সেই কষ্ট চেপে দুর্দান্ত লড়াই করলেন ইমাম উল হক
সেই কষ্ট চেপে দুর্দান্ত লড়াই করলেন ইমাম উল হক - ছবি : সংগৃহীত
বাড়ির লোকের সাথে কথা বলছেন না। মনে হচ্ছে আশপাশ সব ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। এই গোটা পৃথিবীতে তিনি একা হয়ে যাচ্ছেন। ২১ বছরের এক তরুণ নিজের মনের মধ্যে লড়াই করে চলেছেন। কখনও কখনও ভেঙে পড়ছেন। গোসলখানায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেঁদে চলেছেন। আর তৈরি হচ্ছেন একটা সুযোগের জন্য।
ইমাম উল হক সেই সুযোগ পেলেন ২০১৭ সালে। সেটাই যথেষ্ট ছিল তার জন্য। এত দিন যারা বলছিলেন, “ইনজামাম উল হকের ভাতিজা বলে পাকিস্তান দলে সুযোগ পেয়েছে ইমাম” তাদের সপাটে বাউন্ডারির বাইরে পাঠালেন তিনি। প্রথম ম্যাচ খেলতে নেমেই শতরান। শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে এক দিনের ম্যাচে ১২৫ বলে ১০০ করেন তিনি। পাকিস্তানের দ্বিতীয় ব্যাটার হিসেবে প্রথম ম্যাচেই শতরান করলেন ইমাম। পরের ৯ ম্যাচে চারটি শতরান। বিশ্বের কোনও ব্যাটারের এমন রেকর্ড নেই। স্বজনপোষণের অভিযোগ ভেঙে গুঁড়িয়ে দিলো ইমামের ব্যাট।
এখনও পর্যন্ত ৪৬টি এক দিনের ম্যাচ খেলে সাতটি শতরান করেছেন তিনি। রান ২০২৩। সর্বোচ্চ ১৫১। সাদা বলের ক্রিকেটে জায়গা হলেও লাল বলের ক্রিকেটে খেলার জন্য অপেক্ষা করতে হয় ২০১৮ পর্যন্ত। কিন্তু কুলীন ক্রিকেটে সেই ভাবে নিজেকে মেলে ধরতে পারছিলেন না চোখে চশমা আঁটা ইমাম। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে রাওয়ালপিণ্ডির টেস্ট বাদ রাখলে এখন অবধি ১১টি টেস্ট খেলেছেন তিনি। শতরান ছিল না। তিনটি অর্ধশতরান ছিল। ২০১৯ সালের পর দল থেকেই বাদ রাখা হয় তাকে।
৪ মার্চ, ২০২২ পাকিস্তানের সাদা জার্সি ওপেন করতে নামলেন ইমাম। সামনে মিচেল স্টার্ক, প্যাট কামিন্স, জস হ্যাজেলউডের মতো পেসার। চোখে চশমা এঁটে নেমে পড়লেন ইমাম। দেড় শ' কিলোমিটার বেগে ছুটে আসা বল সামলাচ্ছেন চোখে চশমা পরে! ক্রিকেট দুনিয়া যদিও এমন ঘটনা প্রথম দেখেছে এমন নয়। অনিল কুম্বলে, ক্লাইভ লয়েড, জাহির আব্বাস, ড্যানিয়েল ভেত্তোরির মতো একাধিক ক্রিকেটার চশমা পরে খেলেছেন। কিন্তু কোনো ওপেনার চশমা পরে খেলছেন এই দৃশ্য খুব পরিচিত নয়। কিছু সময়ের জন্য বীরেন্দ্র সেহবাগ চশমা পরে খেলতেন। তবে সেটা দীর্ঘ দিনের জন্য নয়।
ইমাম খেললেন। শুধু খেললেন না, স্টার্কদের তুলোধোনা করে ১৫৭ রান করলেন। টেস্টে এটাই তার প্রথম শতরান। এটাই কি পাল্টে দেবে তার টেস্ট জীবন? এখনই বলা সেটা কঠিন। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে গোটা সিরিজে নজর থাকবে তার দিকে। আন্তর্জাতিক জীবনের শুরুটা খুব সহজ ছিল না ইমামের। সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে যেভাবে লড়াই চালিয়েছেন তিনি, আগামী দিনেও সেই লড়াইটাই তার সামনে।
কেমন ছিল আন্তর্জাতিক জীবন শুরুর লড়াই? এক সাক্ষাৎকারে ইমাম বলেন, “আমি একা একা খেতাম। কেউ ছিল না আমার পাশে। আমার প্রথম সফর ছিল সেটা। সবাই জানে প্রথম সফর কেমন হয়। ফোন খুললেই আমাকে উদ্দেশ করে লেখা। খারাপ লাগত। বুঝতাম না কী করব। পরিবারের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। ওদের উপর চাপ দিতে চাইনি। আমার ফোন বন্ধ করে ম্যানেজারকে দিয়ে দিয়েছিলাম।”
কষ্ট পেয়েছিলেন ইমাম। তিনি বলেন, “এখনও মনে আছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাঁদতে কাঁদতে গোসল করছি। নিজের উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলার মতো অবস্থা হয়েছিল তরুণ ক্রিকেটারের। শুধু একটা জিনিস আমার মাথায় ঘুরছিল। আমি দেশের হয়ে খেলিনি। যদি সুযোগ পাই আর খেলতে না পারি? আমার কেরিয়ারটাই শেষ হয়ে যাবে। ঘরের বাইরে যেতাম না। দুবাইতে প্রচুর পাকিস্তানী। তাই মনে হতো বাইরে গেলেই আমাকে কথা শুনতে হবে।”
সেই চাপ কাটিয়ে পাকিস্তানের হয়ে খেলছেন ইমাম। টেস্ট দলেও জায়গা করে নিয়েছেন। অপেক্ষা আগামী দিনের। ইনজামামের ভাতিজা বলে আর তিনি পরিচিত নন, ইমামের নাম সকলে জেনে গিয়েছে। এ বার সেই নাম প্রতিষ্ঠার সময়। কুলীন ক্রিকেটে নিজের নাম খোদাই করার সময়।
সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা