আমাদের চার্চের স্বাধীনতা ইউরোপ-পন্থী এবং ইউক্রেনীয়পন্থী নীতির অংশ।" কিন্তু বর্তমান প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি হলেন ইহুদি, তিনি ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের উপর জোর দেননি। শনিবার তিনি বলেছিলেন যে তিনি উভয় অর্থোডক্স নেতাদের পাশাপাশি শীর্ষ ক্যাথলিক, মুসলিম এবং ইহুদি প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি বলেন, 'সকল নেতা সেই সকল আত্মার জন্য প্রার্থনা করেন যারা ইউক্রেনের জন্য এবং আমাদের ঐক্য ও বিজয়ের জন্য জীবন দিয়েছেন। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।'

পুতিন আসলে ধর্মীয় বিভাজনকেই পুঁজি করার চেষ্টা করেছেন। ২১ ফেব্রুয়ারির ভাষণে তিনি একটি বিকৃত ঐতিহাসিক বর্ণনা দিয়ে ইউক্রেনের আসন্ন আক্রমণকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য দাবি করেছিলেন যে, মস্কো পিতৃতান্ত্রিক ইউক্রেনীয় অর্থোডক্স চার্চ ধ্বংস করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু মেট্রোপলিটান ওনুফ্রির যুদ্ধকে কেনের 'পাপের' সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। কেন বাইবেলের একটি চরিত্র, যিনি তার ভাইকে হত্যা করেছিলেন। মেট্রোপলিটান ওনুফ্রির বক্তব্য এটাই ইঙ্গিত দেয় যে মস্কো-ভিত্তিক গির্জারও ইউক্রেনের জাতীয় পরিচয়ের একটি দৃঢ় ধারণা রয়েছে। অন্যদিকে, মস্কোর প্যাট্রিয়ার্ক কিরিল শান্তির আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু ইউক্রেনে আক্রমণের জন্য রাশিয়াকে দায়ী করেননি। মস্কো প্যাট্রিয়ার্কের অধীনে ইউক্রেনীয় অর্থোডক্স চার্চের দীর্ঘকাল ধরে ব্যাপক স্বায়ত্তশাসন রয়েছে। ইউএস সেন্সাস অফ অর্থোডক্স খ্রিস্টান চার্চের কোঅর্ডিনেটর আলেক্সি ক্রিন্ড্যাচ বলেছেন, 'চার্চের অধিভুক্তি নির্বিশেষে অনেক নতুন পাদ্রী আছেন যারা স্বাধীন ইউক্রেনে বেড়ে উঠেছেন।' প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নে বেড়ে ওঠা ক্রিন্ড্যাচ বলেছেন, 'তাদের রাজনৈতিক পছন্দগুলো তাদের প্যারিশের আনুষ্ঠানিক বিচারব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়।'

ক্যাথলিকদের অবস্থায় কোথায়?

ইউক্রেনীয় ক্যাথলিকরা মূলত পশ্চিম ইউক্রেনে অবস্থিত। ইউক্রেনীয় ক্যাথলিকদের জার এবং কমিউনিস্টদের অধীনে নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের বিশেষভাবে ইতিহাস রয়েছে। ফিলাডেলফিয়ার ইউক্রেনীয় ক্যাথলিক আর্কিপার্কির জনসংযোগ বিভাগের প্রধান মারিয়ানা কারাপিঙ্কা বলেছেন, 'যতবারই রাশিয়া ইউক্রেন দখল করে, ততবারই ইউক্রেনীয় ক্যাথলিক চার্চগুলি ধ্বংস হয়ে যায়।' ইউক্রেনীয় ক্যাথলিকদের সোভিয়েতদের দ্বারা কঠোরভাবে দমন করা হয়েছিল, বেশ কয়েকজন নেতাকে হত্যাও করা হয়েছিল। পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছায় যে অনেক ইউক্রেনীয় ক্যাথলিক আন্ডারগ্রাউন্ডে উপাসনা করতে শুরু করেন। কমিউনিজমের অবসানের পর থেকে গির্জা আবারো ফিরে আসে। ইউক্রেনীয় ক্যাথলিকদের মস্কোর বিরোধিতা করার এটি একটি শক্তিশালী কারণ। কারাপিঙ্কা বলেছেন, 'ইউক্রেনীয় ক্যাথলিকরাই একমাত্র গোষ্ঠী, যারা সোভিয়েতদের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছিল।'

সম্প্রতি পোপ ফ্রান্সিস রাশিয়ান অর্থোডক্স চার্চের সঙ্গে সম্পর্ক গলানোর চেষ্টা করেছিলেন, এমনকি ইউক্রেনীয় এবং অন্যান্য পূর্বাঞ্চলীয় ক্যাথলিকদের অধিকার রক্ষা করার কথাও তিনি বলেছিলেন। যদিও রুশ আক্রমণের পর পোপ ফ্রান্সিস শুক্রবার রাশিয়ান দূতাবাস পরিদর্শন করে যুদ্ধ নিয়ে তার উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। রীতি অনুযায়ী, ভ্যাটিকানের বিদেশমন্ত্রী রাষ্ট্রদূতদের ডেকে পাঠাতে পারেন। তবে এই রীতি ভেঙে নিজেই রাশিয়ার দূতাবাসে চলে যান পোপ ফ্রান্সিস। যুদ্ধ বন্ধের বার্তা দিলেও সরাসরি রাশিয়ার বিরুদ্ধে কোনো কথা বলেননি পোপ। বিশেষজ্ঞদের অনেকেরই মত, রাশিয়ান অর্থোডক্স চার্চের বিরোধিতার আশঙ্কায় পুরোপুরি মুখ খোলেননি পোপ ফ্রান্সিস।

অর্থোডক্স চার্চের ব্যাপ্তি
ইউক্রেনের চার্চগুলকে স্বাধীন হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য রাশিয়ান অর্থোডক্স চার্চ ২০১৮ সালে কনস্টান্টিনোপলের একুমেনিকাল প্যাট্রিয়ার্কের সাথে সম্পর্ক ভাঙার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এর অর্থ হলো মস্কো এবং কনস্টান্টিনোপল-অধিভুক্ত চার্চের সদস্যরা অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবে না। বিবাদ আফ্রিকার পূর্ব অর্থোডক্স গীর্জাগুলোতেও ছড়িয়ে পড়েছে, যেখানে আফ্রিকা চার্চগুলো ইউক্রেনের চার্চগুলোকে স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেয়ার পরে রাশিয়ান অর্থোডক্সও বেশ কিছু চার্চকে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু অন্য অনেক গির্জা দ্বন্দ্ব এড়াতে চেয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একাধিক অর্থোডক্সের অধীনে থাকা বেশিরভাগ গোষ্ঠী এখনো একে অপরের সঙ্গে সহযোগিতা করে এবং উপাসনা করে। আমেরিকার অর্থোডক্স চার্চের চ্যান্সেলর ভেরি রেভ. আলেকজান্ডার রেন্টেল বলেছেন, এই যুদ্ধ মার্কিন চার্চগুলোর মধ্যে ঐক্য আরো বাড়াতে পারে। তবে সম্পর্ককে আরো পরীক্ষা করতে পারে৷ এখন এই যুদ্ধের কারণে এটি আরো কঠিন হতে চলেছে।'

সূত্র : নিউজ ১৮

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us