এ যুগের ফিল্ড মার্শাল
এ যুগের ফিল্ড মার্শাল - ছবি : সংগৃহীত
তাকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি কিছুটা ভিন্ন ধরনের নেতা। যুগের পরিবর্তনের সুবাদে কিছু নেতার পরিবর্তন আমরা দেখতে পাচ্ছি। যেমন রাশিয়ার আকস্মিক আক্রমণ ইউক্রেনে বিশ্বের অনেক নেতার নেতৃত্বের ক্যাপাসিটি এবং ক্যাপাবিলিটি আমরা লক্ষ করছি। পুতিন যেমন গণসমাজ থেকে দূরে থেকে ডিজিটাল কমনিকেশন মেইনন্টেইন করে চলেছে। করোনা প্যান্ডামিকের সময়েও লক্ষণীয় অনেকেই নেতৃত্ব দিয়ে চলেছে পর্দার আড়াল থেকে আবার অনেকে জনগণের পাশে এবং সাথে থেকে মহামারির সঙ্গে লড়েছেন। যে সব নেতা জনগণের সাথে থেকে কাজ করে তাদের উদ্দেশ্য মনে করিয়ে দেয় যেমন 'দশে মিলে করি কাজ হারি জিতি নাহি লাজ।'
আমি অতীতের একটি ঘটনা জেনেছিলাম পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যেকার অস্থিরতার সময়। তৎকালীন পাকিস্তানের ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান ভারতের গণপ্রতিনিধি ইন্দিরা গান্ধিকে বলেছিলেন যে তিনি নিজেই মাঠে নেমেছেন যুদ্ধে, অন্যদিকে ইন্দিরা গান্ধি পর্দার আড়ালে থেকে যুদ্ধের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বিষয়টি জনসমাজে বিভিন্নভাবে দেয়া হয়েছিল। তখন অনেকে কথাটির বাহবা দিয়েছে, আবার অনেকে বলেছে আইয়ুব খানের চাকরিই যুদ্ধ বাঁধলে সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়া যার কারণে তাকে বেতন দেয়া হয় ইত্যাদি। আবার হিটলারকেও যুদ্ধের ময়দানে দেখা গেছে, কারণ তারও ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল আইয়ুব খানের মতো।
তবে এযুগের জনগণের নির্বাচনে নির্বাচিত নেতাকে যুদ্ধের ময়দানে ঘোরাঘুরি করতে খুব কমই দেখা যায় যেমনটি আমরা দেখতে পাচ্ছি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ব্লাগিমির জেলেনস্কিকে। তাকে নিয়ে ইউরোপসহ গোটা বিশ্বে বেশ আলোচনা চলছে। যদিও এখনও বিশাল কিছু ঘটেনি যে তাকে ঘাড়ে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হবে তবে যে আভাস তার ব্যক্তিত্বে ফুটে উঠেছে তাতে করে প্রকৃতির সাথে কিছুটা মিল পাওয়া যায়। ছোটবেলায় মুরব্বিদের মুখে বলতে শুনেছি “যে গাছটা বাড়ে তার তিন পাতা দেখলে বোঁঝা যায়”। প্রবাদ প্রবচনের মাধ্যমে বাঙালির জীবন, ধর্ম, সংস্কৃতি, আচার, বিশ্বাস ও রসবোধের পরিচয় পাওয়া যায়। আমি আবার সেই জাতে বাঙালি তাই কথায় কথায় প্রবাদ বাক্য ব্যবহার করতে চেষ্টা করি। যাই হোক, যখন কেউ মন্দ কিছু করে আমরা সমালোচনা করি ঠিক কেউ ভালো কিছু করলে তারও প্রশংসা করা উচিত বৈকি?
জেলেনস্কিকে সব ধরণের নিরাপত্তা দিতে অনেকেই আগ্রহ প্রকাশ করেছে তাদের মধ্যে আমেরিকার নাম এসেছে। কারণ বিষয়টিকে বিভিন্ন জন বিভিন্নভাবে দেখছে। কারো ধারনা পুতিনের প্রধান টার্গেট ইউক্রেনের বর্তমান প্রশাসন ধ্বংস করা। সে ক্ষেত্রে জেলেনস্কিকে নিরাপত্তা দিতে বিশ্বের অন্য নেতাদের দায়িত্ব রয়েছে।
আসুন ফিরে যাই জেলেনস্কির ব্যক্তিজীবনে। সুইডেনে আমার কিছু ইউক্রান বন্ধু রয়েছে যারা জেলেনস্কির সমবয়সী। স্বাভাবিকভাবে গণমাধ্যমে তাঁকে নিয়ে নানাভাবে আলোচনা হচ্ছে। কথা প্রসঙ্গে জানলাম তাঁর জীবনের কিছু ঘটনা। যেমন বয়স তার খুব একটা বেশি না, মাত্র ৪৪ বছর। পড়ালেখায় মোটামুটি তবে সৃষ্টিশীল কাজে খুব ভালো। স্কুলে পড়াকালীন একবার এক মন্ত্রী স্কুল পরিদর্শনে এসে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় মনোযোগী হতে উপদেশ দেয়। মন্ত্রী পরামর্শ দেযন সবাইকে আরো মেধাবী হতে। অজানাকে জানতে হবে, জ্ঞানকে বিকশিত করতে হবে ইত্যাদি। জেলেনস্কি হাসতে হাসতে বলেছিল, মাননীয় মন্ত্রী আমাদের জ্ঞান যত বাড়বে, আপনাদের কাজ তত কমবে। আমরা কম মেধাবী বলেই তো আপনারা আজ বড় বড় মন্ত্রী। অনেকেই অনেক সময় মনে মনে অনেক কিছুই ভাবে কিন্তু সাহস করে সবাই সবকিছু বলতে পারে না যা সে বলেছিল। এখন যেমন অনেকে বলছে তারা জানত ছেলেটি বড় হলে কিছু একটা হবে। এই ছেলেটি হয়তো একদিন নতুন পথ দেখাবে। সেটা এখন দেখার সময়। জেলেনস্কির কর্মজীবনের শুরু স্ক্রিনরাইটার হিসেবে, তারপর অভিনেতা কৌতুক অভিনেতা হিসাবে কাজ করেছে। ছবির পরিচালনাও করেছে। ছবি পরিচালনা করতে গিয়ে ভাবনায় ঢুকেছে দেশের কথা। বিভিন্ন পদে অযোগ্য মানুষে দেশটা ভরে আছে। এই চিন্তা থেকে রাজনীতিতে এসেছে এবং সে ৬ষ্ট প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে।
তবে আমার মনে পড়ে শপথ নেয়ার অনুষ্ঠানে তিনি বেশ কিছু অপ্রিয় সত্য তুলে ধরেছিলেন। বলেছিলেন, নিজের যোগ্যতায় প্রেসিডেন্ট হইনি, প্রেসিডেন্ট হয়েছি পূর্ববর্তী শাসকের অযোগ্যতায়।"
পরে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কথা বলেছে। যেমন একজন প্রধান শিক্ষকের কাজ স্কুল পরিচালনা করা, “একইভাবে আমারও কাজ রাষ্ট্র পরিচালনা করা। কাজেই আমি মূর্তিও না, প্রতিমাও না, আইকনও না। সুতরাং আমার ছবি অফিসের দেয়ালে দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখার কোনো দরকার নেই। আপনজনের ছবি লাগান। মন ভালো থাকলে কাজেও আনন্দ পাবেন। আমি আমার অফিসে আমার শিশুর ছবি লাগাবো। আপনারাও আপনাদের অফিসে শিশুর ছবি লাগান। মাতা-পিতার ছবি লাগান। আর যেকোনো কাজ করার আগে তাদের দিকে একবার তাকান। এসব মানুষের ছবি সামনে রেখে কেউ কোনো বাজে কাজ করতে পারেনা। আপনার বাবা-মা যেমন আপনাকে এই জায়গায় নিয়ে এসেছেন। আপনারও শপথ হবে আপনার শিশুকে আপনি আরো সুন্দর জায়গায় পৌঁছে দিবেন। আমি একসময় ছবির পরিচালনা করেছিলাম। কিন্তু দেশ তো আর ছবি নয়, তবে সবাই মিলে চাইলে আমরা দেশকে ছবির মতোই করতে পারি ইত্যাদি।
এসব খবরের কাগজে তখন দেখেছি। একটি ডুকুমেন্টরি দেখলাম গতকাল, ঘাড়ে ব্যাগ নিয়ে সংসদে ঢুকলেন, ঢুকে টেবিলের উপর ব্যাগ থেকে ল্যাপটপ বের করছেন। তার আগে বাসা থেকে লাঞ্চ নিয়ে এসেছিলেন যে পাত্রে সেটা বের করলেন। বোঝা গেল রাজকীয় লাঞ্চ হয়নি জনগণের টাকায়। হঠাৎ সংসদ ভবনে ঢুকে দেখেন তুমুল আকারে হাতাহাতি চলছে। কে শুনে কার কথা, জলেনস্কি প্রথমে বললেন প্লিজ থামুন কী হচ্ছে এসব? কেউ খেয়ালই করল না তিনি কী বললেন। কিছুক্ষণ পর বললেন, পুতিন আক্রমণ করছে আমাদের? সবাই মারামারি ছেড়ে মুহূর্তের মধ্যে হতভম্ব হয়ে জেলেনস্কির দিকে তাকাতেই তিনি বললেন, সরি জোকস করছি। এভাবে হাসি তামাশার মধ্যদিয়ে কখনও সারকাস্টিকভাবে বড় বড় সমস্যার সমাধান করার পেছনে সম্ভবত তার অভিনয় জীবনের অভিজ্ঞতা কাজ করেছে।
লেখক : সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন।
rahman.mridha@gmail.com